ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলি

প্রকাশিত: ০৮:২৪, ২৫ জানুয়ারি ২০২০

 ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলি

(গতকালের পর) ২০ জানুয়ারি উনসত্তরের গণআন্দোলনের ইতিহাসে মাইলফলক। এদিন ১১ দফার দাবিতে ঢাকাসহ প্রদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। সভাপতির আসন থেকে বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করি, বটতলার পরিসর সমাবেশের তুলনায় ছোট! প্রথম দিন শুরু করেছিলাম ’শ পাঁচেক নিয়ে, আজ কয়েক সহস্র, যেন জনসমুদ্র। যখন সভাপতির ভাষণ দিচ্ছি তখনও দলে দলে মানুষ আসছে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষণা দিয়ে বলি, ‘যতদিন আগরতলা মামলার ষাড়যন্ত্রিক কার্যকলাপ ধ্বংস করে শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীকে মুক্ত করতে না পারব, ততদিন আন্দোলন চলবে। স্বৈরশাসক আইয়ুব-মোনায়েম শাহীর পতন না ঘটিয়ে বাংলার ছাত্রসমাজ ঘরে ফিরবে না।’ মুহূর্তে ফুঁসে উঠল মিছিল! কোথায় গেল ১৪৪ ধারা! লাখ মানুষের ঢল রাজপথে। আমরা ছিলাম মিছিলের মাঝে। মিছিল যখন আগের কলাভবনের (বর্তমান মেডিকেল কলেজ) সামনে তখনই গুলিবর্ষণ শুরু হয়। খালেদ মোহাম্মদ আলী, আসাদুজ্জামান ও আমি, আমরা তিনজন একসঙ্গে ছিলাম। আমাদের লক্ষ্য করেই এক পুলিশ ইন্সপেক্টর গুলি ছোঁড়ে। গুলি আসাদুজ্জামানের বুকে বিদ্ধ হয়। আমি আর খালেদ আসাদকে মেডিকেল কলেজে নেওয়ার পথে আমাদের হাতের উপরেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। একজন শহীদের শেষ নিঃশ্বাসটি আমি স্পষ্ট শুনতে পাই। মেডিকেলের সিঁড়িতে আসাদের লাশ রাখা হয়। তাঁর গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত শার্টটি সংগ্রামের পতাকা করে আকাশে উড়িয়ে, আসাদের রক্ত ছুঁয়ে শপথ গ্রহণ করে সমস্বরে বলি, ‘আসাদ তুমি চলে গেছ। তুমি আর ফিরবে না আমাদের কাছে। তোমার রক্ত ছুঁয়ে শপথ করছি, আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’ এরপর শহীদ মিনার চত্বর থেকে শহীদ আসাদের মৃত্যুর খবর ঘোষণা করি বিক্ষুব্ধ শোকার্ত জনতার মাঝে। আসাদের রক্তাক্ত শার্ট সামনে রেখে সমাবেশের উদ্দেশে বক্তৃতায় বলি, ‘আসাদের এই রক্ত আমরা বৃথা যেতে দেব না।’ আমাদের সত্তা ও অস্তিত্ব আসাদের রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। শহীদ মিনার থেকে শুরু হয় শোক মিছিল। সকলের সামনে আমি এবং অন্যান্য ছাত্র নেতৃবৃন্দ। শোকমিছিলে হাজার হাজার মহিলা, গৃহবধূ, তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমিক, কর্মচারী অংশগ্রহণ করে। শোক মিছিল মুহূর্তেই লাখো মানুষের বিক্ষোভ মিছিলে পরিণত হলো। শোক মিছিলের সন্মুখভাগ যখন তিন নেতার সমাধি সৌধের কাছে, তখন মাইকে পুলিশ ও ইপিআর-এর কণ্ঠস্বর ‘ডোন্ট ক্রস, ডেঞ্জার-ডেঞ্জার, ডোন্ট ক্রস!’ কিন্তু শোক মিছিল শোকে আর ক্ষোভে উত্তাল। ডেঞ্জার শব্দের কোন মূল্যই নেই সেই মিছিলের কাছে। ডেঞ্জার ক্রস করে রক্তাক্ত লাল পতাকা নিয়ে পল্টনে পৌঁছাই আমরা। পল্টনে ঠাঁই নেই। লোকে লোকারণ্য। সবকিছুই অনির্ধারিত। মঞ্চ বা মাইক কিছুই নেই। সবাই চায় সংগ্রামের কর্মসূচী। সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার পর ২১ জানুয়ারি অর্ধদিবস হরতাল এবং হরতালের পর পল্টনে সমাবেশের কর্মসূচী ঘোষণা করি। ২১ জানুয়ারি পূর্বঘোষিত হরতালের কর্মসূচী পালনকালে চারদিক থেকে স্রোতের মতো মানুষের ঢল নামে পল্টন ময়দানে। এদিনও মাইক, মঞ্চ কিছুই ছিল না। পল্টনে চারাগাছের ইটের বেষ্টনীর ওপর দাঁড়িয়ে আমাকে বক্তব্য রাখতে হয়। বক্তৃতার পর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে তিনদিনের কর্মসূচী ঘোষণা করি : ২২ জানুয়ারি শোক মিছিল, কালো ব্যাজ ধারণ, কালো পতাকা উত্তোলন। ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মশাল মিছিল, পরে কালো পতাকাসহ শোক মিছিল। ২৪ জানুয়ারি দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল। এরপর মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী, আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তৎকালীন ন্যাপ নেতা, পরে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর মহিউদ্দীন আহমদ ও কারগারের বাইরে থাকা নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ২২ জানুয়ারি, ঢাকা নগরীতে আমি এমন কোন বাঙালী দেখিনি যাঁর বুকে কালো ব্যাজ নেই। বাড়িতে, অফিসে সর্বত্রই কালো পতাকা উড়ছে। একমাত্র ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া ঘৃণা প্রকাশের এই প্রতীকী প্রতিবাদ ছিল সর্বত্র। ২৩ জানুয়ারি, শহরের সমস্ত অলিগলি থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বের হয় মশাল মিছিল। ঢাকা পরিণত হয় মশালের নগরীতে। সে-এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। ২৪ জানুয়ারি, সর্বাত্মক অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়। সকলের তখন একই প্রশ্ন, ‘শেখ মুজিব কবে মুক্তি পাবে’ (তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধি পাননি)? ‘কবে আগরতলা মামলা তুলে নেওয়া হবে?’ ‘যদি সরকার না মানে তাহলে?’ ‘এমন সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে যেন আমরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে তাঁকে মুক্ত করে নিয়ে আসতে পারি।’ ‘এখনই আমাদের তুমুল সংগ্রাম শুরু করা উচিত যেন আইয়ুবের পতন ঘটে।’ ‘আইয়ুব-মোনায়েমের পতন না হলে শেখ মুজিব মুক্তি পাবে না।’ ঢাকা শহরের সর্বত্র এ ধরনের আলোচনাই চলছিল। হরতালের পরও মিছিলের বিরাম নেই। ডাকসু ভিপি হিসেবে আমার স্কন্ধে তখন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক, মুখপাত্র ও আহ্বায়কের দায়িত্ব। সমগ্র বাংলাদেশ সংগ্রামের বিস্ফোরণে প্রকম্পিত, অগ্নিগর্ভ। জনরোষ নিয়ন্ত্রণ করে নিয়মতান্ত্রিকতা বজায় রাখা যে কত কঠিন সেদিন তা মর্মে মর্মে অনুভব করেছি। হরতাল চলাকালে একজন মন্ত্রীর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। কিছুক্ষণের মধ্যে ইপিআর এবং পুলিশ মরিয়া হয়ে ওঠে বিক্ষোভ দমনে। যত্রতত্র গুলি চালাতে থাকে। সে গুলিতেই নিহত হয়ে শহীদদের তালিকায় যুক্ত হয় মতিউর, মকবুল, আনোয়ার, রুস্তম, মিলন, আলমগীরসহ আরও অনেক নাম। ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর রহমানের লাশ নিয়ে আমরা পল্টনে যাই। তখনই শুনতে পাই মোনায়েম খান শহরের নিয়ন্ত্রণ ভার ছেড়ে দেবে সেনাবাহিনীর হাতে এবং অচিরেই কারফিউ জারি হবে। আমরা পল্টন থেকে ইকবাল হলে এলাম মতিউরের লাশ নিয়ে। মতিউরের পকেটে এক টুকরো কাগজে নাম-ঠিকানাসহ লেখা ছিল, ‘মা-গো, মিছিলে যাচ্ছি। যদি ফিরে না আসি মা, মনে কর তোমার ছেলে বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য, শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য জীবন দিয়েছে। ইতি- মতিউর রহমান, ১০ম শ্রেণী, নবকুমার ইনস্টিটিউট। পিতা- আজহারউদ্দীন মল্লিক, ন্যাশনাল ব্যাংক কলোনি, মতিঝিল।’ কারফিউর মধ্যেই আমরা মতিউরের লাশ নিয়ে গেলাম ন্যাশনাল ব্যাংক কলোনিতে। শোক বিহ্বলতা ভেঙে স্বাভাবিক হয়ে, মতিউরের মা আঁচলে চোখ মুছে বললেন, ‘আমার ছেলে চলে গেছে দুঃখ নেই! আজ থেকে তুমি আমার ছেলে। মনে রেখ, যে জন্য আমার ছেলে রক্ত দিয়েছে, সেই রক্ত যেন বৃথা না যায়।’ সেদিন শহীদ মতিউরের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে দেইনি। ঢাকা শহরের বিবেক নড়ে উঠেছিল। কারফিউ কোথায়? রাজপথে বিক্ষুব্ধ মানুষের ভয়াল গর্জন আর সরকারী ভবনগুলো এবং ‘দৈনিক পাকিস্তান’, ‘মর্নিং নিউজ’ এবং ‘পয়গাম’ পত্রিকা অফিস তখন আগুনে জ্বলছে। বিক্ষুব্ধ জনতা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় আগরতলা মামলার প্রধান বিচারপতি এস রহমান, নবাব হাসান আসকারীর বাড়ি এবং রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধকারী খাজা শাহাবুদ্দীনসহ আরও কয়েক মন্ত্রীর বাসভবন। ঊনসত্তরের ২৪ জানুয়ারি প্রবল গণআন্দোলন-গণবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে ঢাকা নগরীর মানুষ রাজপথে নেমে এসে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করল। বাংলাদেশে বহু আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু ১৭ থেকে ২৪ জানুয়ারি-মাত্র ৭ দিনের মধ্যে নিরস্ত্র বাঙালী জাতি এক কাতারে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঐতিহাসিক যে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করেছিল তা আজও স্মৃতির পাতায় অম্লান। কারফিউর মধ্যে একদিনও থেমে থাকেনি আমাদের সংগ্রাম। দেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানী প্রশাসন বর্জন করেছে। কল-কারখানা, অফিস-আদালত, সচিবালয় সর্বত্র প্রশাসন ভেঙ্গে পড়েছে। পুলিশ দ্বিধাগ্রস্ত। সরকারী কর্মকর্তাগণ জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সিদ্ধান্তের জন্য ধর্ণা দিতেন ইকবাল হলে। কিছুদিনের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দফতর তথা ইকবাল হলের ৩১৩ নম্বর কক্ষ। ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা ১১ দফার প্রতি ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীসহ বাংলার সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন আদায় করতে পেরেছিলাম। কারণ আমাদের সময়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভেদ থাকলেও নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল মধুর। যে ৪টি ছাত্রসংগঠন একত্রিত হয়ে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন করে জাতির সামনে ১১-দফা দাবি পেশ করেছিলাম তাদের মধ্যে মত ও পথের পার্থক্য সত্ত্বেও একই টেবিলে বসে আমরা ১১ দফা দাবি প্রণয়ন করেছি। নিজেদের মধ্যে ঐক্যের দিকগুলো প্রাধান্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছি। ছাত্রসমাজের সাধারণ সমস্যাগুলো সামনে নিয়ে এসেছি। সকলের চিন্তাধারাকে সমন্বিত করেছি। ৬ দফা সকলে সমর্থন করত না। ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ ৬ দফা সমর্থন করত না। অপরদিকে ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপ ৬ দফা সমর্থন করত। আবার উভয় গ্রুপই বঙ্গবন্ধুর মুক্তির প্রশ্নে এককভাবে তাঁর নাম দিতে রাজি হয়নি। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতেই আন্দোলন কেন্দ্রিভূত হয়েছে, গতিশীলতা লাভ করেছে। দেশব্যাপী এমন একটি জনসমর্থিত তুমুল গণআন্দোলন সংগঠিত করতে পেরেছিলাম কেবল মানুষের সুবিপুল আস্থা আর বিশ্বাস আমাদের ওপর ছিল বলেই। আমরা মানুষের বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়েছি। ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে শপথ দিবসে সেøাগান দিয়েছিলাম ‘শপথ নিলাম শপথ নিলাম মুজিব তোমায় মুক্ত করব; শপথ নিলাম শপথ নিলাম মা-গো তোমায় মুক্ত করব।’ ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে পল্টনের মহসমুদ্রে প্রিয় নেতা শেখ মুজিবসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক সকলের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম প্রদান করি। সমগ্র দেশ গণবিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়। জনরোষের ভয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান সকল রাজবন্দীকে বিনা শর্তে মুক্তি দিলে দেশজুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। প্রিয় নেতাকে কারামুক্ত করার মধ্য দিয়ে শপথ দিবসের সেøাগানের প্রথম অংশ ‘মুজিব তোমায় মুক্ত করব’, এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে হাতিয়ার তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে প্রিয় মাতৃভূমিকে হানাদার মুক্ত করে স্লোগানের দ্বিতীয় অংশ ‘মা-গো তোমায় মুক্ত করব’ বাস্তবায়ন করেছিলাম। ২০২০ সাল জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী। ১০ জানুয়ারি থেকে ক্ষণ গণনা শুরু হয়েছে। ‘মুজিববর্ষ’ পালন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর জীবনে প্রতিটি অধ্যায় যথাযথ মর্যাদায় ঐতিহাসিকভাবে তুলে ধরা জরুরী। আমরা ইতিহাস বিকৃতির কথা বলি, কারণ একদা ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টা হয়েছিল। আগামীতে কেউ যাতে ইতিহাস বিকৃতির প্রশ্ন তুলতে না পারে, সেই কারণেই ’৪৮ ও ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর ১১ দফা আন্দোলন, ’৭০-এর নির্বাচন এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করলেও ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা যেভাবে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে, সেগুলো আমাদের জাতীয় মুক্তির ইতিহাসের পাতায় পাতায় যথাযথ গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। ২০ জানুয়ারি আসাদের রক্তের মধ্য দিয়ে যে আন্দোলন রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল, সে আন্দোলনের সফল পরিণতি-বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেওয়ার আইয়ুব খানের ষাড়যন্ত্রিক পরিকল্পনাকে বানচাল করে ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্তভাবে ফাঁসির মঞ্চ থেকে মুক্ত করে ২৩ ফেব্রুয়ারি ১০ লক্ষাধিক লোকের বিশাল জনসমুদ্রে গণসংবর্ধনা দিয়ে কৃতজ্ঞ বাঙালী জাতি কৃতজ্ঞ চিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। সেই সভায় দাঁড়িয়ে জনসমুদ্রের উদ্দেশে স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কৃতজ্ঞচিত্তে তিনি বলেছিলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, তোমরা যারা রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছ, যদি কোনদিন পারি নিজের রক্ত দিয়ে আমি সেই রক্তের ঋণ শোধ করে যাব।’ তিনি একা রক্ত দেননি, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে রক্ত দিয়ে বাঙালী জাতির রক্তের ঋণ তিনি শোধ করে গেছেন। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও কর্মসূচী নিয়ে জাতির পিতা সংগ্রামের পথে এগিয়ে ছিলেন। তাঁর দুটি লক্ষ্য ছিল-এক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা; দুই, ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা কায়েম করা। একটি তিনি সফলভাবে সমাপ্ত করেছেন। দ্বিতীয়টি তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা বাংলার মানুষের গণরায় নিয়ে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়ে দক্ষতা, সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করে চলেছেন। আজ ভাবতে ভালো লাগে, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের যে রক্তঝরা পথ ধরে আজকের এই স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, সে-সব কিছু অর্জনের ড্রেস রিহার্সাল ’৬৯-এর মহান গণঅভ্যুত্থান-যা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে এবং থাকবে চিরদিন। (সমাপ্ত) লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় সংসদ। [email protected]
×