ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয়

বিরূপ আবহাওয়ায় বোরোর বীজতলা নিয়ে শঙ্কিত চাষী

প্রকাশিত: ১০:১৭, ২৭ জানুয়ারি ২০২০

 বিরূপ আবহাওয়ায় বোরোর বীজতলা নিয়ে শঙ্কিত চাষী

কাওসার রহমান ॥ বিরূপ আবহাওয়ায় বোরোর বীজতলা নিয়ে চরম শঙ্কায় দিন কাটছে কৃষকদের। গ্রামে তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশায় এবার বোরোর বীজতলা ‘কোল্ড ইনজুরিতে’ আক্রান্ত হয়েছে। বীজতলাগুলো সবুজ থেকে ক্রমেই হলুদ হয়ে যাচ্ছে। ফলে আসন্ন বোরো আবাদ নিয়ে শঙ্কায় সারাদেশের চাষী। তাদের এই শঙ্কা কাটাতে বীজতলা নিয়মিত পরিচর্যাসহ নানা পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। স্থানীয় ভিত্তিতে কৃষি কর্মকর্তারা কোল্ড ইনজুরি থেকে বীজতলা রক্ষার জন্য ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও ব্যবহার করছেন। কিন্তু কুয়াশার তীব্রতা এতটাই বেশি যে এসব পরামর্শ অনেক ক্ষেত্রেই কাজে আসছে না। বিবর্ণ/নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বীজতলা। ফলে বীজ চারার সঙ্কটে এবার বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। মাঠ পর্যায় থেকে জানা যায়, প্রতিদিন বিকেল থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ঘন কুয়াশা বিরাজ করছে। মাঝরাতে এই কুয়াশা ‘বরফ শীতল’ হয়ে ঝরে পড়ছে। মাঝেমধ্যে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও হচ্ছে। দিনের অধিকাংশ সময়ই সূর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। এর প্রভাব পড়েছে বোরোর বীজতলাসহ চলতি রবিশস্যের ওপর। শীত মৌসুমের এই বিরূপ আবহাওয়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বোরোর বীজতলা। বীজতলার চারা হলুদ বর্ণ ধারণ করে মরে যাচ্ছে। এতে অনেক এলাকায় চাষীকে নতুন করে আবার বীজতলা তৈরির প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। এতে বোরো আবাদের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কৃষক দুশ্চিন্তায় পড়েছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ কোটি ৫ লাখ টন চালা আকারে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এজন্য বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৮ লাখ ৬৬ হাজার হেক্টর জমি। এই পরিমাণ জমিতে বোরো আবাদ করতে হলে ২ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি করা প্রয়োজন। কৃষকরা এর চেয়েও বেশি জমিতে বোরোর বীজতলা তৈরি করেছেন। কিন্তু এবারের দীর্ঘস্থায়ী ঘন কুয়াশা ও শীত তাদের বিপাকে ফেলে দিয়েছে। ফলে এবছর বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে তারা শঙ্কিত। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত বছরগুলোর চেয়ে এবার কুয়াশা বেশি। সাধারণত ঢাকা, বগুড়া, চট্টগ্রাম ও যশোর অঞ্চলে ডিসেম্বরে গড়ে ২২ দিন মধ্যরাত থেকে সকাল নয়টা পর্যন্ত কুয়াশা থাকে। আর জানুয়ারিতে থাকে ২৩ দিন। এবছর ডিসেম্বরে ২৩ দিন কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল। আর জানুয়ারির ১৬ দিনের মধ্যে ১৩ দিনই কুয়াশাচ্ছন্ন থেকেছে। দেশে প্রাকৃতিক কারণে কুয়াশা বাড়লেও ধোঁয়া ধুলায় তা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে এবার দেখা যাচ্ছে, দুই মাস ধরে সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে ঘন কুয়াশা নেমে আসছে। আর ওই কুয়াশা স্থায়ী হচ্ছে সকাল পার্যন্ত। শৈত্যপ্রবাহের সময়ে বিকেল চারটার পরই কুয়াশায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে সারাদেশ। আর রাত যত গভীর হচ্ছে কুয়াশার তীব্রতাও তত বাড়ছে। এবছর অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, ডিসেম্বর মাঝামাঝি টানা ছয় দিন উত্তরাঞ্চলে সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, ঘন কুয়াশা ও শীতের তীব্রতার কারণেই এবার বোরোর বীজতলা হলুদ বর্ণ ধারণ করছে। এর অর্থ হচ্ছে বীজতলা কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়েছে। এই অবস্থায় আমরা কৃষককে রাতে বীজতলায় পানি দিতে এবং বীজচারা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া শীত ও কুয়াশা থেকে বীজ চারা রক্ষার জন্য সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ করার জন্যও বলা হয়েছে। শীত বা কুয়াশা থেকে বোরো বীজতলা রক্ষার জন্য পলিথিন দিয়ে বীজতলা ঢেকে রাখা অথবা বীজতলায় সেচ দিয়ে চারাগাছের পাতা ও ডগা থেকে কুয়াশায় ঠা-া পানি ফেলে দিলে চারাগাছ বাঁচানো সম্ভব হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলছেন, যদি কোন বীজতলা কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয় তাহলে সেচ প্রদান এবং জিপসাম বা ইউরিয়া সার স্প্রের মাধ্যমে তা সারিয়ে তোলা যায়। আমাদের কর্মকর্তারা নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন করছেন, বিভিন্ন স্থানে বীজতলা পর্যবেক্ষণ করছেন। সেই সঙ্গে বীজতলা রক্ষায় কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন। শীত ও কুয়াশা থেকে বীজতলা রক্ষার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে নানা প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দেশের সব জেলায় কৃষকদের মাঝে কোল্ড ইনজুরি থেকে বীজতলা রক্ষার জন্য করণীয় সম্পর্কে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। আশা করছি, কৃষক বীজতলার ক্ষতি কাটিয়ে উঠবে এবং বোরো আবাদ ব্যাহত হবে না। সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। ঘন কুয়াশা ও অতিরিক্ত শীত থেকে বোরো বীজতলা রক্ষার লক্ষ্যে রূপসা উপজেলা কৃষি অফিসের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুর রহমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে সচেতন করছেন কৃষকদের। ফেসবুকে তিনি বলেছেন, চারা বৃদ্ধিতে নিম্ন তাপমাত্রার প্রভাব কমিয়ে আনার জন্য ঘন কুয়াশা ও বেশি শীতের সময়ে বোরো ধানের বীজতলা সকাল ১০টা থেকে সাদা পলিথিন শীট দিয়ে ঢেকে রেখে সন্ধ্যার পূর্বে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। এ ছাড়া সন্ধ্যায় পানি সেচ দিয়ে বীজতলার চারা ডুবিয়ে দিতে হবে এবং সকালে সেই পানি বের করে দিতে হবে। প্রতিদিন সকালে দড়ি টেনে দিয়ে বীজতলার চারায় জমাকৃত শিশির ঝরিয়ে দিতে হবে। বীজতলায় প্রতি শতকে ২০০ গ্রাম টিএসপি, ১৫০ গ্রাম এমওপি ও ৪০০ গ্রাম জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হবে। শৈত্য প্রবাহের কারণে বোরো ধানের বীজতলার চারা হলদে হয়ে গেলে প্রতি শতক জমিতে ২৮০ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া ১০ লিটার পানিতে ৬০ গ্রাম পটাশ ও ৬০ গ্রাম জিপসাম সার মিশিয়ে বীজতলায় স্প্রে করতে হবে। বীজতলার চারার গোড়া বা পাতাপচা রোগ দেখা গেলে ব্যাভিস্টিন বা মেনকোজেব গ্রুপের যে কোন একটি ছত্রাকনাশক প্রতিলিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। যতদিন শৈত্য প্রবাহ থাকে ততদিন এ পদ্ধতি চালিয়ে যেতে হবে।
×