ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সতর্ক থাকার পরামর্শ

ইতোমধ্যে দুজনের মৃত্যু, একজন আক্রান্ত ॥ নিপা ভাইরাস

প্রকাশিত: ১০:০৪, ২৫ জানুয়ারি ২০২০

  ইতোমধ্যে দুজনের মৃত্যু, একজন  আক্রান্ত ॥ নিপা ভাইরাস

নিখিল মানখিন ॥ নিপা ভাইরাসে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। চলতি মৌসুমে ইতোমধ্যে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। আরও একজন আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে খুলনায়। মৃত দু’জনের মধ্যে একজনের বাড়ি গাজীপুরে এবং অন্যজন মাদারীপুরের। সরকারের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এর বাইরে রাজধানীতে আরও দু’জন আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। এই রোগের নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই। উপসর্গ দেখে চিকিৎসা করাতে হয়। দেশে এ রোগে আক্রান্তদের মৃত্যুর হার শতকরা ৮৯ ভাগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকে। নিপা একটি ভাইরাসজনিত মারাত্মক রোগ, যা বাদুড় থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। আবার আক্রান্ত মানুষ থেকে মানুষেও সংক্রমিত হতে পারে। বাদুড়ে খাওয়া কাঁচা খেজুরের রস খেয়ে ওই সময় নিপা ভাইরাস আক্রান্ত হয় অনেক মানুষ। এ বছর ইতোমধ্যে খেজুরের রস সংগ্রহ শুরু হয়ে গেছে। সাবধানতা অবলম্বন না করলে নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাবে না। কাঁচা খেজুরের রস এবং বাদুড় খাওয়া ফলমূলের অংশ বিশেষ না খাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আইইডিসিআর’র পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা জনকণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশে নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নতুন ঘটনা নয়। চলতি বছর এ পর্যন্ত নিপা ভাইরাস আক্রান্ত তিনজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। অন্যজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চলতি বছর এ পর্যন্ত তাদের কাছে সারাদেশ থেকে ১০৪ নমুনা পাঠানো হয়েছে। সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনজনের আক্রান্তে বিষয় শনাক্ত করা হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে অন্যগুলোর বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা যাবে বলে জানান পরিচালক। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রতি বছরই কিছু লোক নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও চিকিৎসকরা খেজুরের রস খাওয়ার ক্ষেত্রে সাবধান হওয়ার পরামর্শ দেয়া ছাড়া এ রোগ প্রতিরোধে কার্যকর কিছু করতে পারেননি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ভাইরাস ছড়ায় মূলত বাদুড়ের মাধ্যমে। শীতের সময় খেজুর গাছে বাঁধা রসের হাড়িতে বাদুড় মুখ দেয়। বাংলাদেশে এভাবেই রোগটি মানুষে ছড়ায় বলে চিকিৎসকদের ধারণা। এ রোগে আক্রান্তদের মস্তিস্কে তীব্র প্রদাহ দেখা দেয়। নিপা একটি ভাইরাসজনিত মারাত্মক রোগ, যা বাদুড় থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। এর প্রধান লক্ষ্মণগুলো হচ্ছে- জ্বর সহ মাথাব্যথা, খিঁচুনি, প্রলাপ বকা, অজ্ঞান হওয়াসহ কোন কোনো ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট। চিকিৎসকরা জানান, বাংলাদেশে সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এই সময়টাতেই খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। আর বাদুড় গাছে বাঁধা হাড়ি থেকে রস খাওয়ার চেষ্টা করে বলে ওই রসের সঙ্গে তাদের লালা মিশে যায়। আর সেই বাদুড় নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে এবং সেই রস খেলে মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে এ ভাইরাস। আক্রান্ত মানুষ থেকে মানুষেও ছড়াতে পারে এ রোগ। জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীরা এক পর্যায়ে সংজ্ঞা হারাচ্ছেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে, বিশ্বে ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ায় সর্বপ্রথম নিপা ভইরাস শনাক্ত করা হয়। তবে বর্তমানে বাংলাদেশকে এ রোগের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বিবেচনা করা হয়। ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত মেহেরপুর, নওগাঁ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ ও রংপুরে মানবদেহে নিপা ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। ২০০১ সালে দেশের উত্তর জনপদের সীমান্ত এলাকায় প্রথমবারের মতো নিপা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০১ সাল থেকে ২০২০ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩১৯ নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ২২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিপা ভাইরাস এতটাই সংক্রামক যে, ২০০৪ সালে ফরিদপুরে এক পরিবারের একজন আক্রান্ত হওয়ার পর ওই পরিবারের চারজনের মৃত্যু হয় এ রোগে। এক রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তার রিক্সাচালকও নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। ২০১২ সালে এ রোগে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আর ২০১৫ সালে দেশের পঞ্চগড়, নীলফামারী, ফরিদপুর, মাগুরা, নওগাঁ ও রাজবাড়ীতে আক্রান্ত ৯ জনের মধ্যে ৬ জনেরই মৃত্যু ঘটে। আইইডিসিআর-এর সাবেক পরিচালক ডাঃ মাহমুদুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, এ রোগটি অনেকটা ছোঁয়াচে হতে পারে। রোগীদের সংস্পর্শে যাওয়া ঠিক হবে না। কাঁচা খেজুরের রস এবং বাদুড় খাওয়া ফলমূলের অংশ বিশেষ না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ডাঃ মাহমুদুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, বলতে গেলে রোগটি পুরোপুরি ছোঁয়াচে। এ জ্বরে আক্রান্তকে জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে নিতে হবে। আর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এন্টিভাইরাস ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে রোগীকে আইসিইউ’তে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। রোগীর লালা, কফ-কাশি এমনটিক কাপড়-চোপড়ের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কাঁচা খেজুরের রস এবং বাদুড় খাওয়া ফলমূলের অংশ বিশেষ খাওয়া ঠিক হবে না বলে তিনি জানান।
×