ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছ রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার দাবি

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ২১ জানুয়ারি ২০২০

ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছ রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার দাবি

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, পটুয়াখালী ॥ বারংবার ঝড়-জলোচ্ছ্বাস কিংবা ঘুর্ণিঝড়ের গ্রাসে থাকা জনপদ কলাপাড়ার গোটা উপকূলকে রক্ষা করে আসছে ম্যানগোভ প্রজাতির বনাঞ্চল। এ গাছপালা বুক আগলে সবুজ দেয়ালের মতো ঠেকিয়ে দেয় জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটা। মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চলের বিকল্প নেই। বেচে থাকার অবলম্বন এই বনাঞ্চল নিধনে অনিরাপদ উপকূলে ফের ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনায়নের কাজ শুরু করেছে স্থানীয় বনবিভাগ। ফলে বাড়তে শুরু করেছে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল। কোথাও প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো এ প্রজাতির ছইলা, কেওড়া, গোল, বাইনসহ বিভিন্ন গাছের চারা রক্ষায় বনবিভাগ কঠোর নজরদারি রাখছে। কোথায় জেগে ওঠা নতুন চরে লাগানো হয়েছে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছের চারা। গঙ্গামতির চরাঞ্চল ও আন্ধারমানিক নদী তীরের নতুন চরে লাগানো হয়েছে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির লাখো গাছের চারা। যা ঝড়-জলোচ্ছ্বাসকালীন সবুজ দেয়াল হিসেবে কলাপাড়া ও পায়রা বন্দরের মানুষকে রক্ষা করবে। রক্ষা হবে মানুষ ও তাদের সম্পদ। ইতিবাচক এ উদ্যোগ দূর্যোগে মানুষকে নিরাপদ রাখবে বলে স্থানীয় ও বিশেষজ্ঞদের মতামত। তবে বনাঞ্চলের আশপাশে নির্মিত স-মিল বন্ধের সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞ মহলটি। ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চলে বাড়িঘর তোলা বন্ধ করার দাবি উপকূলবাসীর। কলাপাড়া উপজেলায় বনবিভাগের মোট আয়তন ১০ হাজার ১৭৭ দশমিক ১১ একর। এর মধ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে তিন হাজার নয় শ’ ৭৮ দশমিক ৩৩ একর। যার মধ্যে কুয়াকাটা বিটে ১৯৩ একর। কুয়াকাটা ক্যাম্পের অধীন ১৮১৮ দশমিক ৯৩ একর। গঙ্গামতি ক্যাম্পে ১১২৮ একর। খাজুরা ক্যম্পে ৩৪৬ দশমিক ৮৭ একর এবং ধুলাসার ক্যাম্পের অধীন ৪৬১ দশমিক ৫৩ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকার কথা। এছাড়াও ফুলবুনিয়া, বালিয়াতলী ও লালুয়া বাগান কেন্দ্র করা হয়, যেখানে বনায়ন করা হয়। বিভিন্ন তথ্যসুত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ১৯৫৭ সাল থেকে সাগরপাড়ের এ জনপদে বনায়নের কাজ শুরু হয়। ম্যানগ্রোভ ও ননম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনায়ন করা হয়। ষাটের দশকের মাঝামাঝি কৃষিকাজের স্বার্থে নদী ও সাগরের পাড় ঘিরে করা হয় বেড়িবাঁধ। লোনা পানির কবল থেকে মানুষ তার জীবন ও সম্পদ রক্ষায় এ বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। বেড়িবাঁধের ভিতরে খালের সংযোগস্থলে করা হয় স্লুইসগেট। এরপরে বেড়িবাঁধের বাইরে সবচেয়ে বেশি সৃজন করা হয় গোলগাছের বাগান। অধিকাংশই সৃজিত হয় ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বাগান। ওই সময় থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত হিসাব অনুসারে কলাপাড়ায় ৪৬ একর জমিতে সেগুন গাছ। নারিকেল ২১০ একর। গোলপাতা ২৭৯৪ একর। কড়ই বাগান ৬২৭ একর। গেওয়া বাগান ৩২০ একর। হোগলা পাতা ৪০ একর। সুন্দরী পশুর কেওড়া ১০৫ একর। এছাড়া ম্যানগ্রোভ প্রজাতির আরও গাছ লাগানো হয় ১৯২৯ একর এবং ননম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছ লাগানো হয় ৩১২ একর জমিতে। পরবর্তীতে স্ট্রীপ সংযোগ সড়কে এবং স্ট্রিপ বাঁধ বাগান করা হয় অন্তত ১১৫ কিলোমিটার এলাকায়। এরপরে শত শত কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সামাজিক বনায়ন করা হয়। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু এক শ্রেণির বনদস্যু বনবিভাগের কর্মীদের প্রকাশ্য যোগসাজশে বনাঞ্চল নিধন কাজ চলতে থাকে। এছাড়াও মানুষ তার নিত্যকাজে জ¦ালানিসহ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের জন্য বন উজাড় করতে থাকে। বনের মধ্যেসহ আশপাশে কোন কিছুর তোয়াক্কা না করেই গড়ে তোলা হয় স মলি। কোন নিয়ম নীতি উপেক্ষা করেই স মিলে ম্যানগ্রোভ ও ননম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছ কেটে চেরাই করে দেদার বিক্রি চলে। এই প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত রয়েছে। বনবিভাগের কর্মীরা এতোটাই উদাসীন যে কলাপাড়ায় কতগুলো স মিল রয়েছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান তারা দিতে পারেনি। এসব স মিলের অধিকাংশের বৈধ কাগজপত্র নেই। অভিযোগ রয়েছে মাসোহারায় চলছে এসব। এছাড়া ভূমি অফিসের কতিপয় কর্মীর কারণেও বনবিভাগ ধ্বংস হয়ে গেছে। যেমন মধুখালীর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলকে চাষযোগ্য কৃষিজমি দেখিয়ে বন্দোবস্ত দেয়ায় সেখানে আরও দশ বছর আগে থেকে প্রাচীন শত শত ছইলা, কেওড়া, বাইনগাছ কেটে উজাড় করা হয়েছে। করা হচ্ছে বসতবাড়ি। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে দৃষ্টিনন্দন মধুখালী লেকসহ দুই পাড়ের বনাঞ্চলটি ধ্বংসের মুখোমুখি রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘ ৫০ বছর এ বনটির দেখভাল বনবিভাগ করে আসছে। গাছ কাটার ঘটনায় অসংখ্য বনদস্যুসহ সাধারণ মানুষকে আসামি করে মামলা পর্যন্ত করেছে। এখন তারা বলছে এটি তাদের বাগান নয়। তাই বনদস্যুদের হয়েছে সোনায় সোহাগা। এ বনটির বিশাল এলাকা উজাড় করে অন্তত ছোট-বড় ১০টি মাছের ঘের করা হয়েছে। মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দূর্যোগেও সংরক্ষিত ও অসংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংসের কারন রয়েছে। ধুলাসার ক্যম্পের অর্ধেকটা সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। একই দৃশ্য গঙ্গামতি, কুয়াকাটা ও খাজুরা লেম্বুরচর বনাঞ্চলের। বনবিভাগ মহীপুর রেঞ্জের কর্মকর্তা আবুল কালাম জানান, দুই বছর আগে গঙ্গামতি এলাকায় তারা নতুন করে ২০০ একর বনায়ন করেছেন। কলাপাড়ার বনকর্মকর্তা মো. আব্দুস সালাম জানান, তিনি ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে আন্ধারমানিক ও টিয়াখালী নদীর তীরে ৩০ হাজার গোলগাছের চারা লাগিয়েছেন। লাগানো হয়েছে দুই লাখ ২৫ হাজার কেওড়া গাছের চারা। সলিমপুর গ্রাম থেকে নীলগঞ্জের সুলতানগঞ্জ গ্রাম পর্যন্ত নদী তীরে চরের জমিতে এসব গাছের চারা রোপন করা হয়। এ গাছগুলো ক্রমশ সতেজ হয়ে উঠছে। ফলে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনবৃক্ষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নীলগঞ্জের ইউপি চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট নাসির মাহমুদ জানান, সুপার সাইক্লোন সিডরের সময় যেসব বেড়িবাঁধের বাইরে ম্য্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল ছিল ওই এলাকার বেড়িবাঁধ খুবই কম বিধবস্ত হয়েছে। তাই তার দৃষ্টিতে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের বিকল্প নেই। স্থানীয়দের মন্তব্য ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনায়ন এমনিতেই নদীর পাড়ে জন্মায় যা শুধু রক্ষণাবেক্ষণ করলেই হয়। যেন নষ্ট না হয়ে যায়। আর বেড়িবাঁধের বাইরের কোন ভূমি অনিয়মতান্ত্রিকভাবে কৃষিজমি দেখিয়ে বন্দোবস্ত দেয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। এছাড়া বেড়িবাঁধ মেরামত কিংবা পূনরাকৃতিকরন কাজেও কাটা পড়ছে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল। স্কেভেটর (ভেকু) মেশিনে বাঁধ মেরামতের মাটি কাটায় বেড়িবাঁধের বাইরের ম্যানগ্রোভ প্রজাতির ছইলা-কেওড়া, বাইন, গোলগাছ উপড়ে ফেলা হয়। পশ্চিম মধূখালীসহ ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ মেরামত করতে গিয়ে মাইলের পর মাইল এমন সর্বনাশ করা হয়েছে। ইতোপুর্বে লেবার দিয়ে মাটি কেটে বেড়িবাঁধ মেরামতের কাজ করা হতো। তাতে এক দিকে মানুষের কর্মসংস্থান হতো। অপরদিকে বাঁধকে জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটা থেকে রক্ষার গাছটিও রক্ষা পেত। লেবাররা গাছের চারদিকের মাটি রেখে কাটত। কোন গাছ মারা পড়ত না। এমনকি হেলেও পড়ত না। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড এ পদ্ধতি না মানায় ম্যানগ্রোভ প্রজাতির হাজারো গাছ গত দুই বছরে মারা পড়েছে। যাতে বাঁধ মেরামত কিংবা পুনরাকৃতিকরনে বাঁধ উচু করলেও জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটায় চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। মূলত ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছ রক্ষা এখন উপকূলের জন্য খুব জরুরি প্রয়োজন। কারন সবুজ দেয়াল হিসেবে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসকালীন সময় মানুষ ও তাদের সম্পদকে রক্ষা করে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছ। এ গাছ রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। উপজেলা বন ও পরিবেশ কমিটির সভাপতি ও কলাপাড়ার ইউএনও মো. মুনিবুর রহমান জানান, শীঘ্রই এ কমিটির সভা ডেকে অবৈধ করাতকল বন্ধ করা হবে। এছাড়া ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বন রক্ষায় পরিকল্পিত পরিকল্পনা নেয়া হবে।
×