ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

উদ্যোগ নেয়ার দিন বৃহস্পতিবারই ডিএসইর সূচক বেড়েছে ৮২ পয়েন্ট;###;২৬ লাখের মতো সাধারণ বিনিয়োগকারী আবার আশার বীজ বুনছেন

শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ১১:১১, ১৯ জানুয়ারি ২০২০

শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা

অপূর্ব কুমার ॥ শেয়ারবাজারে টানা পতনে বাজার সংশ্লিষ্টরা যখন কোন কূলই পাচ্ছেন না তখনই পতনের রাশ টেনে ধরতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগ নিলেন। আর তাতেই পতন থেকে বড় উত্থানের মধ্য দিয়ে ফিরে আসছে শেয়ারবাজারের সূচক। সেইসঙ্গে আশার বীজ আবার বুনতে শুরু করেছেন ২৬ লাখের মতো সাধারণ বিনিয়োগকারী। বিনিয়োগকারীদের আশা এবার তারা হারানো পুঁজি ফিরে পাবেন। এই উদ্যোগের সুফল মিলেছে হাতেনাতেই। উদ্যোগ নেয়ার দিন বৃহস্পতিবারেই প্রধান বাজার ঢাকা স্টক একচেঞ্জের সূচক এক লাফে বেড়েছে ৮২ পয়েন্ট। চলতি সপ্তাহেও সূচকের উর্ধগতি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। শেয়ারবাজার চাঙ্গা করতে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছয় নির্দেশনার আলোকে ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তারল্য সঙ্কটে থাকা শেয়ারবাজারকে নগদ টাকার সাহায্য দিতে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তাদের মধ্যে জরুরী বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই বৈঠকে আইনী সীমার মধ্য থেকে শেয়ার কেনার আদেশ দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় বৃহস্পতিবারই একটি ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হয়েছে। চলতি সপ্তাহেই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীও শেয়ার কিনতে শুরু করবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের। স্বল্পমেয়াদী যেসব কর্মসূচী অবিলম্বে বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- শেয়ারবাজারে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। মার্চেন্ট ব্যাংকসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে। আইসিবির বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এর বাইরে শেয়ারবাজারের মাধ্যমে ক্রয় চাহিদা বাড়াতে বিদেশীদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে এবং দেশীয় বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেয়ারও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা ছাড়াও ভাল শেয়ারের জোগান বাড়াতে বহুজাতিক এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন লাভজনক কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। শেয়ারবাজার সঙ্কট সমাধানে নীতিনির্ধারকদের নিয়ে জরুরী বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তারা ছাড়াও বিএসইসির চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা উপস্থিত ছিলেন। সূত্র জানায়, বৈঠকে সঙ্কট সমাধানে শেয়ারবাজারের দরপতন ঠেকাতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার ব্যাংক সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালীকে শেয়ার কিনতে তাৎক্ষণিক নির্দেশনা দেয়া হয়। এর বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়ার নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বেলা ১২টায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী, বিএসইসির চেয়ারম্যান এবং সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকেই পুঁজিবাজার গতিশীল ও উন্নয়নের লক্ষ্যে কতিপয় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচীর বিষয়ে আলোচনা হয়। স্বল্পমেয়াদী বেশকিছু সিদ্ধান্ত অচিরেই বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিএসইসির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়েছে, এসব নির্দেশনা সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বাস্তবায়ন করবে। তাৎক্ষণিক এসব পদক্ষেপের পাশাপাশি শেয়ারবাজারের দীর্ঘমেয়াদী সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানে পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। আইন অনুযায়ী কোন বাণিজ্যিক ব্যাংক তার মূলধনের বিপরীতে এককভাবে (সলো বেসিস) ২৫ শতাংশ এবং সহযোগী কোম্পানির (কনসলিডেটেড বেসিস) বিনিয়োগসহ মূলধনের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। বর্তমানে এ চার ব্যাংকের বিনিয়োগ আইনী সীমার মধ্যে আছে। বাজার মূল্যে ব্যাংকগুলোর নতুন করে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ছাড়া অন্য সব তফসিলী ব্যাংকেরও বিনিয়োগ সীমার নিচে শেয়ার কেনা রয়েছে। কিন্তু আস্থার সঙ্কটের কারণে ব্যাংকগুলো শেয়ার কিনে নাই এত দিনে। কিন্তু আস্থার সঙ্কট কেটে গেলে প্রতিষ্ঠানগুলোও শেয়ার কিনবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে ১০ হাজার কোটি টাকা সহজ সুদে ঋণ আবেদন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে। সরকার ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও ঠিক কিভাবে ঋণ দেয়া হবে এবং আদৌ কত টাকা দেয়া হবে সেই বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও বলেছিলেন, শেয়ারবাজারের জন্য ঋণ দেয়ায় ঝুঁকি নেই। কারণ এর আগে শেয়ারবাজারের জন্য প্রদান করা ঋণ সুদসহ প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই পরিশোধ করেছে। এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ওপর চাপ কমাতে এই আদলে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডকে (বিডিবিএল) ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বিশেষায়িত এই প্রতিষ্ঠান আইসিবির মতো শেয়ারবাজারকে নীতিগত সহায়তা দেবে বলেও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শেয়ারবাজারকে একক কোন প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরতা কমানোর অংশ হিসেবে বাজার সংশ্লিষ্টদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এমনটি করা হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আগামীকাল সোমবার রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশে (আইসিবি) এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিব মাকসুরা নূরের সভাপতিত্বে সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মোঃ মাসুদ বিশ্বাস, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক মোঃ সাইফুর রহমান, ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উপস্থিত থাকবেন। অতীতে দেখা গেছে, শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলো সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে একে অপরের ওপর দোষ চাপাতে ব্যস্ত থাকত। কিন্তু গত কয়েকদিনে সেটি করতে দেখা যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মতো শীর্ষ স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজার ইস্যুতে একযোগে কাজ করছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আস্থা ও তারল্য সঙ্কটে তলানিতে নেমেছে দেশের শেয়ারবাজার। বাজার আরও খারাপ হবে এই শঙ্কায় শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজার ছাড়ছেন দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। ব্রোকারেজ হাউস থেকে বিনিয়োগকারীরা নেমে এসেছেন রাস্তায়। এরপর জাতীয় সংসদে পুঁজিবাজারের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী পুঁজিবাজারের উন্নয়নে আইসিবিকে আরও সক্রিয় করা এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারে আকৃষ্ট করাসহ ছয়টি উদ্যোগ নিয়েছেন। নাজমুল ইসলাম নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, দীর্ঘ ১০ বছর ধরে একটি দুটি পোর্টফলিও পরিচালনা করছেন তিনি। তার একটি পোর্টফলিওতে কিছুদিন আগেও ৫ লাখ টাকার বেশি পুঁজি ছিল। দরপতনের কারণে সেটি এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র দেড় লাখ টাকায়। অন্য একটি পোর্টফলিওতে জেড ক্যাটাগরির শেয়ার কেনার কারণে ফোর্স সেল না আসার কারণে কিছুটা ইতিবাচক ছিল। ফলে সেখানে দেড় লাখ টাকার বিনিয়োগ তুলনামূলক কমেছে। সেখানকার পোর্টফলিওতে এক লাখ ২০ হাজার টাকার শেয়ার রয়েছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা দেয়া পদক্ষপেগুলো বাস্তবায়ন হলে সেগুলো ইতিবাচক। তবে কতটুকু বাস্তবায়ন হবে তা দেখার বিষয়। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী সু-দৃষ্টি দিলে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবেই। ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিলে পুঁজিবাজার ভাল হবেই। তবে একটি স্থিতিশীল পুঁজিবাজারের জন্য সুশাসন সবচেয়ে বেশি জরুরী বলে তিনি মনে করেন।
×