ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা ভাইরাস

লক্ষণ ও প্রতিকার

প্রকাশিত: ১১:০৬, ২৮ জানুয়ারি ২০২০

লক্ষণ ও প্রতিকার

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ চীনের উহান প্রদেশ থেকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া নতুন ধরনের প্রাণঘাতী ভাইরাস করোনা এখন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে বিশ্বজুড়ে। বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, এ ভাইরাস চীনে কেড়ে নিয়েছে অন্তত ৮১ জনের প্রাণ, নিউমোনিয়ার মতো লক্ষণ নিয়ে সংক্রমিত হয়েছে আরও তিন হাজারের বেশি মানুষের দেহে। চীনের বাইরে করোনা ভাইরাসে সংক্রমণের ঘটনা ধরা পড়েছে কমপক্ষে ১২ দেশে। চীনের সঙ্গে যোগাযোগ বেশি থাকায় বাংলাদেশও নতুন এই ভাইরাসের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সংক্রমণ ঠেকাতে বাংলাদেশেও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। খবর বিডিনিউজের। করোনা ভাইরাস কী করোনা ভাইরাস পরিবারের এই নতুন সদস্যকে বলা হচ্ছে ‘নোভেল’ করোনা ভাইরাস। সংক্ষেপে ২০১৯-এনসিওভি। ১৯৬০-এর দশকে মুরগির ব্রঙ্কাইটিসের কারণ খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো করোনা ভাইরাসের সঙ্গে পরিচিত হন। এরপর বহু ধরনের করোনা ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ছয়টি (এখন হলো সাতটি) মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। ২০০২ সালে সার্স (পুরো নাম সিভিয়ার এ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) নামে যে ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৭৭৪ লোকের মৃত্যু হয়েছিল সেটিও এক ধরনের করোনা ভাইরাস। সে সময় ওই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল ৮ হাজারের বেশি মানুষ। এরপর ২০১২ সালে আসে মার্স (মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) করোনা ভাইরাস, যে রোগে আক্রান্ত ২৪৯৪ জনের মধ্যে ৮৫৮ জনের মৃত্যু হয়। এ পরিবারের নতুন সদস্য ‘নোভেল’ করোনা ভাইরাসের মানবদেহে সংক্রমণের বিষয়টি প্রথম শনাক্ত করা হয় ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে। পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ভাইরাসটির নাম দেয় ২০১৯-এনসিওভি। এর লক্ষণ কী? শুরুটা হয় জ্বর দিয়ে, সঙ্গে থাকতে পারে সর্দি, শুকনো কাশি, মাথাব্যথা, গলাব্যথা ও শরীর ব্যথা। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে দেখা দিতে পারে শ্বাসকষ্ট। সাধারণ ফ্লুর মতোই হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়াতে পারে এ রোগের ভাইরাস। করোনা ভাইরাস মূলত শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায়। লক্ষণগুলো হয় অনেকটা নিউমোনিয়ার মতো। কারও ক্ষেত্রে ডায়রিয়াও দেখা দিতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল হলে এ রোগ কিছুদিন পর এমনিতেই সেরে যেতে পারে। তবে ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্র বা ফুসফুসের পুরনো রোগীদের ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। এটি মোড় নিতে পারে নিউমোনিয়া, রেসপিরেটরি ফেইলিউর বা কিডনি অকার্যকারিতার দিকে। পরিণতিতে ঘটতে পারে মৃতু্যু। চীনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের দেহে ভাইরাস সংক্রমণের পর লক্ষণ দেখা দিতে পারে এক থেকে ১৪ দিনের মধ্যে। কিন্তু লক্ষণ স্পষ্ট হওয়ার আগেই এ ভাইরাস ছড়াতে পারে মানুষ থেকে মানুষে। আর এ কারণেই চীনে এ রোগের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। উৎস কী? মধ্য চীনের উহান শহরে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর করোনা ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়। নিউমোনিয়ার মতো লক্ষণ নিয়ে নতুন এ রোগ ছড়াতে দেখে চীনা কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। এরপর ১১ জানুয়ারি প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। বিবিসি লিখেছে, ঠিক কীভাবে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরু“ হয়েছিল- সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত নন বিশেষজ্ঞরা। তবে তাদের ধারণা, মানুষের দেহে এ রোগ এসেছে কোন প্রাণী থেকে। তারপর মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়েছে। করোনা ভাইরাসের সঙ্গে উহান শহরে একটি সি ফুড মার্কেটের যোগাযোগ পাওয়া যায়। কিছু সামুদ্রিক প্রাণী যেমন বেলুগা জাতীয় তিমি করোনা ভাইরাস বাহক হতে পারে। তবে ওই বাজারে মুরগি, বাদুড়, খরগোশ, সাপসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী পাওয়া যায়, যেগুলোর মাধ্যমে করোনা ভাইরাস মানুষের দেহে আসতে পারে। গবেষকরা বলছেন, ঘোড়ার নাল বাদুড়ের মধ্যে পাওয়া যায় এরকম একটি করোনা ভাইরাসের সঙ্গে এই নোভেল করোনা ভাইরাসের মিল পাওয়া যায়। তবে উহানের ওই বাজারে জ্যান্ত মুরগি, বাদুড়, খরগোশ এবং সাপ বিক্রি হতো। হয়তো এগুলোর কোন একটি থেকে এই নতুন ভাইরাস এসে থাকতে পারে। সার্স ভাইরাস প্রথমে বাদুড় এবং পরে ভোঁদড়ের মাধ্যমে মানুষের দেহে ছড়িয়েছিল। আর মার্স ছড়িয়েছিল উট থেকে। প্রতিকার কী নোভেল করোনা ভাইরাসের কোন টিকা বা ভ্যাকসিন এখনও তৈরি হয়নি। ফলে এমন কোন চিকিৎসা এখনও মানুষের জানা নেই, যা এ রোগ ঠেকাতে পারে। ভাইরাসটির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো, যারা ইতোমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন বা এ ভাইরাস বহন করছেন- তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. গ্যাব্রিয়েল লিউং বলছেন, বার বার হাত ধুলে, হাত দিয়ে নাক-মুখ স্পর্শ না করলে এবং ঘরের বাইরে গেলে মুখোশ পরলে ভাইরাসের সংক্রমণ এড়ানো সহজ হতে পারে। পাশাপাশি কাশি বা হাঁচির সময় মুখ ও নাক ঢেকে রাখা, মাংস ও ডিম ভালভাবে ধুয়ে এমনভাবে রান্না করে (যাতে কোনভাবে কাঁচা না থাকে) খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আর যাদের মধ্যে ইতোমধ্যে সংক্রমণ ঘটেছে, তাদেরও মুখোশ ব্যবহার করা উচিত, যাতে অন্যদের মধ্যে ভাইরাস না ছড়াতে পারে। আক্রান্ত হলে জ্বর ও ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে প্রচুর তরল পানের পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা। কারও মধ্যে কাশি, হাঁচির সঙ্গে শ্বাসকষ্টের লক্ষণ দেখা গেলে তার সংস্পর্শে আশার ক্ষেত্রেও সাবধান থাকতে বলছেন চিকিৎসকরা। উহান শহরে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের সংস্পর্শে এসে বেশ কয়েকজন চিকিৎসাকর্মীও আক্রান্ত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগ করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ব্যাপক জনসচেতনতা ও ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার ওপর জোর দিচ্ছে। এ ধরনের ভাইরাস যানবাহনের হাতল, দরজার নব, টেলিফোন রিসিভার ইত্যাদি সাধারণ বস্তু থেকেও ছড়াতে পারে। তাই বাইরে থেকে এসে অবশ্যই সাবান পানি দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে যারা। হাসপাতাল বা ল্যাবরেটরিতে কাজ করেন, তারা হাত পরিষ্কার করতে এ্যালকোহল স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে পারেন। যেখানে- সেখানে প্রকাশ্যে থুঁতু-কফ ফেলা বন্ধ করার বিষয়ে সচেতনতা দরকার। হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় টিস্যু ব্যবহার করতে হবে, যা অবশ্যই একবার ব্যবহারের পরই ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে। হাত দিয়ে নাক মুখ চোখ স্পর্শ যত কম করা যায়, ততই ভাল। বিদেশ থেকে আসা কোন ব্যক্তি কাশি-জ্বরে আক্রান্ত হলে অন্তত ১৪ দিন তাকে বাড়িতে একটি আলাদা ঘরে রাখতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। চীনের বাইরে এ পর্যন্ত ১২টি দেশে নোভেল করোনা ভাইরাস ছড়ানোর তথ্য পাওয়া গেছে। নেপাল, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, নেপাল, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ৪১ ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে চীনের বাইরে এ রোগে মৃত্যুর কোন তথ্য এখনও আসেনি। এ ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের শহর উহান এবং আশপাশের কয়েকটি শহর কার্যত বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে গণপরিবহন। বেইজিংয়ে সব বড় উৎসব ও মন্দিরের মধ্যে মেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর ট্যুর আয়োজনের ওপর। শনিবার থেকে বন্ধ রাখা হয়েছে সাংহাইয়ের ডিজনিল্যান্ড। আর রবিবার থেকে চীনে সব ধরনের বন্যপ্রাণী বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কী করছে বাংলাদেশ চীনে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া নতুন ধরনের করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে বাংলাদেশেও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে এখনও কেউ শনাক্ত না হলেও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে বলেছে বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্যানার ব্যবহার করে দেখা হচ্ছে, যাত্রীদের কারও শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কি না। কোন যাত্রীর শরীরের তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রী ফারেনহাইটের বেশি পাওয়া গেলে তাকে প্রথমে বিমানবন্দরের পর্যবেক্ষণ কক্ষে রাখা হবে। পরে তাকে প্রয়োজনে কুর্মিটোলা হাসপাতালে স্থানান্তর করা হবে। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা তার শারীরিক অবস্থার তথ্য সংগ্রহে রাখবেন। যারা চীন থেকে আসবে, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্যের একটি হেলথ কার্ড পূরণ করতে হবে। ঢাকায় আসার পর সেটি বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য ডেস্কে জমা দিতে হবে। তাদের বলা হচ্ছে, আসার সময় জ্বর না থাকলেও চীন থেকে আসার ১৪ দিনের মধ্যে যদি জ্বর হয়, তাহলে যেন তারা যোগাযোগ করেন। ভাইরাসটির বিভিন্ন লক্ষণ সম্পর্কেও বিমানবন্দরে তথ্য দেয়া হয়েছে। বিমানবন্দরের স্বাস্থ্যকর্মীদের দেয়া হয়েছে প্রশিক্ষণ। রবিবার পর্যন্ত বিমানবন্দরে ২ হাজার ১৯০ জনকে পরীক্ষা করা হলেও কারও শরীরে করোনা ভাইরাস পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘বাংলাদেশে এখনও এ ভাইরাসে আক্রান্ত কোন রোগী শনাক্ত হয়নি। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর নজরদারি বাড়িয়েছে। আমরা নিবিড়ভাবে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা সতর্ক আছি এবং আমরা প্রস্তুতও আছি।’ তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার মনে করছেন, বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশের কারণে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি। ‘আমাদের দেশ জনবহুল। এছাড়া মানুষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে কম, রাস্তাঘাটে থুঁতু-কফ ফেলে। তাছাড়া বাংলাদেশে তাপমাত্রা-বাতাসের আর্দ্রতাও ভাইরাসের বংশবৃদ্ধির জন্য উপযোগী।’
×