ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সংসদে শোক প্রস্তাবের ওপর সাধারণ আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী

চোখের সামনে আমার হাতে গড়া মান্নানদের চলে যাওয়া বেদনার

প্রকাশিত: ১০:৪০, ২০ জানুয়ারি ২০২০

 চোখের সামনে আমার  হাতে গড়া মান্নানদের  চলে যাওয়া বেদনার

সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা সদ্যপ্রয়াত আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও এমপি কৃষিবিদ আবদুল মান্নানের অকাল মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেছেন, আমার হাতে গড়া ছাত্রনেতা, সামনে এরাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেবে, আওয়ামী লীগকে এগিয়ে নেবে। ভবিষ্যতে আমরা যখন থাকব না, এরাই আওয়ামী লীগকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমার কষ্ট হয় যখন আমার চোখের সামনে আবদুল মান্নানরা চলে যায় এটা সত্যিই অনেক কষ্টের, বেদনার। আমার হাতে গড়া ছাত্রনেতাদের এভাবে বিদায় নেয়াটা দুঃখজনক। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে রবিবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে আওয়ামী লীগের সদ্যপ্রয়াত এমপি আবদুল মান্নানের মৃত্যুতে আনীত শোক প্রস্তাবের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আবদুল মান্নানের মতো মেধাবী ও দক্ষ ছাত্রনেতার চলে যাওয়া শুধু দলের জন্য নয়, দেশের জন্যও ক্ষতির। প্রতিটা ক্ষেত্রে আবদুল মান্নান অত্যন্ত দক্ষ ও মেধাবী ছিল। ছাত্রজীবন থেকে আইয়ুব, জিয়া, এরশাদ ও খালেদাবিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় আরও অংশ নেন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, ড. মহীউদ্দিন খান আলমগীর, সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান, এবি তাজুল ইসলাম, এ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস, প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, মোসলেম উদ্দিন, উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ, নজরুল ইসলাম বাবু, আনোয়ার আবেদীন খান ও বিরোধী দলের চীফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা। আলোচনা শেষে শোক প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। প্রয়াত এমপি আবদুল মান্নানের রুহের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। পরে চলতি সংসদের এমপি আবদুল মান্নানের মৃত্যুতে রেওয়াজ অনুযায়ী স্পীকার সংসদ অধিবেশনের সব কার্যক্রম স্থগিত রেখে আজ সোমবার বিকেল সোয়া চারটা পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করেন। আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মনে একটা কষ্ট নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। পরপর আমাদের তিন এমপি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমি ’৮১ সালের ফিরে আসার পর মান্নানকে ছাত্রনেতা হিসেবে পেয়েছিলাম। ’৮৩ সালে তাকে ছাত্রলীগের সভাপতি করি। ছাত্রলীগের সভাপতি করার একটা ঘটনা আছে। যাদের ছাত্রলীগ সভাপতি করা হতো আমি তাদের একা একা ইন্টারভিউ নিতাম। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সংসদ নেতা বলেন, অনেকের ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে যখন বলছি যদি তোমাকে আমি সভাপতি না বানাই, তাহলে তুমি কি করবে? অনেকে হাউমাউ করে কেঁদে দিত। কিন্তু একটি ছেলে (আবদুল মান্নান) পেয়েছিলাম, সে বলেছিল আমাকে না বানালে কিছু করার নেই, আমি আপনার সঙ্গে রাজনীতি করে যাব। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ওকে সভাপতি বানাব। বলেন, ওই সময়টা ছাত্রলীগের খুব দুঃসময় ছিল। অনেকেই ছাত্রলীগ ছেড়ে চলে গিয়েছিল, সে ছাত্রলীগকে সে কারণে সুসংগঠিত করার খুব দরকার ছিল। আবদুল মান্নান ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পরবর্তীতে আবদুল মান্নানকে আওয়ামী লীগে নিয়ে আসি, দলের প্রচার সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে গেছে। বগুড়ার মতো জায়গায় তাকে মনোনয়ন দিয়েছিলাম। খুব কঠিন জায়গা ছিল, এলাকাটি তখন ছিল দুর্গম এবং রাস্তাঘাট ছিল না। খুবই অনুন্নত একটা জায়গা। সেখানে তাকে মনোনয়ন দিলাম। আবদুল মান্নান সেখান থেকে বিজয়ী হয়ে আসল, পর পর তিনবার সেখান থেকে সংসদ সদস্য। অতীত স্মৃতিচারণ করে সংসদ নেতা বলেন, মৃত্যুর দুইদিন আগে আবদুল মান্নান আমার সঙ্গে অনেক কথা বলল। আমাদের সেন্ট্রাল (কেন্দ্রীয়) কমিটিতে নানক (জাহাঙ্গীর কবির নানক) আসলেও সে আসতে পারেনি। বোধহয় মনে একটু দুঃখ ছিল। আমি বললাম, আমি তো তোমাদের কাউকে ফেলে দেইনি। তুমি আওয়ামী লীগে ছিলে এবং তোমাকে আমি নমিনেশন দিয়েছি, সংসদ সদস্য হয়েছ। কথা বলার সময় দেখলাম তার শরীরটা একটু খারাপ। আমি ওকে (আবদুল মান্নান) বললাম তোমার শরীর মনে হয় ভাল না, তুমি একটু ভালভাবে চিকিৎসা কর এবং চেকআপ কর। ঠিক তারপরই হাসপাতালে ভর্তি। পরদিন খবরটি পেলাম। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আবদুল মান্নান হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর প্রতিদিন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি। ডাঃ সোহরাব উদ্দিনের সঙ্গে কথা হলে সে জানাল- আবদুল মান্নানের শারীরিক অবস্থা ভাল না। আমরা কিছু করতে পারব বলে মনে হয় না। আমি বললাম, মান্নানকে বিদেশে পাঠানো যায় কিনা। জবাবে ডাক্তার বলল- তাকে বাইরে পাঠানোর মতো অবস্থা নেই। পরদিন (শনিবার) তার মৃত্যুর খবর। এভাবে পরপর তিনজন সংসদ সদস্য আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এটা খুবই কষ্টের। প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা বৈরী পরিবেশে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি এবং ধারাবাহিকভাবে সরকার পরিচালনা করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আজকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আছে বলেই বাংলাদেশের উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু এই সমস্ত ছাত্র নেতারা দুঃসময়ে বিশেষ করে পঁচাত্তরের পর বিরাট অবদান রেখে গেছেন। অনেক কাজ করে গেছেন। আবদুল মান্নান এমপি হিসেবে যখন যে কাজ নিয়ে এসেছে সবসময় সেটা করে দিয়েছি। তার অকালে চলে যাওয়া সত্যিই খুব কষ্টের, বেদনার। তিনি আবদুল মান্নানের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, আবদুল মান্নানের অকাল মৃত্যু কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। অসম্ভব সাংগঠনিক দক্ষতার পাশাপাশি ক্ষুরধার লেখক ছিলেন তিনি। ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে বৈরী অবস্থায় দক্ষতার সঙ্গে সারাদেশে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন আবদুল মান্নান। আরেক প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেন, গত বুধবারই সংসদে তার সঙ্গে কথা বলেছি। ২০০৬ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে সিঙ্গাপুরে পাঠিয়েছিলেন। ছাত্রজীবন থেকে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক, অসম্ভব স্নেহ ও ভালবাসতাম। প্রতিভাবান ছাত্রনেতা ছিলেন অকাল প্রয়াত আবদুল মান্নান। সামরিক শাসনবিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে রাজপথে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন তিনি। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ’৭৫ পরবর্তী স্বৈরাচার জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়াবিরোধী আন্দোলনে সামনের কাতারের নেতা ছিলেন আবদুল মান্নান। অসম্ভব জনপ্রিয় ও সাহসী নেতা আবদুল মান্নান রাজপথের লড়াইয়ের মাঠে সবসময় ছিলেন। কিন্তু একটু আদর্শিক বিচ্যুতির কারণে কেন্দ্রীয় রাজনীতি থেকে ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন, এটাই দুর্ভাগ্য। সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, কৃষকের ঘর থেকে উঠে আসা সন্তান আবদুল মান্নান। ছাত্রলীগকে অত্যন্ত কঠিন সময়ে নেতৃত্ব দিয়ে শক্তিশালী করেছিল এই কৃষিবিদ নেতা। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময় তাঁকে বুদ্ধি দিয়ে, সাহস দিয়ে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছেন। বগুড়ার মতো জায়গায় তিনবার এমপি হয়েছেন। ছাত্র ও রাজনৈতিক জীবনে কোনদিন আদর্শের ক্ষেত্রে আপোস করেননি। শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন নিবেদিত কর্মী ছিলেন আবদুল মান্নান। কৃষি বিদ্যালয়ে আবদুল মান্নান বিপুল ভোটে ভিপি হওয়ায় জেনারেল জিয়া তাকে হত্যার জন্য গু-াবাহিনী লেলিয়ে দেয়। আবদুল মান্নান ওই হামলায় বেঁচে গেলেও সেখানে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল আবদুল মান্নান অসম্ভব মেধাবী ও সাহসী রাজনীতিবিদ ছিল। কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে আবদুল মান্নানের সঙ্গে আমার পরিচয়। ছাত্রজীবন থেকে ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে আইয়ুববিরোধী, মহান মুক্তিযুদ্ধে এবং ’৭৫ পরবর্তী সময়ে স্বৈরশাসক জিয়ার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে ছিলেন আবদুল মান্নান। জিয়া-এরশাদকে কোনদিন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে দেননি এই লড়াকু ছাত্রনেতা। ভাল চাকরি ও বিদেশে উন্নত শিক্ষার সুযোগ পেলেও তিনি রাজনীতিকেই বেছে নিয়েছেন। বিরোধী দলের চীফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, রাজনৈতিক জীবনে কোন খবরদারি নয়, মানুষকে ভালবেসে তাদের হৃদয় জয় করতেন প্রয়াত আবদুল মান্নান। চরম বৈরী এলাকা বগুড়াতেও অসম্ভব জনপ্রিয় নেতা ছিলেন তিনি। মেধাবী, সাহসী ও সুবক্তা হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনে তার পদচারণা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, অনেকে তাকে শক্ত মানুষ ভাবলেও কোনদিন রাগান্বিত হয়ে কথা বলতে দেখিনি। আবদুল মান্নানের অসম্ভব সাংগঠনিক শক্তি ছিল। সাংগঠনিক শক্তি দিয়েই নিজের এলাকাকে আওয়ামী লীগের দুর্গ বানিয়েছেন। গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, গতানুগতিক নয়, আমৃত্যু আদর্শবাদী ও পরিপূর্ণ রাজনৈতিক সৃজনশীলতা ছিল প্রয়াত আবদুল মান্নানের মধ্যে। তিনি বিরোধী দলকে সমালোচনা করে বক্তব্য রাখতেন, কিন্তু তার মধ্যে ছিল মার্জিত ও সভ্যতার নিদর্শন। দেশাত্মবোধ, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, শেখ হাসিনার নেতৃত্ব থেকে আমৃত্যু তিনি ছিলেন অবিচল। নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, শক্ত ব্যক্তিত্বের অধিকারী ও জনপ্রিয় সাবেক ছাত্রনেতা আবদুল মান্নানের মৃত্যু দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। মুজিব আদর্শের এই অসম্ভব জনপ্রিয় এই জননেতা বগুড়ার মতো জায়গা থেকে তিন তিন বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সোনাতলা-সারিয়াকান্দিকে তিনি আওয়ামী লীগের দুর্গে পরিণত করে গেছেন। তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ছাত্রজীবনে অত্যন্ত সাহসী, ত্যাগী ও প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ ছিলেন প্রয়াত আবদুল মান্নান। নেতার মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু আদর্শের মৃত্যু নেই। আবদুল মান্নান জনবান্ধব ও কর্মীবান্ধব নেতা হিসেবে চিরদিন স্মরণীয় ও অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। গণফোরামের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ বলেন, ’৭৫ পরবর্তী চরম দুঃসময়ে ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন প্রয়াত আবদুল মান্নান। সারাদেশ ঘুরে বেরিয়ে ছাত্রলীগকে শক্তিশালী করে স্বৈরাচারী জিয়া-এরশাদবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করেছেন। জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান বলেন, চরম বৈরী সময়ে আবদুল মান্নান ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন। অসম্ভব সাহসী অনলবর্ষী বক্তা ছিলেন সংসদ সদস্য আবদুল মান্নান। দেশের রাজনীতিতে তার অকাল মৃত্যু অপূরণীয় ক্ষতি হলো।
×