ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাকিল আহমেদ মিরাজ

অনেক নাটকের পর পাকিস্তান সফরে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৯:৪০, ২২ জানুয়ারি ২০২০

 অনেক নাটকের পর পাকিস্তান সফরে বাংলাদেশ

এমন সফর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সামনে কখনোই আসেনি। যেখানে মাঠের চেয়ে বাইরের বিষয় বেশি আলোচিত। আলোচনায় ভয়, সংশয়, নিরাপত্তা। মুশফিকুর রহীম কিছুতেই যাবেন না, সেটা তিনি আগেই জানিয়ে দিয়েছেন। অনেক নাটকীয়তার পর রাজি হওয়া খোদ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) প্রধান নাজমুল হাসান বলেছেন পুরো পাকিস্তান সফরে তিনি থাকবেন ক্রিকেটারদের সঙ্গে। একসঙ্গে ঘুরবেন, খাবেন! সেটা কেন? অতীতে তো এমন হয়নি কখনও। এটা বোঝার জন্য অবশ্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, তামিম ইকবাল, মোস্তাফিজুর রহমান, রুবেল হোসেনদের মনের অজানা ভয়টা আঁচ করতে পেরেই বোর্ড প্রধানের এমন সিদ্ধান্ত। তা নাজমুল হোসেন শান্ত যতই বলুন, নিরাপত্তা নিয়ে তিনি মোটেই ভাবছেন না। না ভাবার পেছনে তার যুক্তি ২০১৮ সালে পাকিস্তানে ইমার্জিং এশিয়া কাপ খেলার অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশ আগেই নারী এবং বয়সভিত্তিক দল পাঠিয়ে কি ফেঁসে গেছে? ক্রিকেটীয় কূটনীতিতে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) কাছে কি হেরে গেছে বিসিবি? অতীত হতে যাচ্ছে এসব প্রশ্ন। সবকিছু ঠিক থাকলে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলছে বাংলাদেশ। সূচী চূড়ান্ত। লাহোরে তিন ম্যাচের টি২০ যথাক্রমে শুক্র, শনি ও সোমবার। তিন ধাপের পরের দুই ধাপে হবে দুটি টেস্ট ও একটি ওয়ানডে। প্রথম ধাপে ২৪, ২৫ ও ২৭ জানুয়ারি তিনটি টি২০ হবে লাহোরে, এরপর প্রথম টেস্টের জন্য আবারও বাংলাদেশ যাবে পাকিস্তান, রাওয়ালপিন্ডিতে সে ম্যাচ হবে ৭-১১ ফেব্রুয়ারি। এরপর পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) হওয়ার কথা, ২২ মার্চ শেষ হবে সেটি। এরপর তৃতীয় দফা আবারও পাকিস্তান গিয়ে বাংলাদেশ খেলবে একটি টেস্ট ও একটি ওয়ানডে। ৩ এপ্রিল একমাত্র ওয়ানডের পর ৫-৯ এপ্রিল দ্বিতীয় টেস্ট করাচিতে। এফটিপিতে (ফিউচার প্ল্যান ট্যুর) ২ টেস্টের সঙ্গে- যেগুলো আইসিসি ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অন্তর্ভুক্ত- ৩টি টি২০ থাকলেও যুক্ত করা হয়েছে একটিমাত্র ওয়ানডে। এর আগে প্রায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের এ সফর নিয়ে তৈরি হয়েছিল অনিশ্চয়তা। আগে টি২০ সিরিজ খেলে পরে টেস্টের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত, বিসিবির এমন প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে আগে টেস্ট সিরিজ খেলার কথা বলে পাকিস্তান। তবে বাংলাদেশ অটল ছিল নিজেদের প্রস্তাবে। কোচিং স্টাফের সদস্য ও ক্রিকেটাররা সেখানে দীর্ঘ সময় অবস্থান করতে চান না বলে জানিয়েছিল বিসিবি। তবে ঘটনা নতুন মোড় নেয় বাংলাদেশ সরকার বিসিবিকে পাকিস্তান সফর সংক্ষিপ্ত সময়ে আসতে ও শুধু টি২০ খেলে আসতে বলায়। এরপরই দুবাইয়ে আইসিসি চেয়ারম্যান শশাঙ্ক মনোহরের সঙ্গে দেখা করতে যান বিসিবি প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান। সেখানেই পিসিবি চেয়ারম্যান এহসান মানির সঙ্গে নাজমুল হাসানের জরুরী সভায় পূর্ণাঙ্গ সফরের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভায় মধ্যস্থতা করেন স্বয়ং আইসিসি প্রেসিডেন্ট শশাঙ্ক মনোহর। পিসিবি চেয়ারম্যান এই সফর নিয়ে তৈরি হওয়া সঙ্কট নিরসনে ধন্যবাদ জানিয়েছেন মনোহরকে, ‘আমি খুশি যে আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ আপসের মাধ্যমে একটা সমাধানে পৌঁছাতে পেরেছি, যেটি এই খেলার এবং দুটি গর্বিত ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের জন্য সবচেয়ে ভাল। আমি আইসিসি চেয়ারম্যান শশাঙ্ক মনোহরকেও তার নেতৃত্ব এবং এ দুটি দেশে যাতে ক্রিকেট বেড়ে ওঠে, সেটি নিশ্চিত করার জন্য ধন্যবাদ জানাই।’ বিসিবি প্রেসিডেন্ট পিসিবিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, ‘আমার অবশ্যই আমাদের অবস্থান বুঝতে পারার জন্য পিসিবিকে ধন্যবাদ জানাতে হবে। আমরা খুশি যে পারস্পরিক সমঝোতায় একটা সমাধানে পৌঁছানো গেছে, এবং এটি আমাদের আইসিসির এফটিপির প্রতি দায়বদ্ধতার উদাহরণ।’ ২০০৯ সালে লাহোরে শ্রীলঙ্কান টিম বাসে বন্দুকধারীর হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ আট জনের মৃত্যু হয়। অল্পের জন্য বেঁচে যান কুমার সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়াবর্ধনেরা। ওই ঘটনার পর পাকিস্তানের মাটিতে কার্যত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ ছয় বছর পর সেখানে জিম্বাবুয়ে-ওয়েস্ট ইন্ডিজ দু’একটি ম্যাচ খেলে এলেও গত বছরই পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলতে পাকিস্তানে যায় সেই শ্রীলঙ্কা। তার আগে অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) টি২০’র একাধিক ম্যাচ। মাঝের ওই সময়টায় ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বড় সব দলের সঙ্গে দিপক্ষীয় সিরিজগুলো পাকিস্তান খেলে আসছিল আরব আমিরাতে। কিন্তু এবার শ্রীলঙ্কা খেলে যাওয়ায় অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে পাকিস্তান বোর্ড। তারা পরিষ্কার জানিয়ে দেয় শুধু টি২০ নয়, বাংলাদেশ খেলতে চাইলে টেস্টসহ পূর্ণাঙ্গ সিরিজটাই পাকিস্তানে খেলতে হবে। ইমার্জিং কাপ, বাংলাদেশ নারী দল ও বয়সভিত্তক দল ভালভাবে সফর করে আসার পর পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলতে পিসিবি নিরাপত্তার বিষয়ে বিসিবিকে আস্বস্ত করতে সক্ষম হয়। যদিও কন্ডিশন হচ্ছে, তিন ধাপে সফরের একেকটি সফল হলেই কেবল পরেরটির জন্য প্রস্তুত হবে বাংলাদেশ। তবে ঘরের মাটিতে নিয়মিত ক্রিকেট আয়োজনে মরিয়া পাকিস্তান বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা দিতে তৈরি। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড পাঞ্জাব প্রাদেশিক প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে ইতোমধ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করেছে। ক্রিকেটারদের হোটেল এবং মাঠে যাওয়ার পথেও থাকবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। লাহোরে টাইগারদের নিরাপত্তায় মোতায়েন করা হবে ১০ হাজার পুলিশ! লাহোরে ব্যাপক নিরাত্তাকার্যক্রম এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা এবং স্টেডিয়ামের ভেতর-বাইরে যাওয়ার পথে পূর্ণ মাত্রায় তল্লাশি চালানো হবে। বাংলাদেশ দলের কোনো সমস্যা হলে দ্রুতগতিতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তৈরি থাকবেন ১৯ জন বিশেষ কর্মকর্তা, সামরিক কমান্ডো এবং রেঞ্জার্স। পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে তিন ম্যাচের টি২০’র জন্য ব্যাপক নিরাপত্তা পরিকল্পনা দাঁড় করিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। এমনকি খেলা দেখতে আসা সাধারণ দর্শকদের বিষয়টিও মাথায় রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাঞ্জাব প্রদেশের আইনমন্ত্রী মোহাম্মদ বাশারাত রাজা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষকে (পাঞ্জাব সরকারের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি) নির্দেশ দিয়েছেন সময়মতো সকল প্রস্তুতি গুছিয়ে নেওয়ার। গত সপ্তাহেই সাংবাদ মাধ্যমকে বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান জানিয়েছেন, তিনি ক্রিকেটারদের সফরসঙ্গী হচ্ছেন। সব ঠিক থাকলে আজ রাতে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে বাংলাদেশ দল। আর বৃহস্পতিবার তাদের সঙ্গে যোগ দেবেন নাজমুল হাসান। নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে তখন তিনি বলেন,‘আমাদের এ্যাডভান্স সিকিউরিটি টিম যাচ্ছে। ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টিলিজেন্স (এনএসআই) থেকেও নিরাপত্তা দেওয়া হবে। এনএসআই থেকে একটি টিম আগে যাচ্ছে, পরেও যাচ্ছে। ডিজিএফআই থেকেও লোক যাবে। আমরা আমাদের তরফ থেকে যে পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়ার সেটা তো নেবোই। তবে নিরাপত্তা নিয়ে বিস্তারিতভাবে এখন কথা বলছি না।’ সবমিলিয়ে নিরাপত্তা নিয়ে আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন নাজমুল, ‘এটা (নিরাপত্তা) নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। খেলা নিয়ে চিন্তা। মাথার মধ্যে এরকম একটা চিন্তা থাকলে তো স্বাভাবিক পারফরম্যান্স আসে না। মানসিক শান্তি ছাড়া ক্রিকেট খেলা অনেক কঠিন। আর এমনি টি২০ অনেক মানসিক চাপের খেলা। প্রতি সেকেন্ডে খেলা ঘুরে যায়। তাই এটাই ওদের (ক্রিকেটারদের) বললাম যে ঠা া মাথায় খেলবা। ইনশাআল্লাহ, কিছুই হবে না। আমি আসছি। একসঙ্গে থাকব, একসাথে খাবো। কোনো অসুবিধা নেই।’ পিসিবি যে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে তাতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বিসিবি প্রধান বলেন, ‘আমাদের তরফ থেকে যা করার আমরা করছি। ওদের (পিসিবির) নিরাপত্তা পরিকল্পনা দেখেছি। এর চেয়ে বেশি আসলে কিছু করার নেই। এখন সমস্যা যে কোন জায়গাতেই হতে পারে।’ তবে যদি সমস্যা হয়েই যায় সেক্ষেত্রে কি হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের যদি কখনও মনে হয় যে ওখানটায় যেমনটা ভেবেছিলাম বা পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়েছে তাহলে আমাদের সিদ্ধান্তও পরিবর্তন হবে। সেটা ভিন্ন ইস্যু। তবে এখন পর্যন্ত আমরা মনে করছি এটা একটি নিরাপদ জায়গা এবং আমরা খেলতে যেতে পারি সেখানে। মাথায় এখন সেই নিরাপত্তার ব্যাপারটি বাদ দিয়ে খেলায় মনোনিবেশ করা উচিত। সেটাই ওদেরকে (খেলোয়াড়দের) বলতে এসেছিলাম।’ মাঠের ক্রিকেটের কথা বললে দু’দলই স্বস্তিতে নেই। টি২০তে পাকিস্তানের পারফর্মেন্স খুব একটা ভাল নয়। সরফরাজ আহমেদকে সরিয়ে নেতৃত্ব দেয়া হয়েছে তরুণ বাবর আজমের কাঁধে। অন্যদিকে নিষিদ্ধ সাকিব আল হাসান, মুশফিক যাচ্ছেন না- এই অবস্থায় মাহুমদুল্লাহর নেতৃত্ব বাংলাদেশের জন্যেও সফরাট অনেক চ্যালেঞ্জিং। উল্লেখ্য, ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পাওয়ার পরের বছরই মুলতানে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের একটি ম্যাচ খেলতে পাকিস্তানে গিয়েছিল বাংলাদেশ। সর্বশেষ পুর্নাঙ্গ সফর ছিল ২০০৩ সালে। করাচি, পোশোয়ার ও মুলতানে খালেদ মাহমুদ সুজনের দল খেলেছিল তিন টেস্টের সিরিজ। এরপর ২০১১-২০১২ এবং ২০১৫ মৌসুমে পাকিস্তান দু’বার বাংলাদেশে এলেও দীর্ঘ ষোল বছরে টাইগারদের আর সেখানে যাওয়া হয়নি।
×