অনলাইন ডেস্ক ॥ "আমি সমকামী হিসেবেই জন্ম নিয়েছিলাম। এটি আমি নিজে পছন্দ করে নেইনি। জীবনের বেশির ভাগ সময়ই এটি আশা করেছি যে আমি যদি বাকী সবার হতো হতাম (বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ), বলছিলেন রিভারেন্ড স্ট্যানলি আন্ডারহিল।
অনেক অল্প বয়সেই তিনি অনুধাবন করেন যে তিনি ঠিক তার বয়সী অন্যদের মতো না।
"আমি আমার ভাইকেও ২০১৮ সালে বই লেখার আগ পর্যন্ত বলিনি যে আমি সমকামী," তিনি বিবিসিকে বলেন।
এই সময় তার বয়স ছিলো ৯১ এবং তার ভাই তার চেয়ে দু বছরের ছোটো।
"এবং সে খুব একটা উদ্বিগ্ন হয়নি। আমি যদি তাকে ও আমার পরিবারকে আগেই বলতে পারতাম। অবশ্য আমি জানিনা তারা বিষয়টা তখন কিভাবে নিতো"।
নিজের আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন যে তিনি বড় হয়েছেন একটি সমস্যাসঙ্কুল ও অসহিষ্ণু পরিবেশে যেখানে দারিদ্রতা, শ্রেণী বৈষম্য আর মতামত চাপিয়ে দেয়াটাই ছিলো স্বাভাবিক চিত্র।
এসব কারণে তিনি যখন প্রাপ্তবয়স্ক হন তখন নিজেকে অন্যদের মতো বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ আছে এমন একজন হিসেবেই উপস্থাপন করেন।
তার জন্মের মাত্র নয় বছর আগে ১৯১৮ সালে ইংল্যান্ডে ভোটাধিকার পায় নারীরা।
তবে সমকামী হওয়াটা ছিল বেআইনি ও এটিকে 'ঈশ্বরকে অসম্মানে'র সাথে তুলনা করা হতো।
ফলশ্রুতিতে অন্য অনেকের মতো আন্ডারহিলও তার সেস্কুয়ালিটি বা যৌন বৈশিষ্ট্য গোপন করেন।
"আমি সচেতনভাবেই নিজের সত্ত্বাকে দমন করি - নিজের ও ঈশ্বরসহ সবার কাছে"।
নিজের সাথে সংগ্রাম
শৈশবে আন্ডারহিল খুবই নার্ভাস ধরনের ব্যক্তি ছিলেন এবং তার অভিভাবক ছিলেন অনেক রক্ষণশীল।
সেখানে নিজের সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না বললেই চলে।
"আমি জানতাম না আমি কে। কিন্তু তাদের বলতে পারতামনা । আপনি জানেন যে হোমোসেক্সুয়াল শব্দটাই ডিকশনারিতে ছিল না"।
তার বাবা একটি কারখানায় কাজ করতেন যেখানে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরি করা হতো কিন্তু তার বেতন ছিল খুব কম।
বাবার সাথে তার সম্পর্ক ছিল অনেকটা নির্দেশনা বা আদেশ নিষেধ শোনার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
"আমার ধারণা তিনি আমাদের পছন্দ করতেন না। অবশ্য তিনি বলেননি তিনি কেন এমন ছিলেন"।
মায়ের সাথেও তার ঠিক স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল না
আরও ভয়াবহ হলো স্কুলে প্রায়শই তাকে টিটকারি বা হয়রানির শিকার হতে হতো।
আন্ডারহিলকে ডাকা হয় তার চিকিৎসার জন্য কিন্তু তিনি সেখানে অনেক রক্ত দেখে অজ্ঞান হয়ে যান।
পরে অ্যালেক্স নামক একজনকে ডাকা হয় তার শুশ্রূষার জন্য।
প্রেমে পড়া
"চোখে খুলেই দেখলাম অ্যালেক্স আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা বলছিলেন তিনি। আমি শুনিনি কি বলেছেন। কিন্তু আমি তার প্রেমে পড়লাম"।
১৯৪৮ সালে নেভিতে তার চাকরী শেষে তিনি অ্যালেক্সের বাবার কাছ থেকে বেতনহীন হিসাব রক্ষকের ক্লার্ক হিসেবে কাজের অফার পেলাম।
"অ্যালেক্সের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল চমৎকার। মনে হয়নি যে আইন ভঙ্গ করেছি বা এটি কোনো অস্বাভাবিক বিষয়"।
কিন্তু আন্ডারহিল যখন অ্যালেক্সের সাথে এক সাথেই থাকতে চাইলে তখন তিনি বুঝতে পারলেন যে এটি অগ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
অ্যালেক্সের বাবা তাকে কাজ ছেড়ে দিয়ে নিজের পথ দেখতে বললেন।
আবার অ্যালেক্সের মধ্যেও পরিবর্তন দেখা গেলো।
"সেই প্রথম উপসংহারে আসে যে আমার সাথে তার সম্পর্ক ছিল একটা পাপ"।
আন্ডারহিলের সাথে সম্পর্ক থাকা অবস্থাতেই এক নারীর সাথে প্রেম শুরু করে অ্যালেক্স।
শেষ পর্যন্ত ১৯৫২ সালে সে তার গার্লফ্রেন্ডকে বিয়ে করে।
বিষণ্ণতা
"এটা ছিলো খুবই কষ্টের। এটা প্রত্যাখ্যানের চেয়ে বড় কিছু ছিল। আমাকে নৈরাজ্যের মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছিল"।
অ্যালেক্স এরপর গে কনভারসেশন থেরাপির পরামর্শ দেয়।
এক সকালে সে একদল বন্ধুকে ডাকে এবং তার হাতের ওপর হাত রেখে প্রার্থনা করতে বলে।
"সে ঈশ্বরকে বলছিল আমার ভেতরে থাকা দৈত্যকে বের করে নিতে এবং সমকামী অনুভব থেকে আমাকে মুক্তি দিতে"।
কিন্তু এর ফল ছিল একটা বিপর্যয়।
"আমার খুবই খারাপ অনুভূতি হতে লাগলো যা আগে কোনদিন হয়নি। আমি চিকিৎসকের কাছে গিয়ে বললাম এ বিশ্বের জন্য আমি ভালো নই"।
এরপর তিনি বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হন ও তার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়।
এমনকি তাকে ইলেক্ট্রো শপ থেরাপিও দিতে হয়।
আন্ডারহিল নিজের সঙ্গে অনেক লড়াই করেছেন। এমনকি রাস্তাঘাটে তরুণদের দিকে তাকানো বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
নিজের যৌন আচরণ পরিবর্তনে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন কিন্তু পারেননি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছেন কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি।
তিনি তার বাড়ি বিক্রি করে কিছু সময়ের জন্য মায়ের কাছে ফিরে যান।
১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে সমকামিতাকে অপরাধের সংজ্ঞার বাইরে আনা হয়।
এমনকি এখনও ৬৮টি দেশে সমকামিতাকে কিছু মাত্রায় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
এর অর্ধেকই একসময় ব্রিটিশ উপনিবেশের মধ্যে ছিলো।
আন্ডারহিলকে টেস্টসটেরন হরমোনাল ইনজেকশনও নিতে হয়।
কিন্তু এটি তার যৌন বিষণ্ণতাই বাড়িয়ে দিয়েছিলো কেবল।
পরে তিনি লন্ডনে চলে যান এবং সেখানে তিনি বহু সমকামী ব্যক্তিকে খুঁজে পান এবং আন্ডারহিল তাদের সাথে একটি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তৈরি করতে কঠিন পরিশ্রম করেন।
"আমি ভালোবাসা পেয়েছি এবং কিছু পুরুষের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো কিন্তু এগুলো বিকশিত হতে পারেনি প্রতিকূল পরিবেশের জন্য"।
পরে তিনি একটি অ্যাকাউন্টেন্সি ফার্ম এর অংশীদার হন এবং সেখানেও তার সেক্সুয়ালিটি একটি ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়।
"তারা প্রতি পদক্ষেপে আমাকে নিয়ে উপহাস করতো কারণ আমি একজন সমকামী। সে কারণে সেখান থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই এবং ধর্মযাজক হওয়ার দীর্ঘদিনের স্বপ্নের দিকে মনোযোগী হই"।
আন্ডারহিল ভুল ব্যাখ্যাকেই সব সমস্যার মূল বলে মনে করেন।
তিনি সানডে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই যিশুকে রোল মডেল মনে করেন।
রেডিওতে যিশুর জীবন ভিত্তিক নাটক তাকে বেশ প্রভাবিত করেছিলো।
"আমি তাকেই জীবনের গাইড হওয়ার জন্য চেয়েছিলাম"।
যখন তার বয়স ৫০, তার এই গাইডের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে ওঠে তার এবং তিনি যোগ দেন সোসাইটি অফ সেইন্ট ফ্রান্সিস-এ।
সূত্র- বিবিসি বাংলা
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: