ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিপ্রতীপ দাস

লাবুশেন- আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠার নেপথ্যে

প্রকাশিত: ০৯:৪১, ২২ জানুয়ারি ২০২০

 লাবুশেন- আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠার নেপথ্যে

কনকাশন সাবস্টিটিউট! সোজা বাংলায় যাকে বলে ‘বদলি খেলোয়াড়’। শব্দ যুগলের সঙ্গে হয়তো পরিচিতি ছিল না বহুল ক্রিকেট আসক্তদের। তবে, ক্রিকেট বিধাতার ইচ্ছার কারণেই মাস কয়েক আগে দেখা মিলেছিল তার বাস্তব রূপ। ক্রিকেট বিধাতার মর্জি না হলে কি আর রাজসিক প্রত্যাবর্তনকারী স্টিভ স্মিথের কপালে জুটে বেরসিক ইনজুরি! আগের ৪ টেস্টে রান করেছেন মাত্র ৪৬। ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘বৃহস্পতি তুঙ্গে’ থাকা একজন ব্যাটসম্যানের বদলি হিসেবে মাঠে নামা আনকোরা একজন ব্যাটসম্যানের কিছুটা হলেও মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকার কথা। কিন্তু মারনাস লাবুশেনের বডিল্যাঙ্গুয়েজ বলেছিল ভিন্ন কথা। লর্ডসে যেন সেদিন লাবুশেন নয় ব্যাট হাতে আর্চার-ব্রডদের সাবলীলভাবে সামলাচ্ছিলেন স্মিথের প্রতিবিম্ব। যে ছেলেটার তখনও দেশের রঙিন জার্সি গায়ে চাপানোর সৌভাগ্য হয়নি, একেবারে সাদামাটা ধাঁচে যার লাল বলের ক্রিকেটে আবির্ভাব সেই ছেলেটার হাত ধরেই কিনা লর্ডস টেস্টে মান বাঁচানো ড্র করেছিল অসিরা। দুই ইনিংসে ৬৬.৫ গড়ে দুই ইনিংসে ৫৯ এবং ৭৪ রান করে ছুটতে থাকার ঘোড়ার প্রক্সি দিয়েছিলেন বেশ দুর্বার গতিতেই। দিন কয়েক পরেই এজবাস্টনের সবুজ গালিচায় শূন্যে লাফিয়ে উদযাপন করেছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম শতক। ১১০ রানের ঝলমলে ইনিংসের মাধ্যমেই যেন নতুন করে আগমনী বার্তা দিয়ে রেখেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিক্রান বংশোদ্ভূত এই ক্রিকেটার। এ্যাশেজের বাকি সময়টুকু ইংলিশ বোলারদের উপরে চাবুক চালিয়েছেন বেশ সযতেœ উপরন্তু সজোরেই! অসি সামারের শুরু থেকেই ধারাবাহিক লাবুশেন। পাকিস্তান সিরিজে তার ব্যাট থেকে এসেছিল একের অধিক শতক। নিখাঁদ উইলোবাজিতে ছোটান রানের ফোয়ারা, আর তাতেই স্বদেশী স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, স্টিভেন স্মিথদের পেছনে ফেলে বনে যান এক মৌসুমের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। সোনায় সোহাগারূপে বছরের অন্তে পান খুশির সংবাদ। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো সেরা দশ টেস্ট ব্যাটসম্যানদের তালিকায় জায়গা করে নেন এই তরুণ। নতুন বছর, তবে উনিশের সায়াহ্নে নতুনভাবে প্রস্ফুটিত লাবুশেন যেন পুরনো। এ যেন অনেকটা ভিডিও দেখার মতো, যেখানে বিরতি দিয়েছিলেন সেখান থেকেই শুরু করলেন তার উইলোবাজির প্রদর্শনী। দশকের প্রথম শতক, ২০২০ এর অভিষেক টন কিংবা নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম দ্বি-শতক- এই সকল কিছুর মালিক একজনই সেই লাবুশেন। নিজ দেশে নিউজিল্যান্ডকে নিয়ে এক প্রকার ছেলেখেলায় করল অসিরা। একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছাড়া কিউইদের কফিনে লাবুশেন নামের পেরেকটি গাঁথা রয়েছে একেবারে আঁটোসাঁটাভাবেই। তবে, ব্যাট হাতে জীবনের সেরা ফর্মে থাকা লাবুশেন তার লেগব্রেকের ভেলকিবাজিও কম দেখাননি, হয়তো উইকেটের সংখ্যাটা খুব একটা আহামরি না তবে এই লেগি বিষেই নীল করেছেন উইকেটে স্থিতু হয়ে যাওয়া অনেক বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানদের ফলশ্রুতিতে তার ডান বাহুর নব্য নামকরণ করা হয়েছে ‘গোল্ডেন আর্ম’। এত সুখের মুহূর্তে ক্রিকেটপ্রেমীদের অনেকেরই কপালে চিন্তার স্পষ্ট ভাষা পড়তে খুব বেশি কাঠখড় পোড়াতে হবে না। চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক, ইতোমধ্যে বাইশ গজে অনেক তরুণই এভারেস্টসম আশা জাগানিয়া পারফরর্মেন্স দেখিয়ে শেষমেশ পা পিছলেছেন। তবে এরই মাঝে আবার অনেকেই বিপরীত চিন্তাধারার জগত থেকে নিজেদের দূরে রেখে আপাতত লাবুশেন ক্যারিশমার সুধা পানেই মনোনিবেশ করেছেন। এবারে একটু সময়ের বিপরীতে যাওয়া যাক, জেনে নেয়া যাক আজকের এই বিস্ময়ের উৎপত্তি কিভাবে হলো? জন্মস্থান আফ্রিকা, বাবার বদলির চাকরির সুবাদে মাত্র ১০ বছর বয়সেই অষ্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান লাবুশেন। তারপরে সেখানেই বেড়ে ওঠা, ক্রিকেটের হাতে খড়ি। একমাত্র আফ্রিকান ভাষা জানা ছোট্ট ছেলেটি খুব সহজেই রপ্ত করে ফেলে অজিদের স্থানীয় ভাষা, সেই সঙ্গে ইংরেজীতেও দক্ষতা বাড়তে থাকে। কুইন্সল্যান্ডের হয়ে খেলতে থাকেন বয়সভিত্তিক দলগুলোতে, শেষমেশ ২০১২-১৩ মৌসুমে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক বনে যান লাবুশেন। এর পরে আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ২০১৪-১৫ মৌসুমে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বিভাগ লীগেও খেলেন তিনি। ২০১৪-১৫ মৌসুমের শেফলশীল্ড টুর্নামেন্টের মধ্য দিয়ে ঘরোয়া লীগে সাদা পোশাকে অভিষেক হয় মার্নসের। অভিষেক ম্যাচেই তিনি তার সামর্থ্যরে জানান দেন, সাউথ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তুলে নেন ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধ-শতক, দুই ইনিংস মিলিয়ে তার রান দাঁড়ায় ১৩৭! চলতি বছরেই অস্ট্রেলিয়া সফর করে ভারত। সিরিজের এক টেস্টে শর্ট লেগে বদলি ফিল্ডার হিসেবে দর্শনীয় এক ক্যাচ নিয়েছিলেন লাবুশেন। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে লিষ্ট-এ ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে এই তরুণ ক্রিকেটারের। ক্যারিয়ারের প্রথম শতকের দেখা পান উক্ত মৌসুমেই। পরের মৌসুমে দাপুটে পারফর্ম করে জিতে নেন টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার। ৪৫.০৭ এভারেজে সংগ্রহ করেন ২৭৩ রান। বাইশ গজে এত এত সাফল্যের পাশাপাশি ক্যারিয়ারের শুরুতেই নাম লিখিয়ে বসেন এক অবাঞ্ছিত রেকর্ডের পাশে। আইসিসির নতুন নিয়ম অনুসারে ২০১৭ সালে কুইন্সল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়ার একাদশের ঘরোয়া লীগের এক ম্যাচে ‘অবস্ট্রাকট দ্য ব্যাটসম্যান’ এর অপরাধের শাস্তিস্বরূপ তিনি প্রতিপক্ষকে পেনাল্টিমূলক ৫ রান উপহার দিয়ে বসেন। ২০১৭-১৮ মৌসুমে ঘরোয়া লীগে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক লাবুশেন জায়গা করে নেন শেফল-শীল্ড কর্তৃক নির্বাচিত সেরা একাদশে। ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮! অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, মিঃ ক্রিকেট খ্যাত মাইকেল হাসির কাছে থেকে পাওয়া ‘ব্যাগি গ্রীন ক্যাপ’ মাথায় চাপিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সাদা পোশাকে দেশের হয়ে প্রথবারের প্রতিনিধিত্ব করতে নেমে পড়লেন। তবে, শুরুটা মোটেও সুখকর হয়নি তার জন্য, ব্যাট হাতে রান করেছিলেন ( ০, ১৩) আর বল হাতে নিয়েছিলেন ২ উইকেট। পরের ম্যাচে বল হাতে ৫ উইকেট নেয়ার পাশাপাশি তার থেলে এসেছিল (২৫, ৪৩) রান। দ্বিতীয় ইনিংসে তার করা সেই ৪৩ রানই ছিলো অজিদের ইনিংসের সর্বোচ্চ রান। ভাগ্যের জোরে সেই বছরেই ভারত সিরিজের ওয়ানডে স্কোয়াডে জায়গা করে নেন, তবে মাঠে নামা হয়নি কোন ম্যাচেই। টেস্ট সিরিজে দলের বাইরে থাকা লাবুশেনকে অকস্মাৎ সুযোগ দেয়া হয় সিরিজের চতুর্থ ম্যাচে। তার উপরে আবার তাকে খেলানো হয় তিন নম্বরে। এই সিদ্ধান্তে ব্যর্থ লাবুশেনসহ পুরো দলকে পড়তে হয় চরম বিপাকে, সঙ্গে ভাগ্যে জোটে তিরস্কার আর সমালোচনা। ২০১৯ এর শুরুর দিকে তিনি ইংল্যান্ডের ঘরোয়া দল গ্ল্যামারগণের হয়ে কাউন্টি ক্রিকেট খেলতে থাকেন। মাত্র ৪ ম্যাচে ৩ শতকের ভর করে সংগ্রহ করেন ১,১১৪ রান। সাসেক্সের বিপক্ষে গ্ল্যামারগনের ক্রিকেট ইতিহাসে দ্বিতীয় উইকেটে পিটার ফস্টারের সঙ্গে ২৯১ রানের জুটি গড়েন, সঙ্গে নিজে খেলেন ১৮২ রানের এক ঝলমলে ইনিংস। এমন মন জুড়ানো ব্যাটিংয়ের পুরস্কারস্বরূপ তাকে আরও দুই মৌসুমে জন্য গ্ল্যামারগন তাকে তাদের দলে পুনর্বহাল রাখে। অনেক কিছুই হয়তো পেয়েছেন, ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই আরও অনেক কীর্তি গড়বেন। তবে একজন অসি ক্রিকেটার হয়ে নিশ্চয়ই তার স্বপ্নও ছিল এ্যাশেজে মাঠে নামার, অবশেষে সেই সুযোগও ধরা দিল অল্পদিনেই। ২০১৯-২০ মৌসুমে প্রথম বারের মতো দলে ডাক পেলেন আর তাতেই নতুন করে লিখে ফেললেন নব্য উত্থানের গল্প! ছেলেবেলা থেকেই লাবুশেন ছিলেন ধর্মভীড়ু প্রকৃতির। আরাধ্য যীশুর প্রতি ছিল তার অগভীর শ্রদ্ধাবোধ। ক্রিকেটের প্রতি শৈশবের আসক্তিটা পরিপূর্ণতা পায় ১৭ বছর বয়সে। রক্তে মিশে যায় ক্রিকেটার হওয়ার অদম্য জেদ। তার মতে, ‘ক্রিকেট একটি সাহসিকতার খেলা, এখানে ঘাত-প্রতিঘাত থাকবেই। তবে, আপনাকে যীশুর প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাস রেখে এগিয়ে যেতে হবে।’
×