ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দক্ষিণাঞ্চলে অহরহ ঘটছে ফেরি দুর্ঘটনা

প্রকাশিত: ০৯:১১, ২১ জানুয়ারি ২০২০

দক্ষিণাঞ্চলে অহরহ ঘটছে ফেরি দুর্ঘটনা

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ ফেরির অব্যবস্থাপনা ও দুর্বল অবকাঠামো এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে নির্বিঘ্নে হচ্ছেনা দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। টেকসই ফেরির অভাবের সাথে অতিরিক্ত মালামাল বোঝাই যানবাহন ফেরি সার্ভিসকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। এরইসাথে প্রয়োজনীয় সচল ফেরির অভাবে ফেরি ঘাটগুলোতে দুরপাল্লার যাত্রীদের চরম দূর্ভোগে পরতে হচ্ছে। ফলে নদী নির্ভর দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় সীমাহীন দূর্ভোগ জনগনের পিছু ছাড়ছে না। বিশেষ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত দুই দশকে ঢাকা-ফরিদপুর-বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা এবং বরিশাল-পিরোজপুর-খুলনা মহাসড়কের ১০টি ফেরি পয়েন্টে ছোট-বড় সেতু নির্মান করা হয়েছে। এরপরেও ওইসব মহাসড়ক ছাড়াও বরিশাল-ভোলা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নদ-নদীগুলো পারাপারে ফেরি সার্ভিস যথেষ্ট বিড়ম্বনায় রেখেছে এ অঞ্চলের মানুষকে। চট্টগ্রাম থেকে লক্ষীপুর-ভোলা-বরিশাল হয়ে মোংলা ও খুলনা মহাসড়ক চালু হলেও টেকসই ফেরি ব্যবস্থাপনার অভাবে পণ্য পরিবহনে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। সারাদেশের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের ছয়টি জেলার সড়ক-মহাসড়কে যেমনি ফেরি আধিক্য বেশী, তেমনি এ সেক্টরে দূর্ঘটনার সাথে বিড়ম্বনাও অনেক। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাত্রারিক্ত ভার বহনের পাশাপাশি ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের সাথে দীর্ঘদিনের পুরনো ফেরির কারনে একের পর এক দূর্ঘটনা ঘটছে। গত শনিবার বরিশাল-বাবুগঞ্জ-মুলাদী-হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ সড়কের মীরগঞ্জ পয়েন্টে ধারন ক্ষমতার দ্বিগুন বৈদ্যুতিক খুটি নিয়ে পার হবার সময় ফেরির গ্যাংওয়ের উপরে ট্রাকের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে পেছনে ছিটকে পরে পল্টুনসহ ট্রাকের অর্ধেক নদীতে নিমজ্জিত হয়। ফলে টানা ১২ ঘন্টারও বেশী সময় ওই রুটে যানাবাহন পারপার বন্ধ থাকে। খবর পেয়ে বরিশাল সড়ক বিভাগ ও ফেরি বিভাগের প্রকৌশলীগন বিকল্প পল্টুন ও গ্যাংওয়ে চালু করে পরেরদিন রবিবার থেকে যানবাহন পারাপারের ব্যবস্থা করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছর রাতের আঁধারে চট্টগ্রাম-লক্ষীপুর-ভোলা-বরিশাল-মোংলা-খুলনা মহাসড়কের বেকুঠিয়া পয়েন্টের কঁচা নদীতে কয়েকটি বাস ও ট্রাক নিয়ে পারপারের সময় জ্বালানীবাহী নৌযানের সাথে সংঘর্ষে সড়ক বিভাগের একটি ফেরির তলা ফেটে যায়। ওইসময় চালক দ্রুত নিকটবর্তী একটি চরে ফেরিটি তুলে দিয়ে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়াতে সক্ষম হলেও নৌযানটি ডুবে যায়। ওই দূর্ঘটনায় প্রানহানী না ঘটলেও বাস-ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহনসহ ফেরিটির ব্যাপক ক্ষতি হয়। সূত্রে আরও জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক বিভাগের বেশীরভাগ ফেরিতেই রাতের বেলা চলাচলের মত প্রয়োজনীয় সংকেত বাতিসহ সার্চ লাইট নেই। অপরদিকে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এবং বিআইডব্লিউটিসি দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা সংযোগ সড়কের ১৮টি পয়েন্টে ফেরি সার্ভিস পরিচালন করে আসলেও এর বেশীরভাগই দীর্ঘদিনের পুরনো ও মেয়াদ উত্তীর্ণ ফেরি চলছে সম্পূর্ণ জোড়াতালি দিয়ে। সড়ক অধিদপ্তরের ১৭টি পয়েন্টে যে ২৬টি ফেরি পরিচালন করা হচ্ছে তারমধ্যে মাত্র দুইটি নতুন। অবশিষ্টগুলো পাঁচ বছর থেকে ২০ বছরের পুরনো। অনেক ফেরিতে দুই যুগেরও বেশী পুরনো ইঞ্জিন চলছে না চলার মতো করে। দক্ষিণাঞ্চলে বিআইডব্লিইটিসি ভোলা ও বরিশালের মধ্যবর্তী লাহারহাট-ভেদুরিয়া সেক্টরে চারটি ইউটিলিটি ফেরি পরিচালন করলেও তার দুটি এক দশকেরও বেশী পুরনো। ওই সেক্টরে সংস্থাটির চারটি ফেরির মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরে একটি ফেরি বিকল অবস্থায় মেরামতের অপেক্ষায় রয়েছে। অপরদিকে ভোলা ও লক্ষীপুরের মধ্যবর্তী ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ উপ-মহাদেশেরর সর্বাধিক দুরত্বের ফেরি সেক্টরটিতে মাত্র তিনটি ফেরি চলাচল করায় যানবাহন পারাপারে ১০-১২ ঘন্টার বেশী সময় ঘাটেই অপেক্ষমান থাকতে হচ্ছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর বরিশাল ও পটুয়াখালী ফেরি বিভাগের মাধ্যমে বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে যেসব ফেরি সার্ভিস চালু রেখেছে তারমধ্যে বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের লেবুখালী এবং বরিশাল-খুলনা মহাসড়কের বেকুঠিয়াতে মাত্র দুটি ফেরি নতুন। অন্য ২৫টি ফেরিই পুরনো। ইউটিলিটি-১ ও ইউটিলিটি-১ উন্নত মডেলের এসব ফেরির বেশীরভাগই চলছে জোড়াতালি দিয়ে। বেশীরভাগ ফেরির ইঞ্জিনগুলো এতোই পুরনো যে তা এখন মেরামত করেও পরিচালনা সম্ভব হচ্ছেনা বলে জানিয়েছেন দায়িত্বশীল মহল। এমনকি এসব ফেরির হাল, খোল ও উপরি কাঠামোর অবস্থাও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে চলছে এসব ফেরি। সূত্রমতে, বর্ষার সময় পায়রা, কঁচা ও বলেশ্বরের মত বড়-বড় নদী পাড়ি দিতে অনেক সময়ই ফেরির ইঞ্জিন মাঝ নদীতে বন্ধ হয়ে যাবার মতো অঘটনও ঘটছে। ফলে খরস্রোতা নদ-নদীর প্রবল স্রোতে অনেক সময়ই বিপুল সংখ্যক যাত্রী ও যানবাহনসহ ফেরিগুলো ভেসে গিয়ে ভয়াবহ ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। আবার শীতের প্রচন্ড কুয়াশায় এসব ফেরি চলাচলের মত টেকসই সার্চ লাইটসহ প্রয়োজনীয় নৌ-সংকেত সরঞ্জামেরও অভাব রয়েছে। অথচ এসব ফেরি অনেক গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ অতিক্রম করেই প্রতিদিন সহস্রাধীক যানবাহন পারাপার করছে। অথচ সড়ক অধিদপ্তরের কোন ফেরি নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের নিবন্ধিত নয়। ফলে তাতে নৌ-সহায়ক সরঞ্জামাদি থাকা না থাকার দায়ও নেই কারো। অপরদিকে সরকারী নীতিমালার আলোকে দক্ষিণাঞ্চলের সবগুলো ফেরি ও ফেরিঘাটগুলো ইজারার মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ায় যানবাহন পারাপারে ইজারাদারের খামখেয়ালীপনার কাছেই জিম্মি এ অঞ্চলের যাত্রীসহ যানবাহনের চালক ও মালিকগন। বরিশাল-খুলনা মহাসড়কের বেকুঠিয়াতে প্রতি ঘন্টায় মাত্র একবার ফেরি পারাপার হবার পুরনো অলিখিত নিয়ম এখনও ইজারাদার অনুসরন করছেন। ফলে ওই ফেরি পয়েন্টের দুই প্রান্তে প্রতিনিয়ত অপেক্ষমান যানবাহনের সংখ্যা বাড়ায় চরম দূর্ভোগে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের মানুষ। বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কের লেবুখালীর পায়রা নদীতে চলাচলকারী চারটি ফেরির মধ্যে তিনটি সচল থাকলেও সেখানেও যানবাহন পারাপারে চরম দূর্ভোগ অব্যাহত রয়েছে। এ দুটি ফেরি পয়েন্টেই পর্যায়ক্রমে একটির বেশী ফেরি কখনোই যানবাহন পারাপার করেনা। বরিশাল ও পটুয়াখালীতে সড়ক অধিদপ্তরের অন্য ১৫টি ফেরি পয়েন্টে মাত্র একটি করে ফেরি থাকায় সেসবস্থানে যথেষ্ঠ ঝুঁকি নিয়েই যানবাহন পারাপার হচ্ছে। কারন দীর্ঘদিনের পুরনো ওইসব ফেরি প্রায়ই বিকল হয়ে সড়ক যোগাযোগ বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। একাধিক যানবাহনের মালিক ও চালকের মতে, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনের অর্ধেকটা সময় ফেরিঘাটে কাটলেও দীর্ঘদিনেও তা থেকে পরিত্রান মেলেনি। এমনকি এ অঞ্চলে পরিবহন ব্যবসায় নতুন কোন বিনিয়োগও আসছেনা। এ ব্যাপারে বরিশাল সড়ক জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সুশীল কুমার সাহা বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে নতুন ও ভাল মানের ফেরির চাহিদা আমরা সদর দপ্তরকে জানিয়েছি। সড়ক দপ্তরও চেষ্টা করছে। ফেরি চলাচলে সবসময় নিয়মকানুন অনুসরনে বারবারই তাগিদ দেয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, মাত্রাতিরিক্ত বোঝাই ট্রাক পারাপার না করতে সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে।
×