ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পার্বতীপুর মধ্যপাড়া পাথর খনি আবার বন্ধের মুখে

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ২৫ জানুয়ারি ২০২০

পার্বতীপুর মধ্যপাড়া পাথর খনি আবার বন্ধের মুখে

স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর ॥ দেশের একমাত্র দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মধ্যপাড়া গ্রানাইট শিলা খনির বর্তমান ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জার্মানীয়া-ট্রেষ্ট কনসোর্টিয়ামের চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে আর ২৫ দিন বাকী। মধ্যপাড়া পাথর খনিটি যখন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জিটিসি’র হাতে প্রথমবারের মত লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, তখন এই লাভজনক প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুখে পড়তে যাচ্ছে। জিটিসি’র সাথে তাদের চুক্তির মেয়াদকালে বিভিন্ন জটিলতায় কাজ করতে না পারার দাবিকৃত বর্ধিত সময় ৪৭ মাস দেওয়া হবে না এবং নতুন করে খনির ঠিকাদার নিয়োগের ট্রেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পূর্ন না হওয়া পর্যন্ত জিটিসি তাদের উৎপাদন অব্যাহত রাখতে অনুমতি দেওয়া হবে কিনা? নাকি বড়পুকরিয়া কয়লা খনিতে কর্মরত চীনা কোম্পানী এক্সএমসি-সিএমসিকে এই অর্ন্তবর্তীকালীন সময়কালে নিয়োগ করা হবে? এমন প্রশ্ন উঠেছে এলাকায়। জানা গেছে, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে ইচ্ছাকৃত উৎপাদন বন্ধ রাখা ও প্রকল্প এলাকার উন্নয়ন কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ না করাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এক্সএমসি-সিএমসি কনসোর্টিয়ামের বিরুদ্ধে। পাথর খনির পাথর উত্তোলনের কাজ ডিরেক্ট পারভেজ ম্যাথড এ বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে কর্মরত সিএমসি-এক্সএমসি কনসোর্টিয়ামকে কার্যাদেশ দেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে অর্ন্তবর্তীকালীন সময়ের জন্য কাজ দেওয়া হবে এবং পরে দেওয়া হবে পুরো দায়িত্ব। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দেশের একমাত্র উৎপাদনশীল বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে বিতর্কিতভাবে টেন্ডারে কাজ পাওয়া এক্সএমসি-সিএমসি কনসোর্টিয়ামকে সর্বনিম্ন দরদাতাকে ডিঙ্গিয়ে কাজ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া তারা বড়পুকুরিয়ার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রতি টন কয়লা ৩৮ ডলারে চুক্তি করলেও বর্তমানে তারা ৯২ ডলারে নিচ্ছে। ফলে বড়পুকুরিয়া কয়লার উপর নির্ভর করে নির্মাণ করা পাশ্ববর্তী বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম ৩ গুণ বাড়াতে হয়েছে। উন্নত বিশ্বে কোথাও কয়লা উৎপাদনের জন্য কোনো ঠিকাদার টন প্রতি ৩০ ডলারের বেশী নিচ্ছে না। এছাড়া এই কোম্পানীর সময়েই বড়পুকুরিয়ায় ১ লাখ ৮৮ হাজার ৬শ’ ৪৪ টন কয়লা চুরির ঘটনা ঘটেছে। জিটিসি সুত্র জানায়, ২০১৩ সালে করা চুক্তি অনুযায়ী তারা ৬ বছর খনিতে কাজ করার কথা। কিন্তু পাথর খনি কর্তৃপক্ষ (এমজিএমসিএল) এর নানা প্রতিবন্ধকতা, প্রশাসনিক জটিলতা, ড্রয়িং-ডিজাইন অনুমোদন না করা এবং মালামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানীর অনুমতি না দিয়ে ৪৭ মাস কাজ না করিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছিল তাদের। এমনকি তাদের পাওনা পর্যন্ত আটকে রাখা হয়েছিল ৩ বছর। এ কারনে তারা নতুনভাবে আরও ৪৭ মাস সময় বাড়ানোর দাবী জানিয়েছে। এমজিএমসিএল তাতেও আপত্তি দেয়। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি নিস্পত্তির জন্য আরবিট্রেশন আদালতে মামলা করেছে জিটিসি। শুনানিতে জিটিসি দাবি করেছে, তারা এমজিএমসিএল এর অনীহার কারনে ৪৭ মাস খনিতে কাজ করতে পারেনি। তাছাড়া তাদের ২শ’ ৪০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। জিটিসি খনির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে খনিটিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে খনি উন্নয়ন ও নতুন স্টোপ নির্মানসহ পাথর উত্তোলনে শতাধিক বিদেশী খনি বিশেষজ্ঞ ৭ শতাধিক খনি শ্রমিক তিন শিফটে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে পাথর খনি থেকে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৫ হাজার টন পাথর উত্তোলন হচ্ছে যা খনির উৎপাদন ইতিহাসে সর্বোচ্চ নয়া রেকর্ড। খনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনা ওই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কযলা উত্তোলনের অভিজ্ঞতা থাকলেও তাদের পাথর উত্তোলনের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। আর বর্তমানে পাথর খনির ঠিকাদার বেলারুশিয়ান প্রতিষ্ঠান জিটিসি’র অধীনে কর্মরত বিদেশী বিশেষজ্ঞদের রয়েছে তাদের দেশে পাথর খনিতে কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা। চলমান খনিতে হুট করে নতুন কোনো কোম্পানীকে অর্ন্তবর্তীকালীন সময়ের জন্য কাজ দেওয়া খুবই বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত হবে। যদি এই মুহুর্তে দরপত্র আহবান করতে সময় লাগে কিংবা কোন ভালো কোম্পানী পাওয়া না যায় তাহলে বর্তমান কোম্পানীকেই চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে অর্ন্তবর্তীকালীন সময়ের জন্য রাখাটাই নিয়ম। খনির কাজে হুট করে অচেনা-অজানা কাউকে দায়িত্ব দেওয়া ঠিক হবে না। এই নিয়ে যদি কোনো ধরনের অঘটন কিংবা দূর্ঘটনা ঘটে তাহলে এর দায় দায়িত্ব কে নিবে? এছাড়া এই জিটসি’র সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ডের কারনেই প্রায় এক যুগ পর প্রথমবারের মতো লাভের মুখ দেখেছে দেশের একমাত্র এই গ্রানাইট শিলা খনিটি। পাথর খনি ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে মুনাফা করেছে ১১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। পেট্রোবাংলার এক রিপোর্টে জানা গেছে, চুক্তি শেষে যদি কোন কোম্পানীকে নিয়োগ দিতে হয় তাহলে আর্ন্তজাতিক দরপত্র আহবান করতে হবে। আর দরপত্র আহবানের আগে যদি অন্তবর্তীকালীন সময়ের জন্য কাউকে নিয়োগ দিতে হয় তাহলে বর্তমান কোম্পানীকেই দিতে হবে। এতে জবাবদিহিতা থাকবে। কোন ক্ষতি হলে জামানতের টাকা থেকে সমন্বয় করা যাবে। পাথর খনির একজন নির্ধারিত ডিলার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জিটিসি পাথর উত্তোলনে পারদর্শী তার প্রমান দিয়েছে তারা। আগে এই পাথর খনি পাথর শুণ্য ছিল। ছিল ক্রেতা শুন্য। জিটিসি পাথরে ফুল ফুটিয়েছে। এখন পাথরের ক্রেতাদের আগমন শত শত শ্রমিকের পদচারনায় মুখরিত থাকে পাথর খনি এলাকা। শুনছি কয়লা খনির চায়নীজ কোম্পানীকে এই খনির কাজ দেওয়া হচ্ছে। এটি হবে আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত। কারন চায়নাদের অধীনে কয়লা খনিতে কর্মরত শ্রমিকদের ধর্মঘট, কর্মবিরতি লেগেই থাকে। কিন্তু এখানে এই সব নাই। তাছাড়া চায়না তাদের দেশের শ্রমিক দিয়ে কাজ করায়। এতে করে এখানে কর্মরত শত শত শ্রমিক কর্মহারা হয়ে আবার বেকার হয়ে পড়বে। তাই উৎপাদনের দক্ষতার কথা বিচেনা করে জিটিসিতে আবারো খনির দায়িত্ব দেওয়া হলে মধ্যপাড়ার পাথর দেশের মেগা প্রকল্পগুলোতে ব্যবহার নিশ্চিত হবে এবং খনিটি প্রতি বছরেই লাভের মুখ দেখবে বলে খনি এলাকার সচেতন মানুষ মনে করে।
×