ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

সিটি নির্বাচনের ব্যাপক প্রস্তুতি

প্রকাশিত: ০৯:৩০, ২১ জানুয়ারি ২০২০

সিটি নির্বাচনের ব্যাপক প্রস্তুতি

বৃহত্তর ঢাকা জেলার দুই সিটি কর্পোরেশনের আগত নির্বাচন এখন দেশে আড়ম্বর আর উৎসবের এক অন্য রকম আমেজ। আর রাজধানী তো মেতে উঠেছে মেয়র এবং কাউন্সিলর প্রার্থীদের নির্বাচনী অঙ্গীকারের বিভিন্ন রকম নির্দেশনায়। একটি স্বচ্ছ, নিরাপদ আর আধুনিক রাজধানী তৈরির মহাপরিকল্পনায় প্রার্থীরা দলীয়, ব্যক্তিক এবং আদর্শিক বোধ থেকে তাদের প্রচারে সরগরম। পাশাপাশি কর্তৃপক্ষও এই মহাআয়োজনের সুষ্ঠু পরিচালনার লক্ষ্যে জনবান্ধব কর্মপ্রক্রিয়াও সন্নিবেশ করতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। নির্বাচন মানেই সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার। শুধু তাই নয়, পছন্দের প্রার্থীকে যাচাই-বাছাই করা যেমন জরুরী একইভাবে পরিচ্ছন্ন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারেও আশাবাদী থাকে ততখানি। ফলে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব বেড়ে যায় বহুগুণ। শুরুতেই প্রার্থীদের সতর্ক এবং সাবধান করে দেয়া হয় প্রচারে কোনভাবেই যাতে বিধি লঙ্ঘন না হয়। প্রার্থীদের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাবে পক্ষে-বিপক্ষের লড়াইয়ের ময়দান জনগণের কাছে পৌঁছানোর এক যৌক্তিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং আদর্শিক আবেদন। তেমন লক্ষ্যমাত্রায় প্রার্থীদের নিজেকে আলাদাভাবে তুলে ধরারও এক ব্যাকুল আহ্বান থাকে। উত্তর ও দক্ষিণের দলগত বিবেচনায় মেয়র প্রার্থীর দিক থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আর বিরোধী বিএনপিই মূল শক্তি হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বীর ভূমিকায় ভোটারদের মধ্যে আনন্দ আর আবেগের সাড়া জাগায়। এ মুহূর্তে নির্বাচনী উৎসবে রাজধানী সাজ-সাজ রবে উল্লসিত এবং মুখরিত। শুধু মেয়র প্রার্থীরাই নন, কাউন্সিলর পদে আগ্রহী প্রতিদ্বন্দ্বীরাও তাদের ভোটের আর্জি নিয়ে জনগণের কাছে প্রত্যাশার ভা-ার খুলে বসেন। কাক্সিক্ষত স্বপ্ন আর অঙ্গীকারে নিজেদের অভিমত তুলে ধরে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাকে আয়ত্তে আনতেও প্রত্যয়ী। এমন সম্প্রসারিত আড়ম্বরে বাজেট বরাদ্দ একটি বড় বিষয়। সেখানে পুরো নির্বাচন সম্পন্ন করতে অর্থ বরাদ্দের রূপরেখাও ইতোমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রায় ৪০ কোটি টাকার অর্থায়নে নির্বাচনকে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য আর নিয়মমাফিক করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার। নির্বাচন পরিচালনার লক্ষ্যে সরকারী অর্থ বিনিয়োগ একটি বিধিসম্মত প্রদত্ত বরাদ্দ। সরকারী অর্থ প্রদান ছাড়াও প্রার্থীরা নিজেরাও একটি বিরাট অঙ্ক ব্যয় করে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার লক্ষ্যে। ফলে পুরো ব্যাপারটাই টাকা খরচের একটি আবশ্যিক ব্যবস্থাপনা। বর্তমান ঢাকা শহর অনেক আধুনিক আর সময়োপযোগী প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন কর্মপ্রক্রিয়ায় সংযুক্ত হলেও নিরাপত্তা বলয়ে একটি মানসম্মত স্বাস্থ্যকর নগরীর সীমানাকে এখন পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারেনি। ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবনের অপরিকল্পিত নির্মাণ কৌশল, পরিবেশ দূষণের বিপন্ন অবস্থায় তীব্র যানজটে নাকাল ঢাকা সড়ক পরিবহন বিধি লঙ্ঘন, অনাকাক্সিক্ষত পথ দুর্ঘটনা ছাড়া ও নারী নির্যাতনের হরেক রকম বিপাকে রাজধানী আজ বিপর্যস্ত-বিধ্বস্ত। ফলে প্রার্থীদের নির্বাচনী অঙ্গীকার জনসমক্ষে নিয়ে আসতে খুব বেশি ভাবতেও হচ্ছে না। পরিচ্ছন্ন ঢাকা শহর তৈরিতে ইতোমধ্যে যে সব প্রয়োজনীয় বিষয় আমলে নেয়া হয়েছে, তেমন কার্যক্রমও একটি চলমান প্রক্রিয়া। তাকে আরও সংহত আর শক্তিশালী করতে বাস্তব কর্মযোগকেও প্রার্থীরা জনগণের মধ্যে নিয়ে আসার জোর প্রচারে নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছে। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খা রক্ষা বাহিনীও তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীও সজাগ-সতর্ক দৃষ্টি দিতে তৎপর থাকে যাতে নির্বাচনে বিধিনিষেধকে সংশ্লিষ্টরা যথাসম্ভব মেনে চলতে উদ্যোগী হন। এর পরও বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ, আপত্তি উঠে আসছে নির্বাচন কমিশনের কাছে। সরকার এবং বিরোধী দল কেউই আইনশৃঙ্খলাকে সব সময় তোয়াক্কাও করেন না। নির্বাচনী প্রচারে ভুল-ভ্রান্তি কিংবা ত্রুুটিবিচ্যুতিকেও নিয়মিত অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়। ঢাকা শহর এই মুহূর্তে নির্বাচনী পোস্টারের বর্ণাঢ্য আবরণে সজ্জিত। নগরীতে পা রাখলেই বুঝতে সময় লাগে না উৎসব আর আমেজের মাত্রায় নির্বাচনী বলয় কতখানি দৃশ্যমান এবং সংশ্লিষ্টদের জন্য এক মহা আড়ম্বরপূর্ণ অভিযান। সেটা প্রার্থী থেকে আরম্ভ করে এলাকাভিত্তিক সমস্ত ভোটারের জন্যই। মেয়র এবং কাউন্সিলরদের আকর্ষণীয় নির্বাচনী অভিযাত্রা সাধারণ মানুষকেও তাদের নাগরিক অধিকার প্রদানে কতখানি উৎসুক করে তোলে তা সত্যিই মুগ্ধতার বিস্ময়। গত ২২ ডিসেম্বর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা দিয়ে কমিশন ৩০ জানুয়ারি ভোট গ্রহণের দিন নির্ধারণ করে। প্রচার চলার মাঝখানে ঘটে যায় আরেক বিপত্তি। এই ৩০ জানুয়ারিই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সরস্বতী পূজা। ফলে অতি প্রাসঙ্গিকভাবেই দাবি ওঠে নির্বাচন পেছানোর। কারণ সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীরা বিদ্যার আরাধ্য দেবীর বন্দনা করে থাকে বিদ্যাপীঠেই। আর নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বিশেষ করে জ্ঞান চর্চায় নিবেদিত ছাত্রছাত্রীদের বিশ্বাস আর পূজা সমাপন একটি স্পর্শকাতর বিষয়। তেমন যৌক্তিক ব্যাপারটি আমলে নিতে সব ধরনের পরামর্শ, যথার্থ কর্মসূচী এবং অতি প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোও ভাবা জরুরী। জানি না তারিখ নির্ধারণের আগে কমিশন এ ধর্মীয় আরাধ্য বিষয়গুলো কেন আগে থেকে ভাবতে পারল না। যে কোন নাগরিকের ধর্মীয় উৎসব পালন করার অধিকার থাকে। আর আমরা জাতি হিসেবেও বিশ্বাসী। সে যে ধর্মেরই হোক না কেন? পূজা-পার্বণে দিনক্ষণ, তিথি-নক্ষত্রের নিয়ম বিধি থাকে যেখানে পেছানোর প্রশ্নই আসতে পারে না। তবে নির্বাচন যদি তার বিধিসম্মত উপায়ে একটা দিন পরিবর্তন করতে পারে সেটা যেমন ভিন্ন ধর্মের প্রতি সম্মান দেখানো হবে পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের সচেতন দায়বদ্ধতাও সবাইকে মুগ্ধ করবে। বিবেচনাটা একেবারে নির্বাচন কমিশনের। সেই জায়গায় শেষ অবধি কমিশন দায়বদ্ধতার প্রমাণও দিয়েছে। যে কোন নির্বাচনে পেশীশক্তির অপতৎপরতাকে রোধ করা আসলেই কঠিন ব্যাপার। আড়ালে, আবডালে থাকা অপরাধ চক্র হরেক রকম কর্মকৌশলে প্রার্থীদের বিভ্রান্তই শুধু নয়, আতঙ্কিতও করে তোলে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের সজাগ, সতর্ক পর্যবেক্ষণ নিজের জন্য যেমন একইভাবে দল, দেশ ও জনস্বার্থেও জরুরী। অপশক্তির প্রতাপ আর প্রভাবে যথার্থ মঙ্গলযাত্রা কোনভাবেই থেমে থাকে না। তবে তাৎক্ষণিক কিংবা সাময়িক প্রতিপত্তিতে বিপর্যস্ত করলে তাকে শক্ত প্রতিরোধ আর আদর্শিক নিষ্ঠায় ভেঙ্গে দেয়া খুব কঠিন কিছু নয়। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাবধানতায় তৎপর আছে যাতে কোন ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠতে না পারে। প্রার্থীদেরও নিজের বিপদ আর আশঙ্কাকে যথাসম্ভব পাশ কাটাতে হবে যেন কেউ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়। তবে আচরণবিধি অমান্য করার ওজর আপত্তি আসলেও কমিশন এখনও দৃশ্যত কোন ব্যবস্থা নেয়নি। দলীয় ব্যানারেও অনেক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যেই লড়াইয়ের প্রতিযোগিতায় পরস্পর বিরোধী আচরণ না মানার ব্যাপারটি উঠে আসছে। তবে এ ব্যাপারে প্রার্থীরা অভিযোগগুলো আমলে না নিয়ে তারা আইনী পথেই হাঁটছেন বলে দাবি করছেন। আবার নিজের দলের মধ্যেও বিরোধী তৎপরতা দৃষ্টিকটুভাবে দৃশ্যমান। বিরোধী প্রার্থীদের সাংগঠনিকভাবে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হলেও নির্বাচনী জোয়ারে নিজের অংশীদারিত্ব প্রমাণ করতে তারাও মরিয়া। ঘটনা, বিদ্রোহ, পারস্পরিক মতদ্বৈধতায় অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কোন্দলকে জিইয়ে রেখে প্রচারে জোর কদমে এগিয়ে যাচ্ছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে তা আরও সরগরম এবং ব্যাপকতা পাচ্ছে। ঘরে ঘরে প্রার্থীদের ভিড় এই মুহূর্তে নগরীর চলমান দৃশ্য। নির্বাচনের পুনর্নির্ধারিত তারিখ ১ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করা হলেও আর অল্প কিছু দিনের মধ্যে ভোটের প্রচারও বিধি মোতাবেক থেমে যাবে। আওয়ামী প্রার্থীরা সরকারের উন্নয়ন অভিগামিতাকে পুঁজি করে আরও অগ্রগামী ধারায় দেশকে এগিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি জনগণের মাঝে সম্প্রসারিত করছে। বিপরীতে বিএনপি বর্তমান সরকার উন্নয়নের নামে যে অধোগতি আর অরাজক পরিস্থিতির আশঙ্কাকে বাড়িয়ে তুলছে তেমন প্রচারণায় ভোটারদের সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের নতুন পথরেখা দিতেও কসুর করছে না। মূলত সব নির্বাচনেই এভাবে পক্ষে-বিপক্ষের শক্তি ভোটারদের নিজের দিকে টানতে সব রকমের কৌশল প্রয়োগ করে। আবার সরকারী দলের আশঙ্কা বিএনপি যে কোন অজুহাতে নির্বাচন বানচাল করার পাঁয়তারা করবে। বিপরীতে বিরোধীরা মনে করছে নির্বাচন একতরফা এবং সরকারী নিয়ন্ত্রণেই অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে নির্বাচন কমিশন আশ্বস্ত করেই যাচ্ছে সবার সরাসরি ভোটের অংশীদারত্বে একটি স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে তারা প্রত্যয়ী। আনন্দ, উৎসব আর স্বতঃস্ফূর্ত আমেজে এগিয়ে চলা নির্বাচনী জোয়ার তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে একটি জনবান্ধব ভোটের পরিবেশ তৈরি করতে সব ধরনের কর্মপরিকল্পনায় প্রস্তুত রয়েছে। শুধু রাজধানী নয়, সারাদেশ অপেক্ষা করে আছে ঢাকার উত্তর আর দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের উপস্থিত কার্যক্রম, ভোটারদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ এবং পরিণতিতে একটি পরিচ্ছন্ন, নির্ভরযোগ্য সুষ্ঠু ও গ্রহণনীয় ভোটের প্রত্যাশায়। লেখক : সাংবাদিক
×