ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ

প্রকাশিত: ০৯:১৭, ২২ জানুয়ারি ২০২০

 পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ

বহুল আকাক্সিক্ষত পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকা হতে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কি. মি. ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তঃদেশীয় রেল যোগাযোগ উন্নয়ন করার লক্ষ্যে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প নেয়া হয়েছে। গত ১৪ অক্টোবর, ২০১৮ স্বপ্নের ‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ নির্মাণ’ প্রকল্পের শুভ উদ্বোধন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকল্পটি বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা ছাড়াও ট্রেনের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন সহজ হবে, দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটবে। এ প্রকল্পের নাম পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প। উদ্যোগী মন্ত্রণালয়- রেলপথ মন্ত্রণালয়। বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রকল্প মেয়াদ ১ জানুয়ারি ২০১৬ হতে ৩০ জুন ২০২৪ পর্যন্ত। মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের নির্মাণকাজ ৩০ মাসে সমাপ্ত করে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ভাঙ্গা-পাঁচুরিয়া-রাজবাড়ী সেকশনের মাধ্যমে বিদ্যমান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। ঢাকা এবং যশোরের সঙ্গে রেলওয়ে সংযোগ স্থাপনের নির্মাণকাজ একইসঙ্গে শুরু হয়ে ৪.৫ বছরে সমাপ্ত হবে। আশা করা যায় পদ্মা সেতু চালুর দিন হতে মাওয়া-ভাঙ্গা অংশে রেলপথ চালু করা যাবে। প্রকল্পের ভৌগোলিক অবস্থান- ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন হতে যশোরের রূপদিয়া ও সিঙ্গিয়া রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত। লাইনটি কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন হতে গেন্ডারিয়া স্টেশন হয়ে বিদ্যমান রেললাইনের পাশ দিয়ে পাগলা পর্যন্ত যাওয়ার পর বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে কেরানীগঞ্জ, নিমতলা, শ্রীনগর, মাওয়া, পদ্মা সেতু, জাজিরা, শিবচর, ভাঙ্গা জংশন, নগরকান্দা, মুকসুদপুর, মহেশপুর, কাশিয়ানী, লোহাগড়া, নড়াইল, জামদিয়া ও পদ্মবিলা পর্যন্ত যাওয়ার পর একটি লাইন যশোরের দিকে রূপদিয়া স্টেশনের সঙ্গে এবং একটি লাইন খুলনার দিকে সিঙ্গিয়া স্টেশনের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। প্রথম পর্যায়ে মাওয়া হতে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে রেললাইন জাজিরা, শিবচর, ভাঙ্গা জংশন হয়ে বিদ্যমান ভাঙ্গা স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত হবে। ওই রেললাইন ঢাকার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল ও যশোর জেলার সংযোগ স্থাপন করবে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য-পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন; ঢাকা-যশোর করিডরে অপারেশনাল সুবিধাসমূহের উন্নয়নসহ সংক্ষিপ্ত রুটে বিকল্প রেল যোগাযোগ স্থাপন করা, বাংলাদেশের মধ্যে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আরেকটি উপ-রুট স্থাপন, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলা নতুন করে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতাভুক্তকরণ, এ রুটে কন্টেইনার চলাচলের ক্ষেত্রে জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফ্রেট ও ব্রডগেজ কন্টেনার ট্রেনসমূহ প্রয়োজনীয় স্পিডে ও লোড ক্যাপাসিটিসহ চালুকরণ, সম্পদের সদ্ব্যবহার ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অপারেশনাল দক্ষতা ও আর্থিক পারফর্মেন্স বৃদ্ধি, যাত্রী সেবার মান উন্নয়ন এবং যাত্রী সুবিধা বৃদ্ধি। ভবিষ্যতে ওই রুটে দ্বিতীয় লাইন নির্মাণ এবং বরিশাল ও পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরকে এই রুটের সঙ্গে সংযুক্তির পরিকল্পনা রয়েছে। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য গণ-পরিবহন সুবিধা প্রবর্তনের মাধ্যমে আঞ্চলিক সমতা আনয়ন ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখা। এতে মোট দেশীয় উৎপাদন (জিডিপি) আনুমানিক এক (১) শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে মেইন লাইন ১৬৯.০০ কি. মি., লুপ ও সাইডিং ৪৩.২২ কি. মি. ও ডাবল লাইন ৩.০০ কি. মি.সহ মোট ২১৫.২২ কি. মি. ব্রডগেজ রেল ট্র্যাক নির্মাণ করা হবে। এতে ৬৬টি মেজর ব্রিজ, ২৪৪টি মাইনর ব্রিজ/কালভার্ট, ১টি হাইওয়ে ওভারপাস, ২৯টি লেভেল ক্রসিং ও ৪০টি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। ১৪টি নতুন স্টেশন বিল্ডিং নির্মাণ এবং ৬টি বিদ্যমান স্টেশনের উন্নয়ন ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ, ১০০টি ব্রডগেজ যাত্রীবাহী গাড়ি সংগ্রহ থাকছে। ওই প্রকল্পে ১৭৮৬ একর প্রাইভেট ভূমি অধিগ্রহণ, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ২৩৫.১২১১ একর এবং বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের ৪২.৬৫৮৭ একর ভূমি হস্তান্তর করা হচ্ছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা নদীর ওপর মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে বহুল আকাক্সিক্ষত পদ্মা সেতু বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের অধীনে নির্মাণাধীন রয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলাতেই রেল নেটওয়ার্ক নেই বিধায় সে অঞ্চলের জনগণ স্বল্প ব্যয়ে দ্রুত, নিরাপদ ও আরামদায়ক রেল পরিবহন সুবিধা হতে বঞ্চিত। দেশের আপামর জনগণের প্রাণের দাবি পদ্মা সেতুর নিচের ডেকে রেললাইন স্থাপনের সংস্থান রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে এবং দক্ষিণ এশীয় দেশসমূহের মধ্যে আন্তঃদেশীয় রেল যোগাযোগ উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে ২০০৯ সাল হতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০১১ সালে সরকারী অর্থায়নে একটি এলাইনমেন্ট সার্ভে পরিচালিত হয়। এরপর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এর অর্থায়নে একটি কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের আওতায় আন্তর্জাতিক পরামর্শক দিয়ে এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই, বিশদ ডিজাইন ও দরপত্র দলিল প্রণয়ন জুন, ২০১৫-তে সম্পন্ন হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালের ০৬-১১ জুন গণচীন সফরের সময় রেল খাতে গণচীন সরকারের বিনিয়োগের বিষয়টি দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকে অন্তর্ভুক্ত হয়। তাছাড়া, প্রধানমন্ত্রী ২৩.১০.২০১৪ তারিখে রেলপথ মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন হতে সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচলের কার্যক্রম গ্রহণের জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন। ২৭ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে গণচীন সরকার ১২ মে ২০১৫-তে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের জন্য জিটুজি পদ্ধতিতে অর্থায়নে সম্মত হয় এবং চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লি. নামক চীন সরকারের মনোনীত ঠিকাদারের সঙ্গে কমার্শিয়াল নেগোসিয়েশনের জন্য আহ্বান জানায়। এরই ধারাবাহিকতায় চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লি.-এর সঙ্গে ৮ আগস্ট ২০১৬ তারিখে কমার্শিয়াল চুক্তিপত্র স্বাক্ষর হয়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর প্রধানমন্ত্রীর সদয় হস্তক্ষেপে ২৭ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে চীনা এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ২৬৬৭.৯৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। নির্মাণ চুক্তি গত ৩ জুলাই ২০১৮’তে কার্যকর হয়েছে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো প্রবর্তন করতে যাচ্ছে- ২৩ কি. মি. এলিভেটেড ভায়াডাক্টে ব্যালাস্টবিহীন রেললাইন নির্মাণ। এলিভেটেড ভায়াডাক্টের ওপর ২টি প্ল্যাটফরম, ১টি মেইনলাইন ও ২টি লুপলাইনসহ রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ ও তাতে লিফট স্থাপন। প্রায় ১১ মিটার উঁচু রেললাইনের নিচ দিয়ে সড়কের জন্য আন্ডারপাস নির্মাণের মাধ্যমে উভয় পথে নিরবচ্ছিন্ন ও নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা হবে। সফট সয়েল ট্রিটমেন্টের জন্য সিমেন্ট মিক্সপাইল ব্যবহার করা হচ্ছে। সেতুর এপ্রোচে ট্রানজিশনাল কার্ভ নির্মাণ করা হচ্ছে। ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণ কমানোর জন্য পুরো মাটি ঠিকাদার কর্তৃক বাইরে থেকে আনার ব্যবস্থাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে প্রকল্পে। এ রেলপথ নির্মাণের ফলে ঢাকা-যশোর, ঢাকা-খুলনা ও ঢাকা-দর্শনার মধ্যকার দূরত্ব যথাক্রমে ১৮৪.৭২ কি. মি., ২১২.০৫ কি. মি. এবং ৪৪.২৪ কি. মি. হ্রাস পাবে। ফলে যাত্রার সময়ও হ্রাস পাবে। গণ-পরিবহন সুবিধা প্রবর্তনের মাধ্যমে আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাসকরণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখবে। -পিআইডি প্রবন্ধ
×