ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অবশেষে চালু হচ্ছে ই-পাসপোর্ট, বুধবার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ১০:৩৬, ২০ জানুয়ারি ২০২০

অবশেষে চালু হচ্ছে  ই-পাসপোর্ট, বুধবার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বহু প্রতীক্ষিত ইলেক্ট্রনিক পাসপোর্ট বা ই-পাসপোর্ট উদ্বোধন করতে যাচ্ছে সরকার। আগামী ২২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন। এই দিন প্রধানমন্ত্রীর হাতে একটি ই-পাসপোর্ট তুলে দেয়া হবে। তবে আপাতত শুধু ঢাকার আগারগাঁও, উত্তরা ও যাত্রাবাড়ী পাসপোর্ট কার্যালয় থেকে এটি দেয়া হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী বুধবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ই-পাসপোর্ট বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন। রবিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির জন্য ইতোমধ্যে ই-পাসপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। উদ্বোধনের দিন রাষ্ট্রপতি উপস্থিত থাকবেন না বিধায় শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর হাতে ই-পাসপোর্ট তুলে দেয়া হবে। এছাড়া রাষ্ট্রপতির পাসপোর্ট বঙ্গভবনে সরবরাহ করা হবে। পরবর্তীতে আরও কয়েকজন ভিভিআইপির হাতে পাসপোর্ট তুলে দেয়া হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সর্বপ্রথম ই-পাসপোর্ট পাবেন। সবাই এ পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে পারবেন। প্রথমে উত্তরা, আগারগাঁও ও যাত্রাবাড়ী থেকে ই-পাসপোর্ট দেয়া হবে এবং পর্যায়ক্রমে সারাদেশে এ কার্যক্রম চালু হবে। এক প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ২০২০ সালের মধ্যেই সারাদেশে ই-পাসপোর্ট কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ রয়েছে সরকারের। এছাড়া বিদেশে অবস্থানরতরাও পর্যায়ক্রমে ই-পাসপোর্ট পাবেন। পাশাপাশি এমআরপি পাসপোর্ট কার্যকর থাকবে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ই-পাসপোর্ট হবে ৪৮ ও ৬৪ পাতার। আর মেয়াদ হবে পাঁচ ও ১০ বছর মেয়াদী। ৪৮ পৃষ্ঠার পাঁচ বছর মেয়াদী সাধারণ পাসপোর্ট (১৫ দিনের মধ্যে দেয়া হবে) এর জন্য ফি লাগবে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। আর সাতদিনের মধ্যে (জরুরী) পেতে হলে ৫ হাজার ৫০০ টাকা ও দুইদিনে (অতি জরুরী) পাওয়ার জন্য খরচ করতে হবে ৭ হাজার ৫০০ টাকা। একই সংখ্যক পৃষ্ঠার ১০ বছর মেয়াদী সাধারণ ই-পাসপোর্টের জন্য পাঁচ হাজার, জরুরী সাত হাজার ও অতি জরুরীর জন্য নয় হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। আর ৬৪ পৃষ্ঠার পাঁচ বছর মেয়াদী ই-পাসপোর্ট করতে লাগবে যথাক্রমে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা, জরুরী সাত হাজার ৫০০ টাকা ও অতি জরুরী ১০ হাজার ৫০০ টাকা। ৬৪ পৃষ্ঠার ১০ বছর মেয়াদী ই-পাসপোর্ট করতে লাগবে যথাক্রমে সাত হাজার (সাধারণ), নয় হাজার (জরুরী) ও ১২ হাজার (অতি জরুরী) টাকা। ই-পাসপোর্টের আবেদন অনলাইনে অথবা পিডিএফ ফরমেট ডাউনলোড করে পূরণ করা যাবে। এতে কোন ছবির প্রয়োজন হবে না। কাগজপত্র সত্যায়নও করতে হবে না। ই-পাসপোর্ট চালুর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের ১১৯তম দেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম। এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব (জন নিরাপত্তা) মোস্তাফা কামাল উদ্দিন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এবারই প্রথমবারের মতো প্রবাসী কর্মীদের ও শিক্ষার্থীদের জন্য অপেক্ষাকৃত কম টাকায় পাসপোর্ট করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের একজন নাগরিকের বৈধ পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে নির্ধারিত ফি’র পরিমাণ এতদিন সকলের জন্য সমান রয়েছে। কিন্তু বিদেশে কর্মরত কর্মী ও শিক্ষার্থীদের অন্যদের তুলনায় ফি কম রাখা হবে। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ই-পাসপোর্টের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে নানা জটিলতায় কয়েক দফা পেছাতে হয়েছে ই-পাসপোর্ট কার্যক্রম শুরুর দিন। বাংলাদেশে হাতে লেখা পাসপোর্ট থেকে যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্ট বা এমআরপি প্রবর্তনের পর এক দশকও পার হয়নি। এর মধ্যে ই-পাসপোর্ট চালু করা হচ্ছে। এমআরপির ডেটাবেজে ১০ আঙ্গুলের ছাপ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় এক ব্যক্তির নামে একাধিক পাসপোর্ট করার ঘটনা দেখা যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক ভোগান্তি কমাতে এবং একজনের নামে একাধিক পাসপোর্ট করার প্রবণতা বন্ধ করতে ইলেক্ট্রনিক পাসপোর্ট (ই-পাসপোর্ট) চালু করতে উদ্যোগী হয় সরকার। ২০১৮ সালের ২১ জুন প্রকল্পটি একনেকের সায় পায়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ওই বছরের জুলাইয়ে জার্মান কোম্পানি ভেরিডোসের সঙ্গে চুক্তি করে পাসপোর্ট ও বহির্গমন অধিদফতর। সোয়া তিন হাজার কোটি টাকায় বাংলাদেশকে ই-পাসপোর্ট ও অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করছে তারা। ই-পাসপোর্ট নামে পরিচিত বায়োমেট্রিক পাসপোর্টে স্মার্ট কার্ড প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, যাতে মাইক্রোপ্রসেসর চিপ এবং এ্যান্টেনা বসানো থাকে। এ পাসপোর্টের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাসপোর্টের ডেটা পেজ এবং চিপে সংরক্ষিত থাকে। পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাকিল আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, পৃথিবীর ১১৯তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ই-পাসপোর্টের যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে। এমআরপি আর ই-পাসপোর্টে খুব বেশি পার্থক্য নেই। তবে এমআরপির চেয়ে ই-পাসপোর্টে নিরাপত্তা বেশি। এই পাসপোর্ট কোনভাবেই কারো পক্ষে জালিয়াতি করা সম্ভব নয়। এছাড়া রোহিঙ্গাদের ডাটাবেস তৈরি হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১২ লাখ রোহিঙ্গার তালিকা পাসপোর্ট অধিদফতর তৈরি করেছে। বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতর জানিয়েছে, উদ্বোধনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ২৫ হাজার ই-পাসপোর্ট প্রিন্ট করা সম্ভব হবে। ই-পাসপোর্ট তৈরি ফ্যাক্টরি নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে ই-পাসপোর্টের ফি কত হবে তার একটি প্রস্তাব গেছে। ফি নির্ধারণ কাজ শেষ হওয়ার পথে। উদ্বোধনের পর ফুল সেট-আপের জন্য আরও কিছুদিন সময় লাগবে। ২৫ হাজার ই-পাসপোর্ট নিখুঁতভাবে প্রিন্ট করা সম্ভব হবে। ই-পাসপোর্টের যুগে নাগরিকরা চাইলে এমআরপিও করতে পারবেন, সে ব্যবস্থাও থাকবে। তবে আধুনিক পাসপোর্ট নিতেই নাগরিকরা বেশি আগ্রহী হবেন। কারণ এটি নিরাপদ ও ১০ বছর মেয়াদী। ইতোমধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ই-পাসপোর্ট গেট স্থাপন করা হয়েছে। এই গেট দিয়ে দ্রুত ইমিগ্রেশন করা হবে। সব ধরনের যন্ত্রপাতি ই-গেটে বসানো হয়েছে। জার্মানির কোম্পানি যন্ত্রপাতি স্থাপন করেছে। পাসপোর্ট অধিদফতরের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ই-পাসপোর্ট প্রবর্তন ও স্বয়ংক্রিয় বর্ডার কন্ট্রোল ব্যবস্থাপনা। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ইমিগ্রেশন চেকপোস্টগুলো স্বয়ংক্রিয় বর্ডার কন্ট্রোল ব্যবস্থাপনায় আনতে ইমিগ্রেশন চেক পোস্টগুলোতে ৫০টি ই-গেট স্থাপন করা হবে। ই-গেটে দ্রুততম সময়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাসপোর্ট রিডার ও ক্যামেরার সাহায্যে চিপযুক্ত পাসপোর্ট যাচাই, ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ফেসিয়াল রিকগনিশনের মাধ্যমে ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ হবে। ই-পাসপোর্টের তথ্য ‘ভেরিফিকেশনে’ ব্যক্তির সঠিক তথ্য পাওয়া গেলে ই-পাসপোর্ট গেট স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যাবে। এ ব্যবস্থায় ভ্রমণকারীর পরিচয় যাচাইয়ের মাধ্যমে দেশের সীমান্ত নিরাপত্তা আরও বেশি কার্যকর হবে। সীমান্ত সুরক্ষাও হবে। ই-পাসপোর্ট ই-গেটের একটি নির্দিষ্ট স্থানে রাখার সঙ্গে সঙ্গে বাহকের পরিচয় নিশ্চিত করবে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাইয়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট নিয়মে দাঁড়ালে ক্যামেরা ছবি তুলে নেবে। যদি কোন তথ্যের বিভ্রাট ঘটে তাহলে ই-গেটে লালবাতি জ্বলে উঠবে। এতে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই ই-গেটে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সঠিকভাবে ই-পাসপোর্ট ব্যবহারে সহযোগিতা করবেন। সঠিক পদ্ধতিতে ই-পাসপোর্ট ব্যবহার করে তিনি ই-গেট পার হতে পারবেন। ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ পর্যায়ে থাকলেও এখনও এর ফি চূড়ান্ত করা হয়নি। এ জন্য অধিদফতরের সবাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জাননো হয়েছে। জানা গেছে, ই-পাসপোর্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে জার্মানির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছিল। পরে বিষয়টি সমাধানের পর চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তি অনুযায়ী পাসপোর্টের ইলেক্ট্রনিক চিপে ১০ আঙ্গুলের ছাপ থাকার কথা। তবে চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রকল্প বাস্তবায়নকারী জার্মান কোম্পানি মাত্র দুটি আঙ্গুলের ছাপ সংরক্ষণ করতে চাচ্ছে। মাত্র দুই আঙ্গুলের ছাপে ভবিষ্যতে জালিয়াতি হতে পারে এমন প্রশ্ন উঠে। বিষয়টি নিয়ে অধিদফতর জার্মান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক ও চিঠি দেয়া হয়। এক পর্যায়ে বিষয়টি সুরাহা হয়। এ কারণে কিছুটা সময় বেশি লেগেছে। তবে প্রকল্প সময়ের মধ্যেই কাজটি শেষ করা হচ্ছে। ই-পাসপোর্টের জন্য নেয়া হলো প্রধানমন্ত্রীর ফটো বাসস জানায়, ইলেক্ট্রনিক পাসপোর্ট বা ই-পাসপোর্টের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফটোগ্রাফ নেয়া হয়েছে। আগামী ২২ জানুযারি থেকে ই-পাসপোর্ট প্রদান শুরু হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব কে এম শাখাওয়াত মুন জানান, ‘অভিবাসন ও পাসপোর্ট অধিদফতর (ডিপিআই) কর্তৃপক্ষ রবিবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন গণভবন থেকে তার ফটোগ্রাফ সংগ্রহ করেছে। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী ই-পাসপোর্টের জন্য একটি ডিভাইসে তার ডিজিটাল স্বাক্ষরও দেন। এ সময় ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুর রহমান খান উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২২ জানুয়ারি বুধবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ই-পাসপোর্ট বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন। ডিপিআই’র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ এর আগে বলেন, প্রথম ধাপে রাজধানীর আগারগাঁও, উত্তরা ও যাত্রাবাড়ী পাসপোর্ট কার্যালয় থেকে এটি দেয়া হবে। পরের ধাপে ধাপে সারাদেশের পাসপোর্ট কার্যালয় থেকে ই-পাসপোর্ট দেয়া হবে। জার্মান কোম্পানি ভেরিদোস জিএমবিএইচ দেশে ই-পাসপোর্ট ও ই-গেট নিয়ে কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ই-পাসপোর্ট চালুর মাধ্যমে অভিবাসন প্রক্রিয়া ত্রুটিমুক্ত করার চেষ্টা চলছে। আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান পরিবহন সংস্থা (আইসিএও)’র মতে বর্তমানে এক শ’র বেশি রাষ্ট্র ও সংস্থা (জাতিসংঘ) ই-পাসপোর্ট ইস্যু করছে এবং ৪৯ কোটি ই-পাসপোর্ট চালু রয়েছে। ই-পাসপোর্ট প্রচলিত সাধারণ পাসপোর্টের চেয়ে বেশি নিরাপদ।
×