ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

খালি গলায় অনির্ধারিত অনুষ্ঠানে অঞ্জন দত্ত

সেই চাকরিটা সেই বেলা বোস, আহা কতদিন পর!

প্রকাশিত: ১০:১২, ২০ জানুয়ারি ২০২০

সেই চাকরিটা সেই বেলা বোস, আহা  কতদিন পর!

মোরসালিন মিজান ॥ বেলা বোস ফিরে এলো। শহর ঢাকায় ফিরে এলো বেলা বোস। সেই বেলা বোস, আহা, কতদিন পর! হৃদয়ের গভীরে তাকে ময়না টিয়া পাখির মতো পুষছেন অঞ্জন দত্ত। রবিবার ঠিক সেখান থেকেই বের করলেন। গিটার ছিল না হাতে। খালি গলা। এর পরও নিজের জন্মদিনে ভক্তদের বেলা বোস উপহার দিলেন বিশ্বসভায় বাঙালীর প্রতিনিধিত্ব করে চলা অঞ্জন দত্ত। দুই বাংলার প্রখ্যাত শিল্পী শুধু গাইলেন না, ভালবাসার যেন নদী বইয়ে দিলেন! হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগালেন তিনি। আরও কত বেলা বোস বুকে নিয়ে মঞ্চের সামনে বসে ছিলেন তরুণেরা! এমনকি বার্ধক্য ছুঁয়ে দিয়েছে যাদের, যারা চাকরি পেয়েছেন, বড় মাইনে পান এখন, তারাও পেছনের দিনগুলোতে ফিরে গেলেন। খুঁজলেন তাদের বেলা বোসকে। কেউ পেলেন। কারও বাড়ল হাহাকার। বুক হু হু করে উঠলো! রবিবার জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে আনন্দ বেদনার এ কাব্য রচনা করলেন পশ্চিমবঙ্গের গানের মানুষ অঞ্জন দত্ত। এদিনের মঞ্চটি, না, গায়ক অঞ্জন দত্তের ছিল না। ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। মঞ্চের সামনে অতিথির আসনে বসে ছিলেন তিনি। তুখোড় অভিনেতা। প্রখ্যাত পরিচালক। নিজের নির্মিত সিনেমা নিয়ে উৎসবে যোগ দিয়েছেন। ফিল্মের মানুষ হয়েই বসেছিলেন তিনি। মঞ্চে তখন ঢাকার দুই শিল্পী। সিনেমার গান করছিলেন। মন দিয়ে শুনছিলেন অঞ্জন। হঠাৎ ডাক পড়ল তার। জোর দাবি উঠল, গাইতে হবে। মাথায় ক্যাপ, চোখে চেনা ফ্রেমের চশমা। গায়ে রংচটা জিন্স আর পায়ে কেডস। তা-ই নিয়ে মঞ্চে উঠে এলেন। অমনি করতালিতে ফেটে পড়ল মিলনায়তন। আগে যারা বাজাচ্ছিলেন তাদের কাছে একটি গিটারও ছিল। সেটি হাতে নিয়ে মাইকের সামনে দাঁড়াতেই বেলা বোসের প্রেমিক পুরুষটিকে শতভাগ দেখা গেল! এই তো অঞ্জন দত্ত! এই তো...। ভক্ত অনুরাগীদের মধ্যে তখন গায়ক অঞ্জন দত্তের জয়জয়কার। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড বাজানোর চেষ্টা করে প্রিয় গিটার হাত থেকে নামিয়ে রাখলেন তিনি। বোঝা গেল, টিউন হচ্ছে না। সময়ও হাতে নেই। অতঃপর খালি গলায় সুর তুললেন শিল্পী। দিনটি, আগেই বলা হয়েছে, বিশেষ ছিল। জন্মদিন ছিল অঞ্জন দত্তের। এমন দিনে নিজের অনুভূতিই যেন গানে প্রকাশ করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের অমর সঙ্গীত বেছে নিয়ে সবার উদ্দেশে বলেন, চলুন, সবাই মিলে গাইব। তারও আগে প্রস্তুত ছিলেন শ্রোতা। সম্মিলিত কণ্ঠ বেজে উঠতে সময় নিল না। সবাই মিলে গাইলেন: পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।/ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়...। মঞ্চের পুরোটা ঘুরে অঞ্জন গাইছিলেন। তেমনি দিচ্ছিলেন নির্দেশনা। হাতে সেই ছড়িটা ছিল না। তবুও মনে হচ্ছিল অর্কেস্ট্রা বেজে চলেছে। অদ্ভুত সে দৃশ্য। ‘আয় আর একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।/মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়...।’ সত্যি প্রাণের মাঝে এলো প্রাণ। পূর্ব বঙ্গ, পশ্চিম বঙ্গ, বাঙালী, রবীন্দ্রনাথ, অঞ্জন দত্তÑ সব এ গানের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল। এর পররই বিদায় নিতে চেয়েছিলেন গায়ক। চাইলেই হবে? বেলা বোস তো অঞ্জনের হাত ধরেই ছিল। কল্পনার চোখে দর্শক তা ঠিক দেখছিলেন। তার কথা হবে না? হতেই হবে। তুমুল চিৎকারে দাবির কথা জানাতে থাকে মিলনায়তন। অগত্যা বিপদটা কোথায় পরিষ্কার করেন গায়ক। মেঝেতে রাখা গিটারের দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল তুলে তিনি বলতে শুরু করেন, দ্যাট গিটার হ্যাজ টু বি টিউন। আই ক্যান নট টিউন দিজ রাইট নাউ। হাউ...। কথা শেষ করতে পারলেন না। অনেকের পক্ষে এক ভক্ত দাঁড়িয়ে গেলেন। চড়া স্বরে বললেন, কোন কিছুর দরকার নেই। আমরা বহুবার শুনছি। আপনি শুধু গাইলেই হবে। কথা শুনে শিল্পীও ভীষণ খুশি হলেন। আশ্বস্ত বোধ করলেন। খালি গলায় গান ধরলেন তিনি: চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছ/এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না/সমন্ধটা এই বার তুমি ভেস্তে দিতে পার/মাকে বলে দাও বিয়ে তুমি করছ না...। এত বুড়ো হয়ে গেছে লোকটা। কণ্ঠটা এক আছে। আবেগে ভরা। গিটারের চেয়েও বেশি মিষ্টি বাজে। বেজে যায়। সাউন্ড কোন সহযোগিতা করছিল না। অঞ্জন করতালিকেই সঙ্গী করে গেয়ে চলেন। গাইতে গাইতে ছেড়ে দিচ্ছিলেন তিনি। যেখানে ছাড়ছিলেন সেখান থেকেই ভক্তরা গাইছিলেন: চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা সত্যি/আর মাত্র কয়েকটা মাস ব্যাস/স্টার্টিং এই ওরা ১১০০ দেবে তিন মাস পরে কনফার্ম...। অঞ্জন গাইছিলেন, চুপ করে কেন বেলা কিছু বলছ না...। শ্রোতারা অনেকটা জবাব দেয়ার মতো করে গাইলেন, এটা কি ২ ৪৪ ১১ ৩৯...। এভাবে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের মঞ্চ অঞ্জনের গানের মঞ্চ হয়ে গেল। গাইতে না এসে এমন গাওয়া, এমন মন জয় করে নেয়া, বলার অপেক্ষা রাখে না অঞ্জন দত্তের পক্ষেই সম্ভব।
×