ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নির্বাচনী পোস্টারে দন্ডিত খালেদার ছবি, নানা প্রশ্ন

প্রকাশিত: ১০:৩৮, ২৩ জানুয়ারি ২০২০

  নির্বাচনী পোস্টারে দন্ডিত খালেদার  ছবি, নানা প্রশ্ন

ওয়াজেদ হীরা ॥ ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ‘দন্ডিত’ ব্যক্তি দলীয় প্রধান হলেও তার ছবি ভোটের পোস্টারে ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ছবি ব্যবহার কেন্দ্র করেই উঠেছে এই প্রশ্ন। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ বিষয়টিকে ন্যায়নীতি বিবর্জিত কাজ বলেও মনে করছেন। এর মাধ্যমে অপরাধীকে উৎসাহ দিয়ে মূলত অপরাধকেই প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন। তাই এ বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও পদক্ষেপ নির্বাচন কমিশনের নেয়া উচিত বলে মনে করছেন নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্টজনরা। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ফৌজদারি অপরাধে দুই বছরের সাজা পেলে এবং মুক্তির ৫ বছর অতিবাহিত না হলে নির্বাচনে অংশ নেয়ার অধিকার হারান দন্ডিত ব্যক্তি। বর্তমানে দুর্নীতির দায়ে দন্ডিত হয়ে কারাভোগ করছেন বর্তমান বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। আর চলতি ঢাকা সিটি নির্বাচনে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণে বিএনপি প্রার্থীদের পোস্টারে দলীয় প্রধান হিসেবে দন্ডিত ব্যক্তি খালেদা জিয়ার ছবিও প্রচারের অংশ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। বিএনপির প্রার্থীদের প্রচারের এই পোস্টারে ছেয়ে গেছে ঢাকা শহর। সেই সঙ্গে কারাভোগ করা দন্ডিত ব্যক্তি খালেদা জিয়ার ছবিতেও সয়লাব শহর। বিষয়টি নিয়ে ভোটারদের মধ্যেও চলছে নানা ধরনের কানাঘুষা। সবচেয়ে বেশি কানাঘুষা করছেন এই প্রজন্মের তরুণরা। এছাড়াও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারাও মনে করছেন এই ধরনের বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত এখন সময়ের দাবি। বিভিন্ন দলের নেতাদের পাশাপাশি বিশিষ্টজনরা মনে করছেন, আইন সংশোধনের মাধ্যমে দ-িত যে কোন ব্যক্তির কোন নাম ছবি যেন নির্বাচনের মতো জনসম্পৃক্ত কাজে ব্যবহার না হয় তা যে দলেরই হোক। এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত দেয়া সময়ের দাবি। দেশের সিটি কর্পোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা ২০১৬ অনুযায়ী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পোস্টারে প্রতীক, প্রার্থী ও দলীয় প্রধানের ছবি ছাড়া অন্য কারও ছবি রাখার সুযোগ নেই। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আচরণ বিধিমালার ৮ এর ১ উপবিধিতে বলা হয়েছে, প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারের পোস্টার হবে সাদা-কালো রঙের। আয়তন হবে অনধিক ৬০ সেন্টিমিটার বাই ৪৫ সেন্টিমিটার। ৮-এর ৫ উপবিধিতে বলা হয়েছে পোস্টার বা ব্যানারে প্রার্থী তার প্রতীক ও নিজের ছবি ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তির ছবি বা প্রতীক ব্যবহার করতে পারবেন না। তবে শর্ত থাকে যে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কোন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মনোনীত হলে সেক্ষেত্রে তিনি কেবল তার বর্তমান দলীয় প্রধানের ছবি পোস্টারে ছাপতে পারবেন। উপধারায় এই উল্লেখিত শর্তের কারণে খালেদা জিয়া ফৌজদারি মামলায় দন্ডিত হলেও বিএনপির প্রার্থীদের পোস্টারে তার ছবি ব্যবহারে কোন বাধা হিসেবে দেখছেন না নির্বাচন কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই কর্মকর্তা আইনের কথা উল্লেখ করে বলেন, এখানে নিয়ম অনুসারে তারা ব্যবহার করতে পারেন। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের আরও এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যদিও কথাটা বললে দলকানা বলতে পারেন। তবে এটা বলব কোন রাজনৈতিক দল যদি মনে করে যে, দলীয় প্রধানের ছবি রাখবে, সেটা রাখতে পারেন। আইনে এটা কিন্তু সেভাবে বর্ণনা করা নাই। নির্বাচন কমিশনের সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও এ বিষয়ে বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের কাছে দ-িত ব্যক্তির ছবি ব্যবহার নিয়ে এখনও কোন অভিযোগ আসে নাই। অভিযোগ আসলে বিষয়টি নিয়ে আমরা করণীয় ঠিক করতাম। তবে সামনের দিনেও যদি এ ধরনের কোন অভিযোগ আসে তাহলে আমরা আইনের বিধি নিয়ে দেখব কি করণীয়। আর দলীয় প্রধান হিসেবে যদি পরিবর্তন হলেও সেটি কমিশনকে অবহিত করতে হয় হালনাগাদের সময় বলেন কমিশনার কবিতা খানম। আইনের বিধিতে যাই থাকুক না কেন বিষয়টি নিয়ে রয়েছে নানা জনের নানা মতো। অন্যতম মেগা সিটি ঢাকায় সারাদেশের বিভিন্ন মতাদর্শী মানুষের বসবাস। গত কয়েকদিনে উত্তর ও দক্ষিণ সিটির বিভিন্ন মহল্লায় চায়ের দোকানে, বিভিন্ন আড্ডায় দুর্নীতির দায়ে দন্ডিত খালেদা জিয়ার ছবি নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে নানা মতামত শোনা গেছে। তবে এই প্রজন্মের তরুণরা দন্ডিত ব্যক্তিকে আইডল হিসেবে নিয়ে ছবি ব্যবহারকে নেতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। সম্প্রতি ইশরাক-তাবিথের পোস্টারে খালেদার ছবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে আলোচিত সেই সভায় খালিদ মাহমুদ বলেন, খালেদা জিয়া দন্ডপ্রাপ্ত আসামি। তার ছবি দিয়ে বিএনপি প্রার্থীরা পোস্টার করছে। দন্ডপ্রাপ্ত, অপরাধীর ছবি পোস্টারে দিয়ে নির্বাচন করার অধিকার নেই। নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, একজন অপরাধীর ছবি সংবলিত পোস্টার কীভাবে করা হয়? স্বাভাবিকভাবেই নৌ প্রতিমন্ত্রীর এই প্রশ্নটা সাধারণ মানুষের মনেও। এই প্রজন্মের তরুণদের কাছে তা আরও বেশি জানার আগ্রহ। পান্থপথে বন্ধুমহল নিয়ে আলোচনারত সিয়াম জানান, আমার কাছে বিষয়টি ভাল লাগেনি। দলীয় প্রধান যে দলেরই হোক যদি দন্ডপ্রাপ্ত হয় তাহলে তাদের ছবি থাকা মানে তাকে আদর্শ হিসেবে মেনে নেয়া। আর দন্ডিত ব্যক্তির আদর্শ নিশ্চয় ভাল নয় জানান তিনি। রাজধানী নাখালপাড়ার বাসিন্দা জেসমিন আক্তার একজন শিক্ষিকা। তিনি বলেন, আমি রাজনীতি কম পছন্দ করি তবে সচেতন ব্যক্তি হিসেব এটা বলব দন্ডিত যে কেউ প্রার্থী যেমন হতে পারে না বা প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থাকলেও ভোট পেত না তেমনি দন্ডিত কারও ছবি বা নাম ব্যবহারও আমার কাছে শুভন মনে হয় না। এটি একটি নীতি নৈতিকতার বিষয়। যারা রাজনীতি করেন সেখানে তাদের নানা স্বার্থ থাকতে পারে তবে এটি হওয়া উচিত নয়। সিটি নির্বাচন বিধিতে আরও বলা আছে, পোস্টারের ছবি হতে হবে ‘পোট্রেইট’, কোন অনুষ্ঠান, মিছিলে নেতৃত্বদান, প্রার্থনারত অবস্থার ছবি কোন অবস্থায় ছাপানো যাবে না। ছবির আয়তন হবে সর্বোচ্চ ৬০ সেন্টিমিটার বাই ৪৫ সেন্টিমিটার। কোন প্রার্থীর নির্বাচনী প্রতীক দৈর্ঘ্য, প্রস্থ বা উচ্চতায় তিন মিটারের বেশি হতে পারবে না। কোন প্রার্থী বা তার পক্ষে অন্য কেউ মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা ও মুদ্রণের তারিখবিহীন কোন পোস্টার লাগাতে পারবেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জনকণ্ঠকে বলেন, দন্ডিত ব্যক্তি যেমন নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না আবার দলীয় প্রধানের ছবি ব্যবহারের বিষয়টিও আইনে আছে। সে হিসেবে ঠিকই আছে তবে দন্ডিত ব্যক্তি দলীয় প্রধান হলে কি হবে সেটি যেহেতু নাই সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের। আমি এটি বলব একজন দন্ডিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে দলীয় প্রধান কিংবা অন্যান্য বিষয়ে নিরুৎসাহিত করা উচিত। একটা সমাজে যদি অপরাধীকে উৎসাহ দেয়া হয় তাহলে প্রকৃত পক্ষে অপরাধকেই প্রশ্রয় দেয়া হয়। এখন ইসি এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে ভবিষ্যতের জন্য। নির্বাচনী প্রচারে দন্ডিত ব্যক্তির ছবি ব্যবহার নিয়ে গণতন্ত্রী পার্টির অন্যতম শীর্ষ নেতা নূরুর রহমান সেলিম জনকণ্ঠকে বলেন, নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে। যেহেতু আইনে বলা নেই দ-িত হলে ছবি ব্যবহার করা যাবে কি না সেটির একটি সিদ্ধান্ত এতদিনে কমিশন থেকে আসা উচিত ছিল। কেন এখনও নির্দেশনা দিল না সেটি একটি বিস্ময়। দন্ডিত ব্যক্তির নির্বাচনে অংশ নিয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে যেসরকম এখানে দলীয় প্রধান দ-িত হলে কি করণীয় তা স্পষ্ট থাকতে হবে। প্রয়োজনে কমিশন আইন সংশোধন করতে পারে নয়তো এটি তাদের ব্যর্থতাই মনে করি। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের দেশের মানুষ মার্কা দেখে ভোট দেয়। সবাই মনে মনে ঠিকই করে রাখে শেষের দিকে একটা সিদ্ধান্ত নেয়। সবাই দলীয় প্রধানের ছবি দিয়ে নিজে পাড় হতে চায় এগিয়ে যেতে চায়। স্থানীয় নির্বাচন এভাবেই শেষ হয়ে যাবে। অভিযোগ থাকবে এর মধ্যেই প্রচার সবই চলবে। দ-িত ব্যক্তির ছবি নির্বাচনী পোস্টারে ব্যবহার নিয়ে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া জনকণ্ঠকে বলেন, কোন দ-িত ব্যক্তির ছবি ব্যবহার হবে কি না সেটি দেখবে নির্বাচন কমিশন। বিষয়টির পুরো এখতিয়া কমিশনের। আমরা এই শহরে প্রধানমন্ত্রী যে উন্নয়নের রূপরেখা দিয়েছে সেটি যেনভাল হয়, দুর্নীতিমুক্ত যানজটমুক্ত, দূষণমুক্ত শহর পাই সেটি ভাবছি এখন। অপরাধ বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখানে এক দল অন্য দলকে দোষারোপ করে গণতন্ত্রের চর্চা নিয়ে। এছড়াও আইনের নানা ফাঁকফোকরের সুযোগও অনেক সময় দলগুলো নেয়। এই যে একটি আইন আছে সেখানে আইন করার সময় হয়তো এটি মাথায় আসেনি কখনও কোন দলের প্রধান দন্ডিত হতে পারে। এরকম অনেক প্রশ্নের স্পষ্ট ব্যাখা নেই তা দরকার। ভোটাররা যেমন স্বচ্ছ, দক্ষ দলীয় প্রধান চান তেমনি প্রার্থীও যেমন দলীয় প্রধানের মতোই স্বচ্ছ ও দক্ষ হয় সেটিও প্রত্যাশা করেন। ভাসমান ভোটাররা প্রার্থীদের যোগ্যতাকে মূল্যায়ন করে। সেখানে দ-িত ব্যক্তির ছবি প্রকাশের মাধ্যমে কিন্তু প্রার্থীরা নিজেদের ক্ষতিই করছে। আর ইসি এ বিষয়ে ভবিষ্যতের জন্য করণীয় করতে পারে। এদিকে, আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে আমরা কথা বলতে বিব্রতই বোধ করি। কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা বলেন, দলীয় প্রধান যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হন তার নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা তো আরও বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হবে। কমিশনে আগে এরকম আইন ছিল না সময়ের দাবিতে সেটি হয়তো কমিশন ভেবে দেখবে। বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মধ্যম সারির এক বিএনপি নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই বিষয়টি খুব আহামরি নয়। এছাড়াও ম্যাডামের রায় নিয়ে উচ্চ আদালতে আপিলের বিষয়ও আছে। তারপরেও দলীয় প্রধান নিজ দলের প্রত্যেক নেতার কাছে অনেক বড় কিছু অনেক সম্মানের এর বেশি কিছু বলব না জানান তিনি। ভবিষ্যতের যেকোন নির্বাচনের আগে পরে এই ধরনের প্রশ্ন যেন না উঠে তার জন্য সুষ্পষ্ট ব্যাখা বা প্রয়োজনে আইনের সংশোধন থাকার কথাও বলছেন অনেকেই।
×