ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিহির কুমার রায়

এন্টি ভেইন তৈরিতে সাপের চাহিদা অতুলনীয়

প্রকাশিত: ১২:১৪, ১৯ জানুয়ারি ২০২০

এন্টি ভেইন তৈরিতে সাপের চাহিদা অতুলনীয়

সাপ নিয়ে অনেক পৌরাণিক কাহিনী ইতিহাসের আদি পূর্বে উল্লেখিত আছে। সাপ পূজা, সাপ বন্দনা, সাপ লালন, সাপ চাষ, সাপ শিক্ষা, সাপ গবেষণা, সাপ ব্যবসা ইত্যাদি যুগে যুগে সময়ের আবর্তে অনেক রূপান্তর ঘটেছে সত্যি কিন্তু পালিত প্রাণী হিসাবে তার অর্থনৈতিক গুরুত্ব থাকলেও সমাজব্যবস্থায় তুলনামূলক বিচারে এই বিষয়টি তেমন উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিতে পারেনি শিক্ষায় কিংবা গবেষণায়। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রাণী বিদ্যা বিভাগে অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে সর্পের শিক্ষা কিংবা গবেষণা পাঠ্যসূচীতে থাকলেও কোন গবেষক সাপ নিয়ে গবেষণা করে স্নাতকোত্তর, এমফিল কিংবা পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেছে তেমনটি দেখা যায় না। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণী বিদ্যা বিভাগের সাবেক গবেষক ও রিয়াদ চিড়িয়াখানার সাবেক কিউরেটর অধ্যাপক ড. আলী রেজা খান সাপ নিয়ে অনেক গবেষণাধর্মী পুস্তিকা কিংবা প্রবন্ধ রচনা করলেও তার ফলাফলের ভিত্তিতে কতগুলো প্রায়োগিক গবেষণা প্রকল্প কিংবা একশন প্রোগ্রাম প্রণীত হয়েছে তা বলা যায় না কেবল মাত্র উদ্যোগী গবেষক, কর্মসূচী সংগঠক ইত্যাদির অভাবের কারণে। অথচ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে, কর্মসংস্থানে, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরিতে, বিনোদনের খোরাক যোগাতে, রফতানি বাণিজ্যে, চামড়ার পণ্য তৈরিতে, ওুষধ তৈরীতে, সাপের অবদান কোনভাবেই খাট করে দেখার কোন সুযোগ নেই। এন্টি ভেইন তৈরিতে সাপের বিষের চাহিদা অতুলনীয় আবার গোবড়া সাপ থেকে পটাশিয়াম সাইওনাইট সংগ্রহ করে ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। সাপের বিষের চাহিদা আন্তর্জাতিক বাজারে রয়েছে যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি বড় বাহক হতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষত জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাপ মাংস ও সাপ ডিম সুস্বাদু পুষ্টিকর খাদ্য হিসাবে খাদ্য তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এতসব গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও সাপ আতঙ্ক ও সাপ নিধন যেন আমাদের জীবনে এমন শিকড় গেড়ে বসেছে যে সাপ দেখলেই আতঙ্ক আর নিধন ছাড়া মনে হয় তা আর সমাপ্তি ঘটবে না। কিন্তু এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো তার একটি আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণের প্রয়োজন। অন্যান্য গৃহপালিত পশুর মতো সাপকে পোষার অনেক প্রক্রিয়া এই উপমহাদেশে বিশেষত পাহাড় জঙ্গল বেষ্টিত অঞ্চলগুলোতে রয়েছে। যেমন কোন সাপুড়েকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় কৌশলগত দিকে নিয়ে তখন সে বলবে আমি ভারতের অসম রাজ্যের কামরুপ জেলা থেকে সাপ বিদ্যায় প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছি অর্থাৎ সর্ব বিদ্যা যে একটি পাঠ্যসূচীর বিষয় এখান থেকে তা অনুমান করা যায়। সে যাই হোক না কেন বাংলাদেশে বর্তমানে বর্ষাকাল কেবল আষাঢ় কিংবা শ্রাবণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অর্থাৎ বর্ষাকাল এখন আগের চেয়ে বেশি বিস্তৃত এবং এই সময়টিতে সাপ লোকালয়ের দিকে মানুষের বাড়ি কিংবা গাছে আশ্রয় নেয়। অনেকে আবার সর্পের বন্দনা করে থাকে বিশেষত সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মনোষা পূজার মাধ্যমে শ্রাবণ মাসে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে। সারা মাস মনোষা পূজার পুঁথি পাঠ করা হয় যা প্রণীত পুস্তকে উল্লেখ রয়েছে যার জন্য বিশেষ পারদর্শিতার প্রয়োজন হয়। কালীপূজা কিংবা শিবপূজা কিংবা দুর্গা দেবীর পূজায় সাপকে বাহক হিসাবে দেখা যায় যার ধর্মীয় মূল্য অনেক বেশি। তাই সাপ নিধন সনাতন ধর্মমতে শ্রাবণ মাসে একেবারেই নিষিদ্ধ। অনেক ক্ষেত্রে সাপ সন্ন্যাসীদের চিকিৎসার বাহক হিসাবে কাজ করে থাকে। এই সকল পৌরাণিক বিষয়ের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কি তা নিয়েও অনেক কথোপকথন রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই কর্মকা-গুলোকে কেবল সাপুড়ে কিংবা ওঝা কিংবা বেদেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে যদি ব্যবসা উদ্যোগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করা যায় তবে এই লাভজনক পেশায় অনেকেই সাপ খামার নির্মাণে এগিয়ে আসবে বলে প্রতীয়মান। তা হলে ব্যবসায়ের উপাদান হিসাবে এই প্রাণীটির বাংলাদেশে বর্তমান অবস্থা কি তা নিয়ে আলোকপাত করা যাক। আইইউসিএন বাংলাদেশের সম্প্রতিক গবেষণা বলছে দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ বন্য প্রাণী হুমকির সম্মুখীন বিশেষত মানুষ সৃষ্ট সর্পের বাসস্থান বনভূমি ঝোপঝাড় ধ্বংসের কারণে। বাংলাদেশে প্রাণী গবেষক আব্দুর রাজ্জাকের মতে দেশে প্রায় ৯০ প্রজাতির সাপের মধ্যে ২৭ প্রজাতি বিষাক্ত যার মধ্যে ১৩টি সমুদ্রে বসবাস করে, বাকিগুলো স্থলে যাদের বেশিরভাগের অবস্থান সিলেট-চট্টগ্রামের গভীর বন-জঙ্গলে। দেশে দক্ষ সাপুড়ের সংখ্যা কত তা নিয়ে কোন পরিসংখ্যান সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে নেই যা প্রয়োজনমাফিক ব্যবহার করা যাবে অর্থৎ বংশানুক্রমে পাওয়া সাপুড়ে বিদ্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের যে সনাতনী দক্ষতা রয়েছে এবং তার সঙ্গে যদি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি যোগ করা যায় তা হলে এটি একটি উন্নত ব্যবস্থা হতে পারে। কিন্তু বাদসাধে আমাদের সমাজব্যবস্থা, সাপুড়ের ছেলে-মেয়েরা এখন আর সাপুড়ে হতে চায় না কারণ এই কাজের শৈল্পিক কোন অর্থনৈতিক মর্যাদা নেই অথচ ব্যবসায়িক উৎপাদন হিসাবে এর অনেক সম্ভাবনা রয়েছে যা এখন সময়ের দাবি। একজন সাপুড়েকে প্রশ্ন করা হয় সাপ শীকারের কৌশল সম্পর্কে এবং অনায়াসেই সে বলে ফেলতে শুরু করে যে মাটির গন্ধ থেকে বোঝা যায় এলাকায় সর্পের অবস্থান আছে কি নেই। যদি বিষয়টি ইতিবাচক হয় তবে মন্ত্রের মাধ্যমে সাপকে গর্তের ভেতর থেকে বাহির করা সম্ভব হয়। এখন প্রশ্ন এভাবে সাপ ধরে কি হবে, এ সকল সর্পের সংগঠিত বাজার কি? কে বা কারা এর দায় ভার নেবে? এই বিষয়গুলো এখনও অস্পষ্ট অথচ কিছু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সাপুড়ের কাছ থেকে সর্পের মহামূল্যবান বিষ কিংবা চামড়া কিনে বিদেশে পাঁচার করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে যা হঠাৎ খবরের কাগজে পাওয়া যায়। তাহলে সরকার সর্পের বাজারকে উন্মোক্ত করছে না কেন? কেন সাপ খামার প্রতিষ্ঠায় প্রণোদনাসহ লাইসেন্স প্রদানে আগ্রহী নয়? তবে বেসরকারী উদ্যোগে সাপের খামারের দু’একটির খবর পাওয়া যায় যেগুলো সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে খুব ভাল করে উঠতে পারছে না। এই রকমই একজন উদ্যোগক্তা পটুয়াখালীর সদর উপজেলার নন্দীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ৫০ বছর বয়সী আব্দুর রাজ্জাক যিনি বেশ কয়েক বছর বণ্যপ্রাণী ফটোগ্রাফার হিসাবে সৌদি আরবে কাজ করেন। সেই সুবাদে বণ্যপ্রাণীর প্রতিকার তার আগ্রহ প্রবল হয়ে উঠে যার বহির্প্রকাশ ঘটে ২০০১ সালে। সৌদি আরব থেকে ফিরে আসার পর স্বীয় বাড়িতে সাপ খামার প্রতিষ্ঠার একটি পরিকল্পনা করেন যা বাস্তবায়িত হয় ২০০৯ সালে। এই উদ্যোগক্তা ২৫ লাখ টাকার নিজস্ব তহবিল থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নমুনার একশত পঞ্চাশটি সাপ সংগ্রহ করে খামার শুরু করে। বর্তমানে সাপ ডিমের তা দিয়ে আরও একশ’ পঞ্চাশটির নতুন বাচ্চা খামারে সংযোজিত হয়। সরকারের প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ব্যক্তি মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত খামারটির প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেয় ২০০৮ সালে। আবার সাপের বিষ (াবহড়স) ব্যবসায়িকভাবে বিক্রির জন্য ২০১১ সালে সরকারের কাছে অনুমোদন চেয়ে আবেদন করা হয় যা এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়নি। যদি অনুমোদন মেলে তা হলে একশ’ পঞ্চাশটি পরিপক্ক সাপ থেকে বিষ আহরণ করে প্রতি মাসে সাত কোটি টাকা আয় করা সম্ভব হবে। এরইমধ্যে অনেক ওষুধ কোম্পানি সাপের বিষ ক্রয়ের আগ্রহ দেখিয়েছে যা অল্প বিনিয়োগে অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। এই খামারে মোট প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত চাকরিজীবীর সংখ্যা আট এবং সরকার যদি প্রশিক্ষণসহ বিনিয়োগ সহায়তা দিতে পারে তাহলে এই লাভজনক ব্যবসায় অনেক উদ্যোগক্তা আগ্রহ দেখাবে। সরকার সাপ খামার আইন প্রণয়ন করতে পারে এই শিল্পের মান উন্নয়নের জন্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষত ভারত, চীন, থাইল্যান্ড ও যুক্ত রাজ্যে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সাপ খামারকে একটি লাভজনক অর্থনৈতিক কর্মকা- হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সেই সকল দেশের সফল অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ এই শিল্পকে উজ্জীবিত করতে পারে। এ ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। কৃষির উপখাত হিসাবে এই খাতটি তুলনামূলক বিচারে অনেক পশ্চাৎপদ যা বর্তমান বছরের বাজেট প্রস্তাবনা থেকেই বুঝা যায় যা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মিলে উন্নয়ন বাজেট মাত্র এক হাজার পনেরো কোটি টাকা যার বেশিরভাগ প্রাণীর খাদ্য ও ভ্যাকসিন আমদানিতে ব্যায়িত হবে। তাহলে প্রাণীর খামার উন্নয়ন বা আধুনিক খামার স্থাপন বিশেষত সাপকে ঘিরে সে অর্থ কোথায়? প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন একটি এনজিও যারা প্রকৃতির প্রাণীজগত নিয়ে আকর্ষণীয় সংবাদ প্রচার করে যার মধ্যে সাপ একটি উল্লেখযোগ্য দিক এবং এই প্রচার মাধ্যমে কেবল তাদের ক্ষয়িঞ্চু বিলুপ্তির দিকগুলো তুলে ধরে। অথচ এটিকে হৃদয়ে মাটি ও মানুষর মতো একটি উদ্বুদ্ধমূলক অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত করা যায় যেখানে প্রাণী উদ্যোগক্তারা আরও খামারমুখী হবে এবং ব্যাংকিং খাত বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। কিন্তু সমস্যা হলো প্রকল্প তৈরি নিয়ে কারণ বাংলাদেশে সাপ বিশেষজ্ঞের যথেষ্ট অভাব রয়ে গেছে যারা সাপের স্বভাব প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত। প্রকৃতিগতভাবে সাপ সরীসৃপ জাতীয় নিরীহ প্রাণী যারা বুকে ভর দিয়ে হাটে এবং বনের লতাপাতা, পোকামাকড়, ব্যাঙ, ইঁদুর ইত্যাদি খেয়ে বেঁচে থাকে। গবেষকরা বলেন একটি সাপ যে শক্তির সঞ্চার করে তা পাঁচটি মানুষের শক্তির সমান। এই প্রাণীটি কোনভাবে বিরক্ত না হলে তারা মানুষ কিংবা অন্য প্রাণীকে আক্রমণ করে না।
×