ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রুমেল খান

‘গোবরে পদ্মফুল’

প্রকাশিত: ০৯:৩৮, ২২ জানুয়ারি ২০২০

‘গোবরে পদ্মফুল’

বাংলায় একটি বাগধারা আছে, ‘গোবরে পদ্মফুল’। যার অর্থ অস্থানে ভাল জিনিস। এক দিনমজুরের ছেলে কিভাবে হলো প্রতিভাবান শাটলার, আজকের লেখার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় সেটাই। ঢাকার পল্টনের শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ ইনডোর স্টেডিয়ামে গত ১৬ জানুয়ারি শেষ হয় দীর্ঘ ২০ বছর পর পুনরায় চালু হওয়া ‘শেখ রাসেল জাতীয় স্কুল ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা।’ বাংলাদেশ ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের তত্ত্বাবধায়নে এবং শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের ব্যবস্থাপনায় এই আসরে বালক-বালিকা এককে ৬০ স্কুলের ২০০ শাটলার অংশ নেয়। এ আসর থেকে ২০ প্রতিভাবান শাটলার খুঁজে বের করে এবং তাদের নিয়ে স্কুল বন্ধকালীন সময়ে বছরে তিন মাস ক্যাম্প করানো হবে। আশা করা যায় তারাই একদিন বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে। ১৫ জানুয়ারি রাত। শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ ইনডোর স্টেডিয়ামে আবাসন হয়েছে অংশ নেয়া কিছু শাটলারদের। সেখানে ছিলেন তসলিম হাজারীও। ফেনী ব্যাডমিন্টন স্কুল একাডেমির এই কোচের কানে এলো টাকার অভাবে শ্রীমঙ্গলের এক শাটলার রাতের খাবার না খেয়েই বিছানায় শুয়ে পড়েছে। মন কেঁদে উঠল তার। গরিব ছেলেটির জন্য মায়া লাগল খুব। খাবারের বন্দোবস্ত করে ছেলেটিকে নিজের উদ্যোগেই খাইয়ে অপার শান্তি পেলেন তিনি। সেই ছেলেটিই পরেরদিন সকালে বালক এককে চ্যাম্পিয়ন হলো। ফাইনালে ১২ বছরের ছেলেটি ২১-১২, ২১-১৬ পয়েন্টে নারায়ণগঞ্জ মাদ্রাসাতুল মিসবাহর তাহমিদ আদনানকে হারায়। আজকের কাহিনী সেই দরিদ্র পরিবারের ছেলেটিকে নিয়েই। ছেলেটির নাম রাজন মিয়া। জন্ম ৭ জানুয়ারি, ২০০৮ সালে। সিলেটের শ্রীমঙ্গলের রূপশপুর গ্রামে জন্ম। ১ ভাই, ১ বোন। বড় বোন তুলি। তিনি সৌদি আরবে বছর তিনেক ধরে গৃহকর্মী হিসেবে চাকরি করছেন। রাজনের মা আগে মানুষেদের বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। যে বাসায় তিনি কাজ করতেন, সে বাসার মালিকের বিবাহিত মেয়ে সৌদি আরবে থাকে। তিনি অন্তঃসত্ত্বা হলে তার দেখাশোনার জন্য গৃহকর্মীর প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তখন মালিকের অনুরোধে রাজনের মা তার মেয়ে তুলিকে সেই দেশে পাঠিয়ে দেন। সেখানে তুলি প্রায় ১৮ হাজার টাকায় চাকরি করছে এবং সেই এখন সংসারের হাল ধরেছে। রাজনের মাকে আর পরের বাড়িতে কাজ করতে না হলেও মেয়ের পাঠানো অল্প টাকায় সংসার চালিয়ে নিতে ঠিকই হিমশিম খাচ্ছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, রাজনের মা-বোন সংসার চালাতে কাজ করলে তার বাবা কি করেন? উত্তরটা রাজনের মুখেই শোনা যাক, ‘আমার বাবা (ট্রাকের মালামাল বহনকারী দিনমজুর) চার বছর আগে মাকে তালাক দিয়ে আরেকটা বিয়ে করেন। এরপর থেকে তিনি আমাদের কোন টাকা-পয়সা দেন না, কোন খোঁজ-খবরও রাখেন না। সে সময় আমরা চরম বিপদে পড়ি। অনেক কষ্টে ছিলাম। বাধ্য হয়ে মা পরের বাড়িতে কাজ করতেন।’ রাজন ক্লাস ফোরে পড়ে শ্রীমঙ্গল চন্দ্রনাথ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অভাবের কারণে ক্লাস টু’র পর কয়েক বছর স্কুলে যেতে পারেনি। পরে কয়েক বছর পর আবারও পড়াশুনা শুরু করে। তবে রাজনকে স্কুলে ভর্তি করে দেন তার কোচ মোহসীন আহমেদ। তার সঙ্গে কিভাবে পরিচয় হলো রাজনের? এই প্রশ্নে রাজন ফিরে যায় কয়েক বছর আগের স্মৃতিতে, ‘আমরা একসময় মোহসীন স্যারের বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। তখন জানলাম তিনি একজন ব্যাডমিন্টন কোচ, তার একটি একাডেমি আছে। সেখানে স্যারের এক ভাতিজিও অনুশীলন করত। তবে সে প্রায়ই আসত না। এ জন্য স্যার একদিন রাগ করে আমাকে অনুশীলনে নিয়ে আসেন। আমারও খেলাটির প্রতি আগ্রহ ছিল। তারপর ওনার কাছে প্র্যাকটিস করতে করতে ধীরে ধীরে খেলাটি রপ্ত করি, অনেক টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে সফলও হই। এভাবেই ব্যাডমিন্টনে আসা। স্যারের একাডেমিতে তিন বছর ধরে খেলছি।’ এর আগে ২০১৮ সালে রাজন ব্যাডমিন্টন এককে বাংলাদেশ যুব গেমসে মৌলভীবাজারের হয়ে চ্যাম্পিয়ন, সিলেট বিভাগের হয়ে রানার্সআপ হয়। এছাড়া সে অনুর্ধ-১২ শিশু একাডেমির চ্যাম্পিয়ন। মোহসীন শুধু রাজনকে ব্যাডমিন্টনই শেখাননি, শিখিয়েছেন সাঁতার এবং ফুটবল খেলাও। তবে ব্যাডমিন্টনে বেশি দক্ষতা দেখে তিনি রাজনকে শুধু ব্যাডমিন্টন খেলারই পরামর্শ দেন। আর সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আসছে রাজন। ফুটবল খেললে তো অনেক টাকা পাওয়া যায়, তাছাড়া ব্যাডমিন্টন তো অনেক কষ্ট-পরিশ্রমের খেলা। তাহলে ফুটবল বাদ দিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলা বেছে নেয়া কেন? এই প্রশ্নের জবাবে রাজন বলে, ‘কষ্ট না করলে তো ভাল খেলোয়াড় হওয়া যাবে না। শীর্ষে যাওয়ার জন্য, খ্যাতি পাওয়ার জন্য যতটা কষ্ট করা দরকার, তা করতে আমি রাজি আছি।’ রাজনকে খেলাধুলা করতে তার মা কখনই তাকে বাধা দেননি। বরং তিনি রাজনকে সবসময় বলতেন, ‘খেলাধুলা করলে শরীর-স্বাস্থ্য যেমন ভাল থাকবে, তেমনি মাদক থেকেও দূরে থাকা যাবে।’ ভবিষ্যতে অনেক বড়মাপের শাটলার হতে চায় রাজন। হতে চায় দেশের শীর্ষ খেলোয়াড় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলে দেশের জন্য সাফল্য বয়ে আনতে চায়। সেই সঙ্গে লেখাপড়াটাও চালিয়ে যেতে চায় সে। শাটলার মঙ্গল সিংহ এবং সিবগাতউল্লাহর খেলা খুবই ভাল লাগে রাজনের। তাদের পরামর্শও পেয়েছে রাজন, ‘তারা আমাকে বলেছেন পরিশ্রম কর, তাহলে ভাল ফল পাবে।’ রাজনের দৈনন্দিন জীবনের রুটিনটা এ রকম : সকাল সাড়ে নয়টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত স্কুলে থাকা, বিকেল দুই ঘণ্টা অনুশীলন, তারপর বাকি সময়টা ব্যাডমিন্টন গেম (ফ্রেন্ডলি ম্যাচ) খেলা। এ নিয়ে ঢাকায় দ্বিতীয়বারের মতো এসেছে রাজন। এর আগে ২০১৭ সালে প্রথমবার এসেছিল। তবে খেলতে নয়, খেলা দেখতে। ‘স্যারের ভাতিজি ঢাকায় খেলতে এসেছিল। স্যার আমাকেও ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন, যেন খেলা দেখে আমার কিছু অভিজ্ঞতা হয়। এবার এই প্রথম ঢাকায় এসে ইনডোরে খেলে খুব আনন্দ পেয়েছি। পরিবেশটাও খুব ভাল লেগেছে।’ রাজনের কোচ মোহসীন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ব্যাডমিন্টন বাংলাদেশে, বিশেষ করে সিলেটে অনেক জনপ্রিয় খেলা। এই অঞ্চলে খেলাটির চর্চা অনেক। তাই আমি রাজনকে ফুটবল ও সুইমিং শেখালেও শেষে ওকে ব্যাডমিন্টন খেলাতেই সেট করে দিই। ছেলেটি অনেক গরিব ঘরের, কিন্তু দারুণ প্রতিভা আছে ব্যাডমিন্টন খেলায়। এই খেলায় ওর কিছু একটা হবেই। ভাল সুযোগ-সুবিধা পেলে ও অনেক দূর যাবে বলে আমার বিশ্বাস। ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের উচিত রাজনের মতো গরিব-মেধাবী শাটলার সাহায্য করা, যাতে তারা দেশের রতœতে পরিণত হতে পারে।’ মোহসীনের ভাতিজি নাঈমা আহমেদ জেরিনও প্রতিভাময়ী শাটলার, সে অনুর্ধ-১৫ বিভাগে দু’বারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। রাজন যে এবারের শেখ রাসেল জাতীয় স্কুল ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়ন হবে, এ ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত ছিলেন মোহসীন, ‘আমি জানতাম রাজনের ভেতরে যে ট্যালেন্ট আছে, তাতে সে চ্যাম্পিয়ন হবেই। সবাই দেখেছে সে কতটা ভাল খেলেছে। সে সবার নজর কেড়েছে। সবার প্রশংসা কুড়িয়ে নিয়েছে সে।’ রাজনকে আর্থিকভাবে তো বটেই, তার র‌্যাকেট, কেডস, জার্সি ... এসব কিছু দিয়েও সাহায্য করে থাকেন মোহসীন। দশ বছর লন্ডনে চাকরি করে এবং বাড়ি ভাড়ার অর্থ দিয়ে ও স্থানীয় কয়েকজনের (জাকির মামা, শোয়েব) সাহায্য নিয়ে নিজের নামে একটি ব্যাডমিন্টন একাডেমি চালান তিনি। রাজনের মতো এ রকম সুপ্ত প্রতিভাকে খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে শেখ রাসেল জাতীয় স্কুল ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন মোহসীন, ‘এই টুর্নামেন্ট নিয়মিত হওয়া উচিত। এবারের আসরটি খুবই জাঁকজমকপূর্ণভাবে হয়েছে। আমার কাছে খুবই ভাল লেগেছে। তবে পুরস্কার নিয়ে আপত্তি আছে। শুধু ক্রেস্ট দেয়া হয়েছে। শাটলারদের যদি প্রাইজমানি দেয়া হতো, তাহলে ওরা খেলতে আরও উৎসাহিত হতো।’ এখন দেখার বিষয়, আগামী দিনগুলোতে ‘গোবরে পদ্মফুল’ রাজন কতটা সফল হতে পারে শাটলার হিসেবে।
×