ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কেউ জানলেও তুঁতের কথা শুনেই রেশম পোকার (গুটি) কথা মনে করে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যে কারণে আর দশটা ফলের মতো;###;এগোতে পারছে না

সুস্বাদু রসালো তুঁত ফল

প্রকাশিত: ০৯:২২, ১৮ জানুয়ারি ২০২০

  সুস্বাদু রসালো তুঁত ফল

অনেকটা জামের মতো দেখতে। তবে জাম নয়। বিদেশী চেরি ফলের মতো দেখতে। তাও নয়। স্বল্প উচ্চতার বৃক্ষে একই শাখায় কালো ও লালচে দুই রঙের ফল। দৃষ্টিনন্দন। ধন্ধেও পড়তে হয় দেখে। প্রজন্মের কাছে একেবারেই অচেনা। মধ্যবয়সীদের অনেককে ভাবতে হয়, ফেলে আসা দিনে দেখেছে কিনা। তবে প্রবীণরা দেখেই বলে দেয়- আরে এ তো তুঁত ফল। ইংরেজী নাম মালবেরি। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বলেন এই ফল বেরি বা জাম গোত্রের। জাম কালো রঙে পরিপক্ব হওয়ার আগে কিছুটা লালচে হয়। তুঁত ফল পাকার আগে হালকা লাল হয়ে ধীরে ধীরে কালচে হয়। নরম ও রসালো এই ফল কিছুটা টকের মধ্যে মিষ্টিত্ব থাকায় সুস্বাদের। মৌসুমে কিনতে পাওয়া যায়। বিষয়টি অনেকে জানে না। কেউ জানলেও তুঁতের কথা শুনেই রেশম পোকার (গুটি) কথা মনে করে মুখ ফিরিয়ে নেয়। যে কারণে আর দশটা ফলের মতো এগোতে পারছে না। মনোস্তাত্ত্বিক কারণে ঘরে যাচ্ছে না। মজার বিষয় হলো অনেকে ইংরেজী ‘মালবেরি ফ্রুট’ নামে কেনে। খেয়ে মজাও পায়। অনেকটা ঢাকার গুলশান, বনানী, বারিধারায় বনেদি হোটেলগুলোতে ক্র্যাব ফ্রাই (কাঁকড়া ভাজা) ও টোড জুস (ব্যঙের জুস) খাওয়ার মতো। রেশম বীজাগারে যারা তুঁত গাছ লালন করে তাদের কাছে ফল অতি চেনা। তারা তুঁত পাতা পলু (গুঁটি পোকা) পালনের পাশাপাশি ফল খেতে পারে। উত্তর ও দক্ষিণ ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটানে তুঁত ফলের জন্য চাষ হয়। বাংলাদেশে ফলের জন্য তুঁত চাষ ব্যাপক হারে শুরু হয়নি। প্রকৃতিপ্রেমী উপসচিব রায়হানা ইসলাম তুঁত ফলের বিষয়টি জেনে বাড়ির টবে শাখা কলমে রোপণ করেছিলেন। সময়মতো ফলও ধরেছে। কলম গাছের ফলের স্বাদেও মজা। বললেন, তুঁতের পাতার কথা মনে না করে সুমিষ্ট ফলের কথা মনে করে খেলে মনোস্তাত্ত্বিক বিষয়টি উড়ে যাবে। বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক নিখিল চন্দ্র বিশ^াস জানালেন, তুঁত গাছের স্পেসিস অনেক। তবে বাংলাদেশে দুই প্রজাতির তুঁত গাছ দেখা যায়। তুঁত মূলত বেরি বা জাম গোত্রের। এরই নানা ধরন দেশে দেশে দেখা যায়। মালবেরি ফল ছোট তবে ক্লাসিফিকেশন উচ্চতর। যে কারেন অনেক বলে বনেদী ফল। মালবেরির (তুঁত) আদিনিবাস দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া। বিজ্ঞান নাম মোরাস নিগরা ও মোরাস রুবরা। র‌্যাংক জেনাস। পাতা ঝরার ছোট ও মাঝারি বৃক্ষে তুঁত ফলে। বহুকাল আগে রেশম সুতার উদ্ভাবনে তুঁতের পাতা গুঁটি পোকার খাবারের পরিণত হয়। রেশম বস্ত্র তৈরিতে তুঁত গাছ অবিচ্ছেদ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তুঁতের পাতা ডিম্বকার, খসখসে। অগ্রভাগ সূঁচালু। প্রান্তভাগ করাতের মতো খাঁজকাটা। ছোট ছোট অনেক ফল নিয়ে একেকটি ফলগুচ্ছ বৃক্ষ সাজিয়ে রাখে। শীত শেষের দিকে (সাধারণত ফেব্রুয়ারি-মার্চ) তুঁত গাছে প্রচুর ফুল আসে। এর দু’তিন মাস পর ফুল পাকে। ফলের রং প্রথমে সবুজ। এরপর পাকলে লাল। তারপর পরিপক্বতা বা সম্পূর্ণ পাকলে কালচে হয়ে যায়। তখন দেখতে অনেকটা জামের মতো। জাম মনে করে ভ্রমও হতে পারে। তবে জাম গুচ্ছে থাকে না। তুঁত ফল আঙুর ফলের মতো গুচ্ছ থাকে। গাছে গুচ্ছ গুচ্ছ কাঁচা পাকা ফল দৃষ্টিনন্দন হয়ে ঝুলে থাকে। নার্সারি স্বত্বাধিকারী আব্দুল মান্নান জানালেন, দেশে সাধারণত শাখা কলম ও শীত মৌসুমে ছাঁটাই করা ডাল (কলম) মটিতে পুঁতে নতুন গাছ জন্মানো হয়। কখনও বীজে চারা জন্মায়। দেশের প্রতিটি স্থানেই তুঁত জন্মায়। বেশি জন্মায় রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বগুড়া অঞ্চলে। মোরাস আলবা প্রজাতির এক ধরনের তুঁত গাছ দেখা যায়। এই ফল পাকলে সাদা ও হালকা গোলাপি বর্ণের হয়। রসালো এই ফলও মিষ্টি। প্রজাতিটি দেশের পূর্বাঞ্চল ও পাহাড়ী অঞ্চলে ফলের জন্য চাষ হয়। পাকা ফলে জ্যাম জেলি তৈরি হয়। তুঁতের ইতিহাস থেকে জানা যায়, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় খমের সম্রাজ্যে আংকেরিয়ান যুুগে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা তুঁতের ব্যবহার করেন। তারা তুঁতের ছাল ভেষজ ব্যবহার ছাড়াও এক ধরনের কাগজ তৈরি করতেন। যা ক্রাইং নামে পরিচিতি পায়। বৌদ্ধ শাসনামলে বই তৈরিতে এই কাগজের ব্যবহার হতো। প্রাচীন বৌদ্ধ স্থাপনা সমৃদ্ধ বগুড়ার মহাস্থানগড় এলাকায় তুঁত গাছ দেখা যায়। এলাকার লোকজন জানায়, তুঁত ফলের রস খুব উপকারী। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×