ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

উৎপাদন সম্ভব নয় জেনেও গ্যাস হাইড্রেট সমীক্ষার উদ্যোগ

প্রকাশিত: ১০:৩২, ২৫ জানুয়ারি ২০২০

  উৎপাদন সম্ভব নয় জেনেও গ্যাস হাইড্রেট সমীক্ষার উদ্যোগ

রশিদ মামুন ॥ সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অর্জন না থাকলেও গ্যাস হাইড্রেট বা মিথেন হাইড্রেট খুঁজে বের করতে সমীক্ষা শুরু করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মিথেন হাইড্রেট থেকে মিথেন বের করার প্রযুক্তি গত দেড় শ’ বছরেও আবিষ্কৃতই হয়নি। বঙ্গোপসাগরে মিথেন হাইড্রেট থাকলেও তা উত্তোলন করা সম্ভব নয়। এ ধরনের প্রকল্প শুধু অর্থ আর সময়ের অপচয় বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হাইড্রোগ্রাফি সেন্টার নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এজন্য চুক্তি করা হয়েছে। মূলত তারাই সমীক্ষাটি করে দেবে। আমাদের এখানে মিথেন হাইড্রেট রয়েছে কি না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে বঙ্গোপসাগরের ভারতের অংশে মিথেন হাইড্রেট পাওয়া গেছে। সঙ্গত কারণে আমাদের এখানেও মিথেন হাইড্রেট থাকতে পারে। জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা বলেন, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে অনেক আগেই পেট্রোবাংলাকে এ ধরনের প্রকল্প হাতে নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তখন পেট্রোবাংলার তরফ থেকে বলা হয়েছে ধরে নিলাম আমাদের সাগরে গ্যাস হাইড্রেট রয়েছে। তাকে কি ? যা তোলা সম্ভব নয়। তা থাকলেই বা কি আর না থাকলেই বা কি ? এ ধরনের প্রকল্পে সময় এবং অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু হবে না বলেই পেট্রোবাংলা এ ধরনের প্রকল্পতে রাজি হয়নি। তবে এর অনেকদিন পরে এসে এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গ্যাস হাইড্রেট খোঁজার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। গ্যাস হাইড্রেট বা মিথেন হাইড্রেট হচ্ছে চার অনু মিথেন এবং ২৩ অনু পানির সংমিশ্রণ। যা সাধারণত বরফ সাদৃশ্য। সাগরের পানির নির্দিষ্ট গভীরতা এবং চাপে মাটির নিচে এটি অবস্থান করে। প্রাকৃথিক গ্যাস যেমন উচ্চচাপে মাটির গভীরে শিলার ফাঁকা জায়গাতে জমা থাকে এটি তেমন নয়। প্রাকৃতিক গ্যাসের কূপ খনন করলে গ্যাস রয়েছে এমন এলাকা থেকে সহজেই ওপরে গ্যাস উঠে আসে। কিন্তু মিথেন হাইড্রেট থেকে কিভাবে গ্যাস তোলা সম্ভব এমন কোন প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব মেরিটাইস এ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব মোহাম্মাদ খোরশেদ আলম জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা জরিপ করছি। জরিপ কাজ শেষ না হলে এখনও কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে মিথেন হাইড্রেট তোলার এখনও কোন প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা এটা করে রাখলাম এটি হয়ত পরে কোনদিন কেউ না কেউ এসে অনুসন্ধান করবে। আর এখন প্রযুক্তি নেই বলেই যে ভবিষ্যতে কোনদিন আবিষ্কার হবে না তাতো নয়। ইউএসজিএস বলছে, গ্যাস হাইড্রেট সাধারণত উপমহাসাগরের পলির মধ্যে জমাট বাঁধে। এটি সাগরের অগভীর ও গভীর উভয় অঞ্চলের পাওয়া যেতে পারে। এ ধরনের গ্যাস সাধারণত সাগরের পানির নিচের চাপ ও তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে জমাট বেধে থাকে। গ্যাস হাইড্রেট হচ্ছে এক ধরনের স্বচ্ছ কঠিন অবস্থা। যা কিনা পানি ও গ্যাসের সমন্বয়ে গঠিত হয়। এটি দেখতে অনেকটা বরফের মতো। কিন্তু এটি প্রচুর পরিমাণে মিথেন বহন করে। এটি সাধারণ সাগরের একেবারে তলদেশে শত শত মিটারব্যাপী পলির নিচে প্রচুর পরিমাণ জমা হয়ে থাকতে পারে। সাধারণত মেরু এলাকায় এই জমাট বাঁধা গ্যাস হাইড্রেট পাওয়া যায়। তবে এ বিষয়ে আরও জানতে এখনও গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছে ইউএসজিএস। প্রাকৃতিক গ্যাস এবং মিথেন হাইড্রেটের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে নয় ধরনের উপাদান থাকে। এগুলো হচ্ছে মিথেন ৯৭ দশমিক ৩৩ ভাগ, ইথেন এক দশমিক ৭২ ভাগ, প্রোপেন শূন্য দশমিক ৩৫ ভাগ, এছাড়া উচ্চতর কার্বনের শিকল যুক্ত অংশ, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, হাইড্রোজেন সালফাইড ছাড়াও সামান্য পরিমাণে অন্যান্য পদার্থ থাকে। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ভূতাত্ত্বিক অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, এ ধরনের প্রকল্প করে শুধুমাত্র পরামর্শকদের টাকা আয়ের সুযোগ করে দেয়ার কোন অর্থ হয় না। তিনি বলেন, আমাদের সাগরে গ্যাস হাইড্রেট থাকার কোন সম্ভাবনা নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বঙ্গোপসাগরের ভারত অংশে গ্যাস হাইড্রেট পাওয়া গেছে সঙ্গত কারণে এখানেও থাকতে পারে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ভারত যেখান গ্যাস হাইড্রেট পেয়েছে তা আরো অনেক দক্ষিণে যেখানের প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাদের থেকে ভিন্নতর। তিনি জানান, আমেরিকা, কানাডা এমনকি জাপান গ্যাস হাইড্রেট তুলতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে গ্যাস হাইড্রেট থেকে মিথেন বের করে আনার কোন প্রযুক্তি এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। তিনি বলেন, যেখানে আসল কাজ তেল-গ্যাস অনুসন্ধানই হচ্ছে না সেখানে কেন অযথা গ্যাস হাইড্রেট খুঁজতে হবে। একই বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ভূ-তাত্ত্বিক অধ্যাপক হোসেন মনসুর বলেন, ধরে নেয়া হলো আমাদের সাগরে গ্যাস হাইড্রেট রয়েছে তাতে কি? পৃথিবীতে অনেক আগে থেকে অনেক জায়গাতেই গ্যাস হাইড্রেট রয়েছে। কিন্তু এসব তোলার কোন প্রযুক্তি গত দেড় শ’ বছর ধরে আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। কাজেই কোন কাজ করার আগে এর অর্থনৈতিক উপযোগিতা নির্ণয় করতে হবে। যারা এটি করছে তারা এই চিন্তাটি না করেই করছে বলে মনে করেন তিনি। পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, প্রকল্পটি এককভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হাতে নিয়েছে। এরসঙ্গে পেট্রোবাংলার তেমন কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। পেট্রোবাংলাকে মাঝে মাঝে শুধুমাত্র বিষয়গুলো জানানো হবে। জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি আমাদের নয়। তবে আমাদের জানানো হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ধরনের একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রসঙ্গত ছয় বছর আগে সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু এখনও সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে জ্বালানি বিভাগ।
×