ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দু’টি গল্প ॥ অভিনয়

প্রকাশিত: ১০:১১, ১৭ জানুয়ারি ২০২০

দু’টি গল্প ॥ অভিনয়

সারাদিন ধরে রিম ঝিম ঝিম বৃষ্টি পড়ছে। ভাল লাগছে না দিলদারের। অসহ্য লাগছে এ বৃষ্টি। বিছানা থেকে উঠে বেলকনিতে গেল সে। উঁকি মেরে দেখল বৃষ্টির বেগ। - না, বৃষ্টি থামার কোন সম্ভাবনা নেই। আরও ঘণ্টা কয়েক চলবে বোধহয়। গাছের পাতায় আছড়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটার দিকে তাকাল সে। মুহূর্তেই অস্থির হয়ে উঠল তার মন। তাকে যেতে হবে ডাঃ রিতুর কাছে। যত বৃষ্টিই হোক আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করা চলবে না তার। বেলকনি থেকে ঘরে এসে ছাতা নিল সে। শিউলি বলল- কোথায় যাচ্ছ তুমি? ঘরে আমি একা। আমাকে রেখে এ সময় দূরে কোথাও যেও না। যে কোন সময় জ্ঞান হারাতে পারি আমি। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আমার। পেটে ব্যথা করছে প্রচ-। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে এখনই দম বন্ধ হয়ে মরে যাব আমি। অবশ্য মরে গেলেই ভাল হবে তোমার। ক্লিয়ার হবে তোমার চলার পথ। তবে আমি চিন্তা করছি তোমার অনাগত সন্তানের কথা। আমার যাই হোক না কেন তোমার সন্তান যেন ভাল থাকে। দিলদার বউয়ের কথায় কান দিল না। একবার শুধু ফিরে তাকাল। দু’চোখ বড় করে তাকিয়ে বিনা বাক্য ব্যয়ে বুঝিয়ে দিল রাগ। তারপর বেরিয়ে পড়ল ডাঃ রিতুর বাড়ি অভিমুখে। কাকভেজা হয়ে ডাঃ রিতুর বাসার কলিংবেল চাপল সে। একবার, দুবার, তিনবার। দরজা খোলার অপেক্ষা সহ্য হলো না তার। আবার চাপল কলিংবেল। ক্রিং ক্রিং ক্রিং। ভেতর থেকে দরজা খুললেন ডাঃ রিতু। -দিলদার আপনি? -হ্যাঁ, আমি। চমকে গেলেন। -যেভাবে কলিং বেল চাপলেন না চমকে উপায় আছে। ভেতরে আসুন। সেকি ভিজে গেছেন আপনি। এখানে বসুন আমি আপনার জন্য তোয়ালা নিয়ে আসছি। -তোয়ালার দরকার হবে না। প্রচ- গরম হয়ে আছে মাথা। ঠা-া করার জন্য এ রকম ভেজাটাই দরকার ছিল। -রসিকতা ছাড়ুন। এমন বৃষ্টিতে ভিজে আমার কাছে কেন আসলেন? -আসতে নিষেধ আছে বুঝি? -তা নয়। তবে এ রকম হুট করে আসাটার কারণ নিশ্চয়ই আছে। -ঠিক ধরেছেন। বেশ অস্থির হয়ে আছি আমি। মাথা থেকে সরাতেই পারছি না এ অস্থিরতা। অনেক ভেবে দেখলাম আপনার প্রস্তাবটাই কেবল পারে আমাকে এ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে। শিউলির সাথে থাকা আর সম্ভব হচ্ছে না আমার। ওকে আর বাঁচিয়ে রাখতে চাই না। আপনার যা প্রয়োজন দিতে রাজি আছি আমি। বলুন কত দিতে হবে আপনাকে। -আমার জন্য স্ত্রীকে মেরে ফেলতে রাজি হলেন শেষমেশ। খুশি না হয়ে পারলাম না। তবে মেরে ফেলার বিষয়টাকে যত সহজ ভাবছেন তত সহজ কিন্তু নয়। কাজটা করতে মোটেই প্রস্তুত নই আমি। তবে কি আর করা, যখন আপনিও চাইছেন এটা করতে তবে আর দেরি কেন? তবে একটা কথা, বি সিরিয়াস। একটা কাকপক্ষীও যেন না জানে এ বিষয়ে। -নিশ্চিত থাকতে পারেন আপনি। সকলেই জানবে আমার স্ত্রী ডেলিভারীর সময় মারা গেছে। কেউ বুঝবে না তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আর ওই বাচ্চাটাকেও আমি চাই না। গাইনি ডাক্তার আপনি। এই শহরে আপনার যতেষ্ট নাম ডাক আছে। পেটের সন্তানকে কিভাবে মারবেন এটা আপনার বিষয়। আগামী কালই আমি আপনার পাওনা বুঝিয়ে দেব। -টাকাটা একটু বেশিই দিতে হবে দিলদার। বুঝেন তো। অপারেশনের পর রোগীকে আইসিইউতে নিতে হবে। ডাঃ ফিরোজ আছেন আইসিইউর দায়িত্বে। তাকে ম্যানেজ করা না গেলে পুরো পরিকল্পনাটাই ভেস্তে যাবে। -ওনার চাহিদা কেমন? -ঠিক কত তা এ মূহুর্তে বলতে পারছি না। রাতে একবার ফোন করবেন। সব বলে দিব আপনাকে। -ওকে। আমি তাহলে এবার আসতে পারি। -হ্যাঁ অবশ্যই। কিছুটা নির্ভার হয়ে দিলদার বের হয়ে আসেন ডাঃ রিতুর বাসা থেকে। বাচ্চা সহ বউকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা আপাতত সফল। শুধু অপেক্ষা অপারেশান থিয়েটারে নেয়া পর্যন্ত। তবে ভাল অভিনয় করতে হবে তাকে। শিউলিকে বুঝতে দেয়া যাবে না কি ভয়ঙ্কর সময় অপেক্ষা করছে তার জন্য। বাইরে তখনও বৃষ্টি। ভেজা ছাতাটা মেলে হাঁটা শুরু করল দিলদার। বিছানায় শুয়ে আছে শিউলি। পেটে ব্যথা হচ্ছে তার। কোলের উপর হাত রাখল সে। দু’চোখ বন্ধ করে আগত সন্তানের মুখের ছবিটা আঁকতে চেষ্টা করল। আঁকতে পারল না। শুধু দুঃস্মৃতির মতো ভেসে উঠল স্বামীর অবহেলা। এ কঠিন সময়েও তাকে পাশে না পাবার আক্ষেপ হলো তার। মনে পড়ল বাবার কথা। পালিয়ে বিয়ে করার আগে খুব করে নিষেধ করেছিল বাবা ওকে বিয়ে না করতে। তখন বাবার কথা শোনেনি সে। বাবাকে প্রতিপক্ষ মনে হতো তার। অথচ ঠিকে বলেছিল বাবা। ভুল করলি শিউলি, বড় ভুল করলি তুই। ও ছেলেকে হাড়ে হাড়ে চিনি আমি। আমার জীবদ্দশায় ওকে জামাই বলে স্বীকার করব না আমি। ওর মতো ছেলে আমার জামাই হতে পারে না। তুই সুখ পাবি না শিউলি। ও তোকে সুখী করবে না। তোর সম্পদ আর চাকরিকে ভালবেসেছে সে। লোভ দেখিয়েছে তোকে। লোভে পড়েছিস তুই। একদিন সবকিছু কেড়ে নিয়ে এ ছেলে নিঃস করবে তোকে। তোর জীবনে এমন ঘটুক দেখতে চাই না আমি। তার আগেই যেন মরণ হয় আমার। বাবার কথা মনে পড়তেই শিউলির চোখ জলে ভিজে গেল। ডুকরে কেঁদে উঠল সে। তার কান্নার শব্দ এই ইট পাথুরের নির্জীব দেয়াল ভেদ করে বাইরের বৃষ্টির সঙ্গে মিশে আচড়ে পড়তে লাগল মাটিতে। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় শান্ত হলো সে। শুধু শান্ত হলো না তার চোখ। ক্রমাগত জল ঝরাতে থাকল চোখের কোনা দিয়ে। দিলদার বাসায় আসল। অপরাধীর মতো শিউলির পাশে বসল। তাকে কাঁদতে দেখে মুছে দিল চোখের জল। গায়ে হাত রেখে অভয় দিয়ে বলল- ভেব না কিছু, কিচ্ছু হবে না তোমার। চমকে উঠল শিউলি। যে স্বামী দীর্ঘ ছয়টি মাস মৃত্যু যন্ত্রণা দিয়ে এসেছে তার হঠাৎ এমন বদলে যাওয়া! সন্তান পেটে আসার পরও কতবার মেরেছে তাকে। লাঞ্ছনা আর অপমানে প্রতি মুহূর্তে নিজের মৃত্যু কামনা করেছে শিউলি। আজ চোখের জল মুছে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে সব দুঃখ-লাঞ্ছনা আর যন্ত্রণা অভিমানে রূপ নিল। কিছুটা দূরে সরে বলল- আমার জন্য ভাবতে হবে না তোমার। বেশ আছি আমি। কিছু হারানোর ভয় নেই আমার। -জানি খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার। খুব বেশি কষ্ট দিয়েছি তোমাকে। স্বামীর কথায় ফিরে তাকাল সে। অভিমান ভুলে গেল নিমিষেই। ভাবল দিলদারের মনে একটু হলেও ভালবাসা আছে তার জন্য। সে ভালবাসার দাবি নিয়ে স্বামীর হাতে হাত রাখল। দিলদার বলল- এটা তোমার জন্য খুব ইমপর্টেন্ট সময় । এভাবে কাঁদলে চলবে না তোমার। একটু হাসো, তোমার হাসিটা দেখি। শিউলি হাসতে চেষ্টা করল, পারল না। হাসতে গিয়ে কেঁদে ফেলল। তার এ কান্না আনন্দের। সে আনন্দে জড়িয়ে ধরল স্বামীকে। এতদিন চৈত্রের ক্ষরা রোদ্রের মতো শূন্যতায় খা খা করছিল তার বুক। আজ যেন পূর্ণ হলো সে শূন্যতা। শিউলি বলল- কেন এমনটা করেছিলে এতদিন? কেন কষ্ট দিয়েছিলে আমায়? উত্তর দিল না দিলদার। শিউলি আবার বলল- জানি বলবে না তুমি। শুনতে চাই ও না সব কিছু। কয়েক জনের কাছেই শুনেছি, কোন এক ডাক্তারের সাথে তোমার একটু আধটু সম্পর্ক হয়েছে। যার জন্য আমাকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলে তুমি। শুধু এটুকু শুনতে চাই আমি যা শুনেছি তা মিথ্যা কি? যদি সত্য হয় কিছুই বলব না আমি। আমার নিয়তিকে মেনে নিয়েই বেঁচে থাকব। দিলদার প্রতি উত্তর করল না। জানালা দিয়ে বাইরের ঝড়ো ঝড়ো আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। দুদিন পর শিউলিকে ক্লিনিকে ভর্তি করা হলো। শিউলি বলল-অপারেশন হবে বলছ, কিন্তু অপারেশনের পর কে দেখবে আমায়? কে দেখে রাখবে ছোট সোনামনিকে? তুমি বরং মাকে বলে রাখ। মা পাশে থাকলে ভাল থাকবে আমাদের সন্তান। দিলদার বলল- এসব নিয়ে ভাবতে হবে না তোমায়, সব ব্যবস্থা করে রাখব আমি। -আমার খুব ভয় করছে। যদি আর দেখা না হয় ক্ষমা করে দিও। দিলদারের মুখটা কালো হয়ে উঠল। প্রবল পাপবোধে জীর্ণ হয়ে উঠল শরীর। নার্চরা এসে শিউলিকে নিয়ে গেল অপারেশন থিয়েটারে। কেমন একটা শুণ্যতা গ্রাস করল দিলদারের দেহ, মন। রাত্রি আড়াইটার সময় ফোন বেজে উঠল। ডাঃ রিতু ফোন করেছেন। কল এ্যাটেন্ড করে দিলদার কাঁপা গলায় বলল- হ্যালো। ডাঃ রিতু বললেন- আপনার জন্য দুটো দুঃসংবাদ আছে। -দুঃসংবাদ! চমকে উঠলেন দিলদার। -মা মেয়ে দু’জনই সুস্থ আছে। সোনার টুকরার মতো কন্যা সন্তান হয়েছে আপনার। কিন্তু আপনার চারপাশ ঘিরে রেখেছে পুলিশ। এখুনি এ্যারেস্ট হবেন আপনি। আর শোনেন যে টাকা আমাকে পাঠিয়েছেন তার সবটাই শিউলির এ্যাকাউন্ডে জমা হয়েছে। ওর নিরাপত্তা আর সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য। -মানে কি? -বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। কি করে ভাবলেন দুটো মানুষের জীবন কেড়ে নেব আমি। পাপে ডুবে গেছেন আপনি। এখন সময় হয়েছে প্রায়শ্চিত্ত করার বলে কল কেটে দিলেন।
×