ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু

সোনারগাঁয়ে জ্যোতি বসু স্মৃতি জাদুঘর

প্রকাশিত: ০৯:১৯, ১৮ জানুয়ারি ২০২০

সোনারগাঁয়ে জ্যোতি বসু স্মৃতি জাদুঘর

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ইতিহাসের এক মহানায়কের নাম জ্যোতি বসু। উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ও বামপন্থী রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ খ্যাত জ্যোতি বসুর বাংলাদেশের প্রতি যার অকৃত্রিম ভালবাসা ও দুর্বলতা ছিল সবসময়। ভারতের প্রখ্যাত বাম রাজনীতিক ও পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ১৯১৪ সালের ৮ জুলাই কলকাতার ৪৩/১ হ্যারিসন রোডের বাড়িতে জন্ম নেন। এই কিংবদন্তির শৈশবের অনেকটা সময় কেটেছে বাংলাদেশে তার পৈত্রিক ভিটা নরায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ উপজেলার বারদী চৌধুরীপাড়া গ্রামে। তার পিতা ডাঃ নিশিকান্ত বসু বারদী চৌধুরীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। সেই সুবাদে জ্যোতি বসুর ছোটবেলার অনেকটা সময়ই কেটেছে বারদী তার পৈত্রিক বাড়িতে। ১৩২৯ বাংলা সালের ১৩ অগ্রহায়ণ পাচু ওস্তাগারের মাধ্যমে নির্মাণ করা হয় বাড়িটি। দুই একর ৪ শতাংশ জমিতে জ্যোতি বসুর পৈত্রিক বাড়িতে রয়েছে ৮৮ বছরের পুরনো একটি দ্বিতলা ভবন, দুটি পুকুর, একটি কূপ, এছাড়া আম, জাম, কাঁঠাল ও তালসহ রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ গাছ। খাবার পানির জন্য জ্যোতি বসুর পরিবার যে কূপ ব্যবহার করতেন সেটি এখনও জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। জ্যোতি বসুর পিতা ডাঃ নিশিকান্ত বসু ছিলেন প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। পেশাগত কারণে তিনি জ্যোতি বসুর জন্মের আগেই বারদী থেকে কলকাতায় চলে যান। সেখানে তিনি চিকিৎসা পেশা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও সুযোগ পেলেই বসু সপরিবার বেড়াতে আসতেন বারদীর চৌধুরীপাড়ায় নিজ বাড়িতে। সেই সুবাদে সোনারগাঁয়ে বারদীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জ্যোতি বসুর শৈশবের অনেক স্মৃতি। রাজধানী ঢাকা থেকে দক্ষিণ-পূর্বে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে বারদী চৌধুরী পাড়ায় জ্যোতি বসুর পৈত্রিক বাড়িটির অবস্থান। জ্যোতি বসুর এই বাড়িটি মূলত তার নানার ছিল। জ্যোতি বসুর নানা শরৎ চন্দ্র দাস ও নানি খিরদা সুন্দরীর সংসারে জ্যোতি বসুর মা হেমলতা বসুই ছিলেন একমাত্র সন্তান। সেই সূত্রে এই বাড়ির মালিক হন হেমলতা বসু। ডাঃ নিশিকান্ত বসুর সঙ্গে হেমলতা বসুর বিয়ের পর স্ত্রীর সুবাদে এই বাড়িটির মালিক হন জ্যোতি বসুর পিতা। ডাঃ নিশিকান্ত বসু ও হেমলতা বসুর সংসারে তাদের তিন সন্তান সুরেন্দ্র কিরণ বসু , জ্যোতি বসু ও মেয়ে সুধা বসু। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন জ্যোতি বসু ১৯৮৭ সালের ২০ জানুয়ারি এবং ১৯৯৭ সালের ১১ নবেম্বর স্ত্রী বাসন্তি ঘোষ ওরফে কমলা বসু ও তার ছেলে চন্দন বসুকে সঙ্গে নিয়ে বারদীতে তার পৈত্রিক বাড়িটি দেখতে আসেন। ১৯৮৭ সালে জ্যোতি বসুর সঙ্গে বারদীতে আসেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে জ্যোতি বসুর সঙ্গে বারদীতে আসেন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্টমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ। সে সময় ভারত থেকে জ্যোতি বসুর সঙ্গে আসেন পশ্চিমবঙ্গের উপ-মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসুর বড় ভাই ডাঃ সুরেন্দ্র কিরণ বসু এবং বোন সুধা বসুও। জন্মের পর জ্যোতি বসুর নাম নির্ধারণের পূর্বে প্রথমে জ্যোতিন্দ্র এবং পরে রথীন্দ্র রাখারও সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু তার পিতা ডাঃ নিশিকান্ত বসু তাকে লরেটা কিন্ডারগার্টেনে ভর্তির সময় জ্যোতি বসু নাম রাখেন। কিন্ডারগার্টেনের পড়া শেষ করে তিনি সেন্ট জেভিয়ার কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৩৫ সালে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর লন্ডন গিয়ে জ্যোতি বসু বার এট. ল পাস করে ১৯৪০ সালে কলকাতা ফিরে আসেন এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪২ সালের ২০ জানুয়ারি বাসন্তি ঘোষ ওরফে কমলা বসুর সঙ্গে তার বিয়ে সম্পন্ন হয়। ১৯৪৬ সালে তিনি রাজ্য পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। পাশাপাশি পলিটব্যুরো সদস্যসহ ১৯৪৬ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯ সালে জ্যোতি বসু ইউনাইটেড ফ্রন্ট সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কমিউনিস্ট দলের সদস্য হিসেবে ১৯৭৭ সালের ২১ জুন থেকে ২০০০ সালের ৬ নবেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ বছর সাফল্যের সঙ্গে একটানা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে সুনাম অর্জন করেন। জ্যোতি বসু ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠালগ্ন ১৯৬৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পলিটব্যুরোর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে জ্যোতি বসুকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় কিন্তু দলের সিদ্ধান্ত অনুসারে তিনি প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। ২০০০ সালে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে দলের অন্যতম সদস্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় জ্যোতি বসু তাঁর এই পৈত্রিক বাড়িটি গ্রন্থাগারে রূপান্তরিত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত আগ্রহে জ্যোতি বসুর স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি গ্রন্থাগারে রূপান্তরিত করার ঘোষণা দেন। প্রধান মন্ত্রীর নির্দেশে ২০১১ সালের ৪ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদ এক কোটি ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে গ্রন্থাগারের নির্মাণ কাজ শুরু করে। যার প্রথম তলায় রয়েছে পাঠাগার কক্ষ, মহাফেজখানা ও শৌচাগার। দ্বিতীয় তলায় স্মৃতি জাদুঘর ও সেমিনার হল। নির্মাণ কাজ শেষ হলে ২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জ্যোতি বসু স্মৃতি পাঠাগার ও জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। বর্তমানে এটি গ্রন্থাগার, জাদুঘর ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পুরাকীর্তি বিভাগের তত্ত্বাবধানে বাড়িটি সংস্কার ও সংরক্ষণ করে এখানে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, জ্যোতি বসুর ব্যবহ‍ৃত সামগ্রী দিয়ে একটি জাদুঘরসহ দর্শনীয় একটি ভবন তৈরি করে তার স্মৃতি চির জাগরূক রাখা হয়। বাঙালীর অকৃত্রিম বন্ধু এই মহান রাজনীতিবিদ ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি ইহলোক ত্যাগ করেন। ছোট বেলায় জ্যোতি বসু তার পৈত্রিক বাড়িতে থাকাকালীন সময়ে তার দেখাশোনা করতেন আয়াতুন নেছা নামে এক মহিলা। পরবর্তীতে জ্যোতি বসুর পৈত্রিক বাড়িটির দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয় আয়াতুন নেছা ও তার ছেলে হাবিবুল্লার ওপর। বর্তমানে ওই বাড়িটি দেখাশোনা করছেন আয়াতুন নেছার নাতি ইউসুফ আলী ও ফকির মাহামুদ। -ফারুক হোসাইন, সোনারগাঁ থেকে
×