ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘হামাইয়া দাও গুলি করে শোয়াইয়া দাও’

প্রকাশিত: ১০:৫৭, ২১ জানুয়ারি ২০২০

 ‘হামাইয়া দাও  গুলি করে  শোয়াইয়া দাও’

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ ‘হামাইয়া দাও, গুলি করে শোয়াইয়া দাও’- ওয়াকিটকিতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) তৎকালীন কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদার নির্দেশ ছিল এমন উক্তিতে। এরপরই সংঘটিত হয় গণহত্যা। যা চট্টগ্রাম গণহত্যা হিসেবে ইতোমধ্যে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানমুখী হয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সঙ্গে ছিল তার বিশাল গাড়িবহর। তখন ক্ষমতায় স্বৈরাচারী হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ। সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে উত্তাল গণআন্দোলনের মধ্যে ঐদিন চট্টগ্রামে যে গণহত্যা ঘটেছে সেটি আদালত সোমবার ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা মামলা’র রায়ে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। আদালত বলেছে, ‘এটা গণহত্যা’। মামলার রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে ঐদিনের ঘটনা তৎকালীন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদার নির্দেশে হয়েছে। তার এ নির্দেশের হুকুম তামিল করেছেন পলাতক আসামি পুলিশের সিএমপি’র কোতোয়ালি জোনের তৎকালীন পিআই জেসি ম-ল। সোমবার বিকেলে আলোচিত এ মামলার রায়ে সার সংক্ষেপ পাঠ করেন বিচারক মোঃ ইসমাইল হোসেন। রায়ে আদালত বলে, ‘সিএমপির তৎকালীন কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা ওয়াকিটকির মাধ্যমে অবৈধ নির্দেশ দেন। তার নির্দেশে কোতোয়ালি থানার তৎকালীন পিআই জেসি মন্ডলও ওয়াকিটকির মাধ্যমে অবৈধ হুকুম দেন। এতে আসামিরা এলোপাতাড়ি রাইফেলের গুলি ছোড়ে। এতে শেখ হাসিনার সমর্থনে মিছিলকারীদের মধ্যে ২৪ জন নিহত হন। এর পরবর্তীতে পুলিশ কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদার নির্দেশে সাক্ষ্য প্রমাণাদি বিনষ্ট করার জন্য নিহতদের মৃত দেহ ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আত্মীয়স্বজনদের না জানিয়ে কোতোয়ালি এলাকার অভয়মিত্র শ্মশান ঘাটে পুড়িয়ে ফেলা হয়।’ রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত আরও বলেছে, ‘ঘটনার তারিখ ও সময়ে ঘটনাস্থলে আসামি জেসি মন্ডল (পলাতক), প্রদীপ বড়ুয়া, শাহ মোঃ আবদুল্লাহ, মমতাজ উদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান বিনা উস্কানিতে শান্তিপ্রিয় জনতার ওপর গুলি চালায়। এ ঘটনায় শত শত নিরীহ মানুষ আহত ও পঙ্গু হয়। আদালত বলেন, এটা গণহত্যা। নানা কারণে এ মামলা বিঘ্নিত হয়েছে। মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে ৫৩ জনের। সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত জানায়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিমানবন্দর থেকে ট্রাকযোগে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে পথসভা করতে করতে লালদীঘি অভিমুখী হন। লালদীঘির মাঠে ছিল ঐদিন তার তৃতীয় দফার কর্মসূচী। এরপর চতুর্থ দফার কর্মসূচী ছিল চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে পেশাজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঐদিন পুলিশ তিনটি ব্যারিকেড দেয়। এর মধ্যে একটি ছিল লালদীঘিতে, একটি কোতোয়ালি মোড়ে এবং আরেকটি পুরাতন বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে। শেখ হাসিনার গাড়ির বহর কোতোয়ালি থানার সম্মুখে এসে পৌঁছলে জেসি মন্ডল ওয়াকিটকিতে বলতে থাকেন, ‘চলে আসছে, চলে আসছে।’ তখন পুলিশ কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা ওয়াকিটকিতে নির্দেশ দেন, ‘হামাইয়া দাও, গুলি করে শোয়াইয়া দাও’। কমিশনারের এমন নির্দেশনার পর তা কার্যকর হয়। এবং নির্বিচার গুলিতে ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। ঘটনার পরপরই শেখ হাসিনাকে উদ্ধার করে আদালত ভবনে নিয়ে যান আইনজীবীগণ।’ ‘বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরাপত্তার কারণে আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসতে পারেননি বলে উল্লেখ করে পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, ‘৪ জন সাফাই সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে স্পষ্ট হয়েছে যে, কোন ধরনের সহিংস ঘটনার আগে হত্যাকান্ড ঘটনা হয়েছে।’ এদিকে, মামলার রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত ৪ আসামির আইনজীবী সাঈদ আহাসান। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা এ আদালতের ওপর অনাস্থা এনে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫২৬ ধারায় একটি আবেদন করেছিলাম যে, আমরা উচ্চ আদালতে যাব। মূলত সে কারণেই আমরা সোমবারের যুক্তিতর্কে অংশ নেইনি। কারণ ১৯৮৮ সালের ঘটনার পর একটা বিচার বিভাগীয় তদন্ত হয়েছিল। তদন্ত প্রতিবেদন মামলার ডকেট থেকে রহস্যজনকভাবে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আইনজীবী সাঈদ আহাসান আরও বলেন, আমরা এ বিষয়গুলো আদালতের নজরে এনেছি। এরপরও একদিনের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ করে সময় না দিয়ে আমাদের যুক্তি উপস্থাপন করতে বলা হয়। আবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এ আইনজীবীর কাছে তড়িঘড়ির কারণে বিষয়টি ঘোলাটে মনে হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে।’
×