ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

সমতল ভূমিতে কমলার বাণিজ্যিক সফলতা

প্রকাশিত: ১২:১৪, ১৯ জানুয়ারি ২০২০

সমতল ভূমিতে কমলার বাণিজ্যিক সফলতা

কমলা বিদেশী ফল। দেশীয় চাহিদার প্রায় সবটাই আমদানি করা হয়। দেশের পঞ্চগড়ে, পাহাড়ী এলাকায় খুব সামান্য পরিমাণ কমলা উৎপাদিত হয়। যদিও তা খেতে সুুস্বাদু নয়। আকারেও ছোট। সম্প্রতি মহেশপুর উপজেলার চাপাতলা গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম দার্জিলিং, ম্যান্ডারিন জাতের কমলা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে সফল হয়েছে। উন্মোচিত হয়েছে সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত। রফিকুলের পেশা নার্সারী ব্যবসা। ২০০২ সাল থেকে তিনি নার্সারী ব্যবসা করছেন। চ্যানেল আইতে পিরোজপুরের ডাকাতিয়া গ্রামের রেবুতি শিকদারের মাল্টা বাগান নিয়ে প্রতিবেদন প্রচারিত হয়। রফিকুল জানান, এ প্রতিবেদন দেখে তিনি উৎসাহিত হন। শুরুতে মাল্টা আর পেয়ারা বাগান করেন। একবার রফিকুল দার্জিলিং গিয়েছিলেন। সেখানের কমলা দেখে তার কৌতূহল বাড়ল। তিনি সেখানকার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেন। দেশে ফিরবার সময় ২০০ কমলার চারা নিয়ে এলেন। পেয়ারা, মাল্টা পাশাপাশি কমলার গাছ লাগিয়ে দিলেন। পাড়া প্রতিবেশীরা রফিকুলের কমলা গাছ দেখে বলেছিলেন, এই তুমি কি করেছ। এসব হবে নাকি? ফেলে দাও। মাল্টার গাছ লাগাও। দার্জেলিং থেকে ২০০ কমলার চারা আনলেও ৬০টি নষ্ট হয়ে যায়। ১৪০টি লাগানো হয়। আমি নিশ্চিত ছিলাম না। কমলার গাছ হবে। একদিন মাল্টা গাছের কাজ করতে করতেই কমলা গাছে ফুল দেখলাম। এরপর ফল। এভাবেই শুরুর গল্পটা বলছিলেন রফিকুল। শুরুতে চার বিঘা ছিল। এখন আরও পাঁচ বিঘায় কমলার চাষ সম্প্র্রসারণ করেছেন তিনি। সময়টা ছিল ২০১৬ সাল। মাত্র তিন বছরে কমলা চাষে রফিকুল বিস্ময়কর সফলতা পেয়েছেন। কমলা চাষের বাণিজ্যিক সম্ভাবানা প্রচুর। রফিকুলের আয় ব্যয়ের হিসাব দেখলে সেটাই প্রমাণিত হয়। তার কাছেই জানা গেল ১৪০টি কমলার চারা ক্রয়, রোপণ, পরিচর্যায় সব মিলিয়ে তার খরচ পঞ্চাশ হাজার টাকার মতো। তিনি আশা করছেন ১০০ মণ কমলা পাওয়া যাবে। কম হলেও যার বাজার মূল্য হবে ৫ লাখ টাকা। এ বছর যা ফলন হয়েছে। পরের বছর ফলন আরও বেশি হবে। কারণ কমলা গাছ বড় হলে ফলনও বাড়ে জানাল রফিকুল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১০৮৮ কোটি টাকার কমলা আমদানি করা হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আমদানি করা ১ লাখ ২ হাজার টন কমলা। রফিকুল বলছিলেন, আগামী দশ বছরে এই আমদানী নির্ভরতা শূন্যের কোটায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে। পাশাপাশি কমলার ফতানিও করা সম্ভব হবে। এলাকাবাসীর কাছে রফিকুলের পরিচিতি এখন কমলা রফিক নামে। রফিকুলের দেখাদেখি অনেকেই কমলার চাষ করেছেন। ৩০ হাজার কমলার চারা উৎপাদন করেছেন রফিকুল। তিনি জানান, দেড় ফুট উচ্চতার কমলার চারা ১৫০ টাকা, দুই ফুট উচ্চতার কমলার চারা ২০০ টাকায় বিক্রি করছেন। রফিকুলের কাছ থেকে কমলার গাছ যারা দেন। তাদের পরবর্তীতে পরিচর্যা সংক্রান্ত সহায়তা তিনি করেন। সমতল ভূমিতে কমলার চাষ। সম্পূর্ণ নতুন। পরিচর্যায় কোন চ্যালেঞ্জ নেই তো? মুচকি হেসে রফিকুল বলেন, কমলা গাছের পরিচর্যা বলতে তেমন কিছু নেই। পেয়ারা, মাল্টার চেয়েও সহজ। মাঝে মধ্যে ডাল কেটে দেই, এই তো। ৩ বছর পর একটি গাছ ফল ধরার জন্য পরিপূর্ণতা লাভ করে। প্রতিটি গাছ থেকে ১২ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত ভালভাবে ফল পাওয়া যাবে। কমলা চাষের উপযুক্ত মাটি ও আবহাওয়া আমাদের রয়েছে বলে তিনি জানান। কৃষি বিভাগের উপ-সহকারী কর্মকর্তা রবিউল কবীর বলেন, আমরাও ভাবতে পারিনি। রফিকুল কমলা উৎপাদনে এতটা সফল হবে। কৃষিবিভাগ প্রয়োজনীয় বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সব সময় তার পাশে রয়েছে। রফিকুল পেয়ারা ও মাল্টা চাষে সফল হয়েছেন। ইতোমধ্যে পেয়ারার গাছ থেকে ১০ লাখ টাকার পেয়ারা বিক্রি করেছেন। একই সময় ৬ লাখ টাকার মাল্টা আর ২ লাখ টাকার কমলা বিক্রি করেছেন। এ ছাড়া এখান থেকে কলম পদ্ধতিতে উৎপাদিত চারা বিক্রি করেছেন প্রায় ৫ লাখ টাকার। ছোট ছোট গাছ। রঙিন টসটসে কমলা ঝুলে আছে। পাতার চেয়ে ও যেন কমলা বেশি। এমন দৃশ্য স্বপ্ন হলেও এখন সত্যি। চর্ম চক্ষেই দেখা সম্ভব। রফিকুল জানান, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য মানুষ তার বাগান দেখতে আসে। সাধ্যমত রফিকুল তাদের আতিথেয়তাও করেন। সামিনা জামান নামে এক নারী দর্শণার্থী বলেন, এত সুন্দর সুস্বাদু কমলা দেশে হচ্ছে। কমলা বাগান দেখে আমি অভিভূত। মিষ্টি দার্জিলিং কমলা খেয়ে পরান জুড়িয়ে গেছে। ফল মানেই যখন রাসয়নিক এর ব্যবহার। রফিকুলের কমলা এসব এর একদমই বাইরে। ক্ষতিকারণ কোন কীটনাশক তিনি ব্যবহার করেন না বলে জানা গেল। রফিকুলের মাধ্যমে দেশের সমতল ভূমিতে কমলার চাষ ছড়িয়ে পড়ছে। ক্ষুদ্র কৃষক রফিকুল ইসলাম এতেই খুব খুশি। তবে তার ইচ্ছে দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীকে তিনি তার বাগানের কমলা খাওয়াতে চান। রফিকুল বলেন, টিভিতে একবার দেখেছি, এক কৃষক প্রধানমন্ত্রীকে তার বাগানের বড়ই উপহার দিয়েছেন। রফিকুলের স্বপ্ন পূরণ হোক। সমতল ভূমিতে কমলা উৎপাদনে তার সফলতা অন্যদের পথ দেখাবে। কমলা উৎপাদনে দেশীয় চাহিদা মিটবে উপরন্তু রফতানি করা যাবে। এমনটাই আশা করা যায়।
×