ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বালু উত্তোলন ॥ হুমকিতে নিরাপত্তা বেষ্টনী, সড়ক অবকাঠামো ও পরিবেশ

ক্ষতবিক্ষত পদ্মার বুক

প্রকাশিত: ০৯:২৮, ২২ জানুয়ারি ২০২০

 ক্ষতবিক্ষত পদ্মার বুক

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ বালুু মহাল ইজারাদারদের লোভের থাবায় এখন ক্ষতবিক্ষত রাজশাহীর পদ্মার বুক। অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করতে গিয়ে ইজারা শর্ত লঙ্ঘন করছেন তারা। শুধু তাই নয়, বালু পরিবহনের জন্য নদীর বুকে তৈরি করা হচ্ছে রাস্তা। আর এসব বালু পরিবহনের কারণে নষ্ট হচ্ছে নদী তীরবর্তী এলাকার পরিবেশ। চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে রাস্তাঘাট। বালু ইজারাদারদের দৌরাত্ম্যে রাজশাহীর সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীও হুমকির মুখে পড়েছে। প্রশাসনের তদারকির অভাবে এখন নদীও অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছে। অপরিকল্পতভাবে বালু তোলায় এখন ক্ষতির মুখে পড়েছে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কার করা নদী সংরক্ষণ বাঁধ। এ অবস্থায় নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষও দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা নানা কারণে বালুমহাল সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারছেন না। নদী বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন এভাবে অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলা বন্ধ করা না হলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কোন কাজে আসবে না। জানা গেছে, রাজশাহী শহর ঘেঁষে ১৭ কিলোমিটার শহর রক্ষা বাঁধ রয়েছে। যা নির্মাণে খরচ হয়েছে হাজার কোটি টাকা। সদ্যসমাপ্ত নগরীর পশ্চিমে প্রান্তের বুলনপুর-সোনাইকান্দি এলাকার নদী তীরবর্তী চার কিলোমিটার বাঁধ সংস্কার করা হয়। যাতে খরচ হয় ২৬৬ কোটি টাকা। তবে বাঁধ সংলগ্ন এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলায় সেই বাঁধ নষ্ট হচ্ছে। এ নিয়ে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড সংশ্লিষ্ট দফতরে প্রতিবেদন পেশ করেছে। রাজশাহী নগরের দক্ষিণের কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে বিস্তীর্ণ পদ্মা নদী। রাজশাহী নগরীসহ গোদাগাড়ী, পবা, চারঘাট, বাঘা উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত পদ্মা নদীর মোট ১১টি পৃথক পয়েন্ট বালুমহাল হিসেবে ইজারা দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, রাজশাহী জেলা প্রশাসন নদীর এই পয়েন্টগুলো ইজারা দিয়ে সম্ভাব্য রাজস্ব আদায় করেছেন ২৫ কোটি টাকা। তবে এ বিষয়ে কোন তথ্য দিতে চায়নি জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দফতর। প্রতিবছর বৈশাখ মাসের প্রথম তারিখে এক বছরের জন্য এই বালুমহালগুলো সর্বোচ্চ দরদাতাকে ইজারা দেয়া হয়। ইজারা শর্তানুয়ায়ী নিরাপত্তার কারণে নদীর বাঁধের দুই কিলোমিটারের মধ্যে বালু তোলা নিষিদ্ধ থাকলেও ইজারাদাররা সেই নিষিদ্ধ সীমানার মধ্যেই বালু তুলছেন। বিষয়টি জেলা প্রশাসনের নজরে আসলে সর্বশেষ গত ১৪ জানুয়ারি টি-বাঁধের পশ্চিমে পবা উপজেলার হরিপুর ও নবগঙ্গা মৌজার দুইজন বালুর ঘাট ইজারাদার রজব আলী ও আনোয়ার হোসেনের কাছ থেকে ৫০ হাজার করে মোট এক লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। জেলা প্রশাসনের নির্দেশে ওইদিন পবা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবুল হায়াত এই দুই বালুমহালে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। এর আগে গতবছর কাজলা মৌজা থেকে অবৈধভাবে বালু তোলার অভিযোগে ওই বালুঘাটের ইজারাদার আজিজুল আলমের কাছ থেকেও জরিমানা আদায় করা হয়। এ সময় জেলা প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে সেখানে বালু উত্তোলন বন্ধ করে দেন। এছাড়া নদীর প্রবাহ রোধ করে বালু পরিবহনের জন্য যাতায়াতের রাস্তা তৈরি বন্ধ করে দেয়া হয়। রাজশাহী নগরী ও এর আশপাশে নদী তীরবর্তী বালুমহাল ঘুরে দেখা গেছে, নিয়ম অমান্য করে প্রকাশ্যে নদী তীরবর্তী বাঁধের কোল ঘেঁষে বালু তোলার হিড়িক পড়েছে। কোন কোন বালুমহাল সংশ্লিষ্টরা সেই বালু তুলে সংরক্ষণ করছেন বাঁধের ওপর। এখানেই শেষ নয়, শুকিয়ে যাওয়া নদীর বুকে খালের মতো সৃষ্ট জলাধার দিয়ে যে সামান্য পানি প্রবাহিত হচ্ছে, তাও বন্ধ করে ইট-খোয়া ও রাবিশ ফেলে নদীর মাঝে রাস্তা তৈরি করে ট্রাক নামিয়ে বালু পরিবহন করা হচ্ছে। নদী বিশেষজ্ঞদের দেয়া তথ্যমতে, বর্ষা মৌসুমে ভারত থেকে নেমে আসা ঢল প্রতিরোধের জন্য পদ্মার বুকে আই-আকৃতির বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। যাতে বাঁধগুলোর পশ্চিম পাড়ে পলিমাটি বা বালু জমে। এই পলিমাটি বা বালি খরস্রোতা নদীর স্র্রোতের তীব্রতা থেকে তীরবর্তী এলাকাকে রক্ষা করে এবং নদীর তীব্র স্রোত তীরের দিক থেকে মাঝ নদীর দিকে সরিয়ে দেয়। অথচ তীর রক্ষার পরিকল্পিত সেই বালুই তুলে ফেলা নেয়া হচ্ছে। এদিকে নদী থেকে বালু উত্তোলন করে বাঁধের ওপর পাহাড় গড়ে তা সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সেই বালু থেকে দিন-রাত পানি ঝরছে। ফলে বাঁধ এলাকার মাটি ও সংস্কার করা বাঁধ দুর্বল হয়ে পড়ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অভিযোগ করেন, পদ্মানদীর ১১টি পয়েন্ট থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার ট্রাকে বালু ভর্তি করে দিয়ে নিয়মিত যাতায়াতের ফলে রাস্তাগুলো ভেঙ্গে পড়েছে। সেই রাস্তা ব্যবহারকারী এলাকাবাসীকে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান জানান, নদী তীর সংরক্ষণ করে বালু তোলায় কোন সমস্যা নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর চার প্রভাবশালী বালু ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রণ করছে পুরো পদ্মানদী। বালুর লোভে তারা এখন অন্ধ হয়ে গেছে। পরিবেশ ও নদীর কথা না ভেবে প্রতিনিয়ত নদীবক্ষ ক্ষতবিক্ষত করছেন। যদিও এসব বালু ব্যবসায়ীদের দাবি তারা শর্ত মেনে বালু উত্তোলন করছেন। বালু ইজারাদারদের মধ্যে সবচেয়ে শর্ত ভঙ্গ করছেন আনোয়ার হোসেন ও রজব আলী। এছাড়া অপর বালু ব্যবসায়ী অজিজুল আলম ও নাহানের বিরুদ্ধে রয়েছে নিয়ম অমান্য করে বালু তোলার অভিযোগ।
×