ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পিলখানা হত্যা মামলার রায়ের আংশিক পর্যবেক্ষণ

প্রকাশিত: ০৯:১৮, ১৮ জানুয়ারি ২০২০

   পিলখানা হত্যা মামলার রায়ের আংশিক পর্যবেক্ষণ

(গতকালের পর) বিডিআর বিদ্রোহের মোটিভ, ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পিত হত্যাকান্ড বিচারপতি সিদ্দিকী পর্যবেক্ষণে বলেন, বাংলাদেশ রাইফেলসের বিভাগীয় কতিপয় উচ্চাভিলাষী সদস্য ও একটি স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনা ও উস্কানিতে সাধারণ ও নবাগত সৈনিকগণ প্ররোচিত ও বিভ্রান্ত হয়ে ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালে বিদ্রোহ করেছে, তাদের মূল লক্ষ্য ছিল (১) সেনা কর্মকর্তাদের জিম্মি করে যে কোন মূল্যেই তাদের দাবি আদায় করা; (২) বাহিনীর চেন অব কমান্ড ধ্বংস করে এই সুশৃঙ্খল বাহিনীকে অকার্যকর করা; (৩) প্রয়োজনে সেনা কর্মকর্তাদের নৃশংসভাবে নির্যাতন ও হত্যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীর অফিসারদের বিডিআরে প্রেষণে কাজ করতে নিরৎসাহিত করা; (৪) বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করা; (৫) মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৪৮ দিনের নবনির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের প্রয়াসে অস্থিতিশীলতার মধ্যে দেশকে নিপতিত করা; (৬) বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করা; (৭) বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করা এবং (৮) জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা মিশনে বিডিআরের অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকায় দেশের অন্যান্য বাহিনীর অংশগ্রহণ ক্ষতিগ্রস্ত করা ইত্যাদি। পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, বিডিআর জওয়ানরা তাদের সাধারণ স্বার্থে দাবি-দাওয়া নিয়ে শৃঙ্খলাবহির্ভূতভাবে সরকারের প্রভাবশালী এমপি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে দফায় দফায় দেন দরবার করেছে। সরকার পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে তাদের দাবিসমূহ লিফলেট আকারে প্রস্তুত করে পিলখানার অভ্যন্তরে এবং ঢাকা শহরে জনবহুল এলাকায় বিতরণ করেছে। বিদ্রোহীরা লিফলেটে লিখেছে, ‘বিডিআরে সেনা অফিসারদের দেখতে চাই না, প্রয়োজনে আন্দোলনের মাধ্যমে কুকুরের ন্যায় সরিয়ে দেবে। বিদ্রোহীরা ঘটনার পূর্বে পিলখানার বাইরে এবং ভেতরে দফায় দফায় ষড়যন্ত্রের মিটিং করে বিদ্রোহের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তারা রাতের অন্ধকারে মোমবাতি জ্বালিয়ে শপথ গ্রহণ করেছে, যে কোন মূল্যে তাদের দাবি আদায় করবে, প্রয়োজনে বিডিআরের নেতৃত্বে থাকা সকল সামরিক অফিসারকে হত্যা করবে। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় বিডিআর সদস্যরা দরবার হলে ‘জাগো’ বলে চিৎকার করার সঙ্গে সঙ্গে জওয়ানরা দরবার হল ত্যাগ করে করতে গিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করে বৃষ্টির মতো এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। গ্রেনেডসহ অন্যান্য বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিকট শব্দে পিলখানাসহ আশপাশের এলাকা প্রকম্পিত করে এক ভিতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে সমগ্র জাতিকে উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠার মধ্যে ফেলে দেয়। সশস্ত্র বিদ্রোহীরা পিলখানার অভ্যন্তরে অবস্থিত প্রেষণে নিয়োগকৃত সামরিক অফিসারদের খুঁজেখুঁজে বের করে নৃশংসভাবে হত্যা করতে থাকে। সরকারী গাড়ি/বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। অন্যদিকে সেনা অফিসারদের মেস, বাসা-বাড়িতে তল্লাশির নামে পরিবার পরিজনদের ওপর পাশবিক নির্যাতন করে ঘরবাড়ি তছনছ করে টাকা পয়সাসহ মূল্যবান সম্পদ লুটতরাজ করে সেনা পরিবারের সদস্যদের পশুর ন্যায় গাদাগাদি করে কোয়ার্টার গার্ডে বন্দী করে রাখে। তিনি বলে, বিদ্রোহীরা ভারি অস্ত্র বহনকারী যান অচঈ বের করে ভারি অস্ত্র বিভিন্ন গেট, বহুতল ভবনের ছাদে স্থাপন করে। বিদ্রোহীরা সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সামরিক যানে সশস্ত্র অবস্থায় সমগ্র পিলখানায় টহল দিতে থাকে। মাইকযোগে সকল বিডিআর সদস্যদের দাবি আদায়ের যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও সকলকে অস্ত্র নিয়ে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ দিতে থাকে। তারা মাইকযোগে বলে, সেনাবাহিনী এবং তাদের কাছে একই অস্ত্র আছে, যুদ্ধে তারাই বিজয়ী হবে। তাদের পেছনে অনেক বড় শক্তি আছে, এলাকার মানুষের সমর্থন আছে। সেনাবাহিনী আক্রমণ করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয়সহ আশপাশের এলাকা তারা উড়িয়ে দেবে। তারা যে কোন মূল্যেই হোক সেনাবাহিনীকে বিডিআর থেকে উচ্ছেদ করবে, কেউ তাদের রুখতে পারবে না। পিলখানায় বিদ্রোহীদের লোমহর্ষক বর্বরতা বিচারপতি সিদ্দিকী পর্যবেক্ষণে বলেন, ২৫.০২.২০০৯ তারিখে হত্যাকা-ের নৃশংসতা এতই ভয়াবহ ছিল যে, ওই ঘটনার সঙ্গে পৃথিবীর অন্য কোন ঘটনার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। বিডিআরের বিদ্রোহী জওয়ানরা কেবলমাত্র দরবার হলেই নয়, পালিয়ে থাকা সেনা অফিসারদের বাসায় তল্লাশি করে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। মেজর মোহাম্মদ মাকসুম-উল হাকিম জীবনের ভয়ে দরবার হলের ওয়াশরুমের বেসিনের ভেতর পালিয়ে থাকাকালে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা সেখান থেকে তাকে বের করে গুলি করে। তিনি জীবন বাঁচানোর জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করলে বিদ্রোহীরা বিদ্রুপ করে, হাসপাতালে যাওয়ার সাধ মিটাচ্ছি বলে তার উপরে উপর্যুপরি গুলি চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। সতীর্থ সেনা অফিসার ২১ নং সাক্ষী মেজর সৈয়দ মনিরুল আলম নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য মাকসুম-উল হাকিমের রক্ত নিজ শরীরে লাগিয়ে মৃত্যুর ভান করে তার লাশের পাশে পড়ে থাকে। গোফরান মল্লিকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বিদ্রোহী দল ২৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেঃ কর্নেল লুৎফর রহমানকে তার অফিস থেকে টেনে হিঁচড়ে ১৩ রাইফেল ব্যাটালিয়নের পিছনে নিয়ে গোফরান মল্লিকের নির্দেশে সি/ও এর ড্রাইভার সিপাহী আজিম পাটোয়ারী ও রানার ইমরান চৌধুরী কাপড় দিয়ে লেঃ কর্নেল লুৎফর রহমানের চোখ ও রশি দিয়ে হাত বেঁধে গুলি করে হত্যা করে। সিপাহী সেলিম রেজার নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র বিডিআর সৈনিকরা রক্তের নেশায় মেতে ওঠে। তারা ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের সরকারী বাসভবনে হামলা চালায়। গার্ড কমান্ডার হাবিলদার বাবুল মিয়া বাধা দিলে তাকে গুলি করে আহত করে বাসভবনে প্রবেশ করে ডিজির স্ত্রী নাজনিন শাকিল শিপু, গৃহকর্মী কল্পনা বেগম, ডিজির মেহমান অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল দেলোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রী রৌসুনী ফাতেমা আক্তার লাভলীকে পাশবিক নির্যাতন করে হত্যা করে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়। ভিডিও ফুটেজে ডিজির বাংলোর চিত্র দেখে কে না বাকরুদ্ধ হয়? দোতলায় হত্যাকান্ডের রক্ত সিঁড়ি দিয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ার দৃশ্যে হতবাক হতে হয়। দোতলা বাড়িটির সমগ্র মেঝেতে রক্তের হলিখেলা হয়েছে। ডিজির বাসভবনে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছে। পাষন্ডরা, ভবনে লুটতরাজসহ আসবাবপত্র থেকে শুরু করে সবকিছু ভাংচুর ও তছনছ করেছে। এ যেন বরবর যুগের কাহিনীকে বিডিআর বিদ্রোহীরা হার মানিয়েছে। সশস্ত্র বিদ্রোহীরা বাড়িঘর, সরকারী সম্পদ লুণ্ঠন করে এবং সরকারী গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভস্মীভূত করেছে। পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, মেজর আসাদ ও কর্নেল জাহানারা জীবনের ভয়ে সদর ব্যাটালিয়নের অধিনায়কের অফিসের বাথরুমে পালিয়ে থাকা অবস্থায় ডিএডি তৌহিদের নির্দেশে সশস্ত্র বিদ্রোহী হাবিলদার বেলায়েত, নায়েক আছাদ ও সিপাহী আমিনার বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে মেজর আসাদকে বের করে এনে অফিস রুমের মধ্যে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে, ৩৬ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মোঃ এনায়েতুল হক, সদর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মোঃ মজিবুল হক ও মেজর মকবুল ঘটনার ভয়াবহতায় নিজ ব্যাটালিয়ানে আশ্রয় নিলে সুবেদার মেজর শহিদুর রহমান, হাবিলদার ওমর আলী, সুবেদার একরামুল হক, সিপাহী বজলুর রশিদ, ল্যান্স নায়েক আনোয়ারুল ইসলাম সহ বিদ্রোহীরা লেঃ কর্নেল এনায়েত ও কর্নেল মজিবুল হককে ধরে সৈনিক লাইনের চতুর্থ তলায় নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। সিপাহী আলীম রেজা মেজর মকবুলকে গুলি করে হত্যা করে তারা লাশগুলো ৪র্থ তলা থেকে নিচে ফেলে দেয়। সুবেদার মেজর গোফরান মল্লিক ঘটনার পূর্বে তার অফিসে দফায় দফায় মিটিং করে বিডিআরের সৈনিকদের বিদ্রোহে প্রস্তুত করে। মেজর জায়েদী হাসান হাবিবকে তার বাসায় লুকিয়ে থাকতে দেখে প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন লাগানোর নির্দেশ দেয়, তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারেক সিদ্দিক এর সাথে কথা বলার জন্যে ফোন ধরিয়ে দেয়, গোফরান মল্লিক ফোনে বলে, আপনি মন্ত্রী হন বা নাই হন, ভিতরে আর্মি পাঠাবেন না। আর্মি পাঠালে তারা দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি সহ সকল এলাকা তছনছ করে ফেলা হবে এবং ৩০৯ টি বিওপি থেকে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠবে। বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকী পর্যবেক্ষণে বলেছে, ২৫/০২/২০০৯ তারিখে উদ্ভুদ পরিস্থিতিতে জীবন রক্ষার জন্যে মেজর মোঃ মোশারফ হোসেন, মেজর রওনক আজাদ এ্যানি দৌড়ে দরবার হলের অদূরে নূর মোহাম্মদ রাইফেলস পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের বেতন সংগ্রহের কাউন্টারে আত্মগোপন করে থাকা অবস্থায় সশস্ত্র সিপাহী আলতাফ, বাসার ও হায়দার মেজর এ্যানি ও মেজর মোশারফকে টেনে হিচড়ে স্কুলের বারান্দায় বের করে আনে। মেজর মোশাররফকে বারান্দায় দাঁড় করিয়ে তারা প্রকাশ্যে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। কি বর্বরোচিত ঘটনা, বিদ্রোহীরা নিরস্ত্র অফিসারদের একজন একজন করে খুঁজে খুঁজে বের করে ঠান্ডা মাথায় তাদের হত্যা করেছে। মেজর এ্যানি প্রত্যক্ষ সাক্ষী, মহিলা ডাক্তার হিসাবে বিদ্রোহীদের চিকিৎসার জন্য তাকে গাড়িতে তুলে বিডিআর হাসপাতালে নিয়ে যায়। (চলবে) লেখক : হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি
×