ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর হবে বিসিআইসি ॥ চেয়ারম্যান হাইয়ুল কাইয়ুম

দুই বছরেই সারে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৯:৩৯, ১৯ জানুয়ারি ২০২০

দুই বছরেই সারে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে বাংলাদেশ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ আগামী দুই বছরের মধ্যেই সারে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যে দেশে সারের চাহিদা মেটাতে স্থানীয় কারখানায় উৎপাদন বাড়াতে নতুন কারখানা স্থাপন করছে সরকার। একই সঙ্গে সংরক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) এ জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করেছে। সংস্থার চেয়ারম্যান হাইয়ুল কাইয়ুম জানান, বিসিআইসি নানা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশের চাহিদার সব সার উৎপাদন সম্ভব হবে। পাশাপাশি সঠিকভাবে সার সংরক্ষণ সম্ভব হবে। এ কাজ বেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। তিনি আশা করছেন, নতুন পদক্ষেপে লোকসানের ধারা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে। আগামী দুই বছরে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর হবে বিসিআইসি। জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন চাহিদার মধ্যে প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ উৎপাদন হয়। বাকি চাহিদা স্থানীয়ভাবে মেটাতে নতুন একটি সার কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করেছে সরকার। আরও একটি নতুন সার কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা চলছে। নতুন কারখানা চালু হলে প্রায় ২০ লাখ টন সার উৎপাদন বাড়বে। তখন দেশী সার দিয়ে চাহিদা মিটবে। আমদানি করা লাগবে না। এছাড়া খোলা আকাশের নিচে নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করতে ৪৭ জেলায় সারের গুদাম নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি হলে নষ্টের পরিমাণ কমবে। বিসিআইসি সূত্রে জানা যায়, দেশের পুরোনো সার কারখানাগুলো বছরের বেশিরভাগ সময় বন্ধ ও অচল থাকায় বড় অঙ্কের লোকসান গুণতে হয়। এসব কারখানা সংস্কারে ব্যয় করে শুধু লোকসান বাড়ছে। এ কারণে সংস্কার ব্যয় না বাড়িয়ে নতুন করে কারখানা স্থাপনে নেমেছে বিসিআইসি। সংস্থাটি ইতোমধ্যে শাহজালাল সার কারখানা নতুন করে চালু করেছে। তা ছাড়া প্রায় ১০ লাখ টন উৎপাদন সক্ষমতার ঘোড়াশাল-পলাশ সার কারখানায় জাপানী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে নতুন করে উন্নয়ন কাজ শুরু করেছে। এর পরে উত্তরবঙ্গে একই সক্ষমতার নতুন কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এটি হলে দেশে সারের সব চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে। এছাড়া দেশে সার অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকায় নষ্ট হতো। এ সারের সঠিক হিসাব রাখা হয় না। এখন সব সারের হিসাব রাখা হচ্ছে। বিসিআইসির নিজস্ব সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় বিএডিসির গোডাউন ভাড়ায় মাত্র তিন লাখ টন সার রাখা হয়েছে। এখন নতুন ৪৭টি গোডাউন নির্মাণ হলে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টন সার সংরক্ষণ হবে। ২০২০ সালে প্রায় ১৩টি গোডাউন নির্মাণ শেষ হবে। একই বছরে নতুন করে আরও ৩৪টি গোডাউনের নির্মাণ কাজ শুরু হবে। এ জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াধীন। বিসিআইসি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২১৭ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল। ওই বছরেই সর্বশেষ লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছিল এটি। এর পর নানা কারণে ব্যয়ের বোঝা বেড়ে যাওয়ায় লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এ লোকসান কাটাতে নতুন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সংস্থার চেয়ারম্যান হাইয়ুল কাইয়ুম জানান, বিসিআইসি নানা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশের চাহিদার সব সার উৎপাদন সম্ভব হবে। পাশাপাশি সঠিকভাবে সার সংরক্ষণ সম্ভব হবে। এ কাজ বেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। তিনি আশা করছেন, নতুন পদক্ষেপে লোকসানের ধারা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে। আগামী দুই বছরে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর হবে বিসিআইসি। নতুন সার কারখানার বিষয়ে হাইয়ুল কাইয়ুম বলেন, উত্তরবঙ্গে কারখানা করার বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে। এখনও স্থান চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ হয়নি। উত্তরবঙ্গে গ্যাস পাওয়ার ওপর নির্ভর করবে কোন স্থানে হবে। জ্বালানি বিভাগ এ জন্য কিছু বিষয়ে জানতে চেয়েছে, তার জবাব দেয়া হয়েছে। এখন জ্বালানি বিভাগ নিশ্চয়তাপত্র দিলে স্থান চূড়ান্ত করা হবে। নতুন এ কারখানা কেমন সক্ষমতার করার পরিকল্পনা আছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ কারখানা ন্যূনতম পাঁচ থেকে ১০ লাখ টন সক্ষমতার হতে পারে। দেশের সারের চাহিদার ৪০ শতাংশ উত্তরবঙ্গে ব্যবহার করা হয়। ওই এলাকায় ১০ থেকে ১২ লাখ টন সার সরবরাহ করতে হয়। সিলেট থেকে পঞ্চগড় ও দিনাজপুরে এক টন সার নিয়ে যেতে প্রায় আড়াই হাজার টাকা খরচ হয়। এতে বছরে পরিবহনে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হয়। এর পরও পরিবহন সমস্যার কারণে সরবরাহ অনিশ্চয়তায় থাকে। উত্তরবঙ্গে কারখানা করতে গ্যাসের নিশ্চয়তা পেলে ওই অঞ্চলের জন্য বড় সহযোগিতা দেয়া সম্ভব হবে। এ কারখানা আগের কারখানাগুলোর মতো বিদেশী ঋণে হবে। সফলভাবে করা সম্ভব হলে পাঁচ থেকে ১০ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে। এ কারখানা করতে জাপান বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিসিআইসির তথ্য অনুযায়ী, গত দু’বছর সার কারখানাগুলো গ্যাসের অভাবে উৎপাদন বাড়াতে পারেনি। তখন ১৫ থেকে ১৭ মাস কয়েকটি কারখানা বন্ধ ছিল। এটা আগে কখনও হয়নি। এ কারণে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রায় ২০ লাখ টন সার আমদানি করতে হয়েছে। এবার আমদানির লক্ষ্যমাত্রা মাত্র ১০ লাখ টন। এর বিপরীতে আমদানি হয়েছে সাড়ে ৯ লাখ টন। চলতি অর্থবছরের শুরুতে মজুদ ছিল ৯ লাখ ৯৪ হাজার টন। এবার বন্ধ কারখানা চালুর পরে প্রায় দুই লাখ টনের বেশি উৎপাদন হয়েছে। এবার চাহিদা ২৬ লাখ ৫০ হাজার টনের মধ্যে ২১ লাখ ৮৭ হাজার টন সার পেয়েছে বিসিআইসি। ইতোমধ্যে প্রায় ১১ লাখ ৫২ হাজার টন সার বিক্রি করেছে। এখন মজুদ আছে ১০ লাখ ৩৫ হাজার টন। যা গতবছরের এই সময়ের চেয়ে দুই লাখ টন বেশি রয়েছে। এ বিষয়ে বিসিআইসির চেয়ারম্যান বলেন, এবার সারের কোন ঘাটতি হবে না। এখন চাহিদার চেয়ে উদ্বৃত্ত রয়েছে। কারখানাগুলো চালু থাকায় চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন হবে। তিনি বলেন, সারাবছরে সাড়ে ২৬ লাখ টন চাহিদা থাকলেও ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত চার মাসেই প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ টন সার প্রয়োজন হয়। বছরের অর্ধেকের বেশি এই চার মাসে ব্যবহার হয়। মৌসুমের এ সময়ের চাহিদার চেয়ে বেশি সার হাতে রয়েছে। এদিকে সার কারখানা ছাড়া অন্য কারখানাগুলো চালু করার বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে বিসিআইসি। চিটাগাং কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের জায়গায় দুই হাজার ৩২৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি করা হবে। নতুন গ্যাস কারখানা করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ বিষয়ে বিসিআইসির চেয়ারম্যান বলেন, গ্যাস কারখানা নতুন করে সচল করতে ডিপিপি তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া ছাতক সিমেন্ট কারখানার উৎপাদন ওয়েট পদ্ধতি থেকে ড্রাই পদ্ধতিতে রূপান্তরের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ কাজে ৮৯০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। তাছাড়া পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউন স্থানান্তরের জন্য উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির জায়গায় গোডাউন নির্মাণ কাজ চলছে। ২০২০ সালের মধ্যে গোডাউন স্থানান্তর হবে। খুলনা হার্ডবোর্ড ও নিউজপ্রিন্ট মিলের জমিতে নতুন পেপার মিল করার পরিকল্পনা চলছে। বিসিআইসির সব কারখানা ভাল পর্যায়ে নিয়ে আসতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। অনির্ধারিতভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া, ছোটখাটো দুর্ঘটনা ও কারখানাগুলোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং অপচয় ও দুর্নীতি বন্ধে নতুন পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। যাতে কাফকোর মতো বিসিআইসির সব কারখানা চলে। এজন্য জাপানের মিতসুবিশির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তাদের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই হবে। প্রতিবছর কারখানার সার্বিক পরিস্থিতি পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেবে। যাতে এসব কারখানার দুর্বলতা দূর করে ভাল অবস্থায় আনা যায়।
×