ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাহ বুলবুল

নিকো লোপেজ ॥ ২৪ বছরের এক আগুনে জীবন

প্রকাশিত: ১০:১০, ১৭ জানুয়ারি ২০২০

নিকো লোপেজ ॥ ২৪ বছরের এক আগুনে জীবন

মাতৃভূমির প্রতি নিজের কর্তব্য কখনও ভুলে যাবেন না। মা যখন ডাকবে ঠিক তখনই সাড়া দিতে হবে। অথবা খুব তাড়াতাড়ি এই যুদ্ধের দিন শেষ হবে। আমরা আমাদের সুখের নীড়ে ফিরে আসবো তখন আমাদের মাতৃভূমি মুক্ত। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আমাদের আগামী বছরগুলো সুন্দর হবে। আরও সুন্দর এবং যৌবনদীপ্ত হবে। নবেম্বর ১৯৫৫ সালে ব্যক্তিগত নোটে মাতৃভূমি কিউবার কথা এভাবেই লিখতেন একজন বিপ্লবী যোদ্ধা। তিনি স্বাধীনতাকে দেখেছেন একটা সোনালী স্বপ্ন হিসেবে অথচ সেই স্বপ্ন ছোঁয়ার আগেই তাকে হত্যা করে বাতিস্তা আর্মির নির্মম বুলেট। বলছিলাম কিউবা বিপ্লবের একজন অন্যতম যোদ্ধা আন্তেনিও নিকো লোপেজ ফার্নান্দেজের কথা। পোড়খাওয়া বিপ্লবী ফিদেলের পাশে থেকে কিউবা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন অনেক আগ থেকেই। চাতালে কাজ করবেন বলে একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন এবং ফিদেলের নির্দেশে রাউল কাস্ত্রো এবং নিকো লোপেজের নেতৃত্বে ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই বিকেল পাঁচটা নাগাদ আর্মি গ্যারিশন বায়োমো আক্রমণ করা হয়। কর্নেল আলবার্তো ডেল রিও চ্যাবিয়ানোর অধীনে ছিল বাতিস্তা সরকারের দ্বিতীয় বৃহৎ আর্মি গ্যারিশন বায়োমো। বায়োমো যুদ্ধে গেরিলা দল সফল না হলেও নিকোর ভয়হীন যুদ্ধকৌশল ছিল অবাক হওয়ার মতো। এজন্য বিপ্লবী গেরিলা নিকো লোপেজকে ডাকা হতো বায়োমো বীর বলে। প্রফেসর আন্তেনিও রাফায়েল দে লা কোভা। উত্তর ক্যারোলিনার গ্রিনসবোরো শহরে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনার লাতিন আমেরিকার ইতিহাস বিষয়ের একজন শিক্ষক। প্রফেসর আন্তেনিও রাফায়েল দে লা কোভা লাতিন আমেরিকার ইতিহাস বিষয়ের তার দীর্ঘ গবেষণাকে ভিত্তি করে রচনা করেন ‘মোনকডা আক্রমণ : কিউবা বিপ্লবের জন্ম’। ২০০৭ সালের ১৫ জুন প্রকাশিত বইটিতে ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই সংঘটিত মোনকডা এবং বায়ামো যুদ্ধের কথা তুলে ধরে হয় যাতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে নিকো লোপেজ নামের এক তরুণ যোদ্ধার কথা। নিকোর যুদ্ধ বীরত্ব এবং পরবর্তীতে স্বাধীন কিউবা তাদের এই তরুণ বিপ্লবীকে কিভাবে স্মরণ করেছে সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ২৬ জুলাই আন্দোলনের একজন বিপ্লবী কর্মী হিসেবে নিকো লোপেজ মানজানিলো থেকে কিউবার পূর্ব প্রদেশগুলোর প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রান্তিক মানুষদের মাঝে একটা বৈপ্লবিক জাগরণ তোলার চেষ্টা করেছেন। আর্মি গ্যারিশন মোনকডা এবং বায়ামো আক্রমণ পূর্বের সময়কালীন বন্ধু নিকো লোপেজের দীপ্ত মনোভাব ও ক্ষিপ্রগতি সম্পর্কে রাহুল কাস্ত্রো তার স্মৃতিচারণে বলেন, আন্দোলনের জন্য মাত্র ছয়টি পেসো জমাতে তাকে (নিকো লোপেজ) মাইলের পর মাইল হাঁটতে দেখেছি। প্রতিটি দিনের শেষ থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হাভানার কপি হাউসে চুলচেরা বিশ্লেষণ। প্রতিটি সভার শেষে ভুল ও দুর্বলতাগুলো নিয়ে কড়া সমালোচনা এবং কর্মীদের প্রতি ভ্রাতৃত্বপূর্ণ আচরণ তার মৃত্যুর দিন অবধি টিকে ছিল। আজ থেকে বহুবছর আগের কথা। বিপ্লবী নিকো লোপেজ মৃত্যুর পর তার মা কনসেপসিয়ন ফার্নান্দেজ সন্তান নিকো সম্পর্কে স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, নির্বাসিত জীবনে সে যেখানেই ছিল আমাদের দেখতেন। গুয়াতেমালা থেকে মেক্সিকো, নির্বাসনের সময়, আমরা সবসময় তার চিঠি এবং ছবি পেতাম। চিঠিতে দেশপ্রেম এবং বিপ্লবের কথা গুরুত্বসহ উল্লেখ থাকত। বিপ্লবী গেরিলা নিকো লোপেজের ৮৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ২০১৭ সালে ১ অক্টোবর কিউবা থেকে প্রকাশিত শ্রমিকদের পত্রিকা ‘তাঁর চিঠিতে আত্মা’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। কিউবার ইতিহাস সংরক্ষণাগারের বরাত দিয়ে প্রকাশিত নিবন্ধে নির্বাসিত নিকো লোপেজের বেশ কটি চিঠির অনুচ্ছেদ উল্লেখ করা হয়েছে। মাতৃভূমি কিউবা থেকে নির্বাসনকালীন জীবনে নিকো গুয়াতেমালাকে তার দ্বিতীয় মাতৃভূমি বলে মনে করতেন। ১৯৫৪ সালের ১৩ মে নিকো গুয়াতেমালা থেকে স্বদেশ কিউবায় তার মায়ের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে নির্বাসিত জীবনের করুণ রোনাজারি প্রকাশ করেছেন। চিঠিতে নিকো লেখেন, মা আজ আমি তোমার কাছ থেকে অনেক দূরে। খুব কষ্টে কাঁদতে হয়। ইচ্ছে করে তোমাকে আমার বাহুতে ধরে রাখতে এবং ইচ্ছে মতো চুমু খেতে। আমি জানি আমার নির্বাসন তোমাকে কষ্ট দেয় তথাপি তোমার ভালবাসা ছাড়া আমার হৃদয় কখনই লড়াই করতে পারবে না। ১৯৫৪ সালের ২০ জুন মেক্সিকো সিটি থেকে কিউবায় বাবা ডন জুয়ান এ্যালবিনের উদ্দেশে নিকোর লেখা চিঠিতে তার দৃঢ়চেতা কঠিন মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। বাবা দিবস উপলক্ষে লেখা চিটিতে নিকো গ্রেফতারের পর তার ওপর বয়ে যাওয়া নির্মম নির্যাতনের কথা বলেন এবং ক্ষোভের সঙ্গে জানান, আমাদের সঙ্গে যাই ঘটুক আমি অবশ্যই আমাদের স্বাধীনতা ও বিপ্লবকে ভালবাসী। গুয়াতেমালা ও মেক্সিকোতে নির্বাসনে থাকাকালীন বাবা মায়ের পাশাপাশি বোন হার্টেনসিয়াকেও আলাদাভাবে চিঠি লিখতেন নিকো। ১৯৫৪ সালের ৪ আগস্ট গুয়াতেমালা থেকে বোন হার্টেনসিয়াকে লেখা চিঠিতে নিকো লোপেজ তার রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করেন। তিনি স্বৈরাচার বাতিস্তার গুপ্তচরদের ভীতু ও কাপুরুষ বলে আখ্যায়িত করেন কারণ বাতিস্তার গুপ্তবাহিনী তাকে পেছন থেকে হত্যা করতে চায়। মৃত্যুর আনুমানিক তিনমাস আগে অর্থাৎ ১৯৫৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর নিকো লোপেজ মেক্সিকো থেকে কিউবায় তার বোন হর্টেনসিয়ার কাছে আরও একটি চিঠি লেখেন। সম্ভবত এটাই ছিল নির্বাসিত গেরিলা যোদ্ধা নিকো লোপেজের শেষ চিঠি। চিঠিতে নিকো বাস্তবতার প্রেক্ষিতে স্বৈরাচারী বাতিস্তার বিরুদ্ধে বিপ্লবের অপরিহার্যতা বোঝাতে বলেন, আমরা সবাই যুদ্ধ এবং আত্মত্যাগের ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয়ী। কিউবাবাসীকে বুঝতে হবে এটাই সর্বাত্মক প্রচেষ্টা তাদের মাতৃভূমির জন্য। তুমি মনে করো তোমার হৃদয়ে সর্বোচ্চ এবং উন্নত গুণাবলী আছে? তুমি কারও জন্য তা বিলিয়ে দেবে যে সত্যিকার অর্থেই তা অনুভব করছে। যিনি পৃথিবীর সকল সম্পদের মতোই মানবিকতা, সুন্দর এবং মানুষের মিষ্টিগুণগুলোকে বুঝতে পারে। নিকো দৃঢ়প্রত্যয়ী একজন নির্বাসিত বিপ্লবী ছিলেন; যিনি তার লক্ষ্য থেকে কখনও সরে যাননি তাই মৃত্যুর বহু বছর পেরিয়ে গেলেও কিউবা তাঁকে শ্রদ্ধাভরে মনে রাখে। অদম্য বিপ্লবী নিকো লোপেজের পিতা ডন জুয়ান অ্যালবিন এবং মা কনসেপসিয়ন ফার্নান্দেজ। নিকোর পূর্বপুরুষদের বসবাস গালিসিয়াধীন স্পেনের লুগো প্রদেশে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যুদ্ধ, খরাসহ নানা কারণে গালিসিয়ায় অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় তখন নিকোর বাবা মা আরও অনেকের মতো অভাবতাড়িত অভিবাসী হয়ে কিউবার রাজধানী লা হাভানায় আসেন। লা হাভানা প্রদেশের অধিভুক্ত মারিয়ানো শহরের অদূরে লা লিসা নদীবন্দর এলাকায় ১৯৩২ সালের ২ অক্টোবর এ্যালবিন এবং ফার্নান্দেজ দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করে বিপ্লবী নিকো লোপেজ। অর্থাৎ নদী ঘেঁষা লা লিসা এলাকায় নিকো এবং তার বোন হর্টেনসিয়ার জন্ম এবং বেড়ে উঠা। দরিদ্র পিতা মাতার অভাবের সংসারে নানা অনটন সয়ে বেড়ে উঠেন নিকো। অভাবের তাড়নায় নিজ দেশ স্পেনের লুগো ছেড়ে কিউবায় এসে নিদারুন কষ্ট করেছেন নিকোর পিতা ডন জুয়ান অ্যালবিন কিন্তু আর সব শোষিত শ্রমিকের মতোই হাঁড়ভাঙ্গা খাটুনি শেষে সেইভাবে অর্থ উপার্জন করতে পারেননি। পেটের দায়ে দু’বেলা দু’মুঠ আহারের ব্যবস্থা করলেও সন্তানদের লেখাপড়া করানোর মতো খরচ করতে পারেননি ফলে নিকো মাত্র ১০ বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষার তৃতীয় ধাপ সম্পন্ন করেই বিদ্যালয় ত্যাগ করেন। অভাবের তাড়নায় স্কুলহারা নিকো বাবার সঙ্গে সাংসারিক কাজে মনোনিবেশ করেন। পরবর্তীতে একটু ভাল কাজের আশায় নিকোরা চলে আসেন লা হাভানা শহরের কাছাকাছি কুয়াট্রো ক্যামিনোতে, এখানে এসে নিকো তার বাবার সঙ্গে পুরনো ট্রাকে মাল ওঠানামার কাজ করতেন। এছাড়াও নিকো একটু স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার আশায় লটারির টিকিট বিক্রি, সেলসম্যান, দোকানের কর্মচারী এবং পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। অভাবের তাড়নায় বিদ্যালয় ছেড়ে গেলেও স্বশিক্ষায় শিক্ষিত নিকো জীবনকে একটা মানবিক এবং যৌক্তিক বিষয়ের কাছে রাখতে চেয়েছেন। তিনি মনে করতেন, রাজনীতি কথা বলার নিয়মতান্ত্রিক জায়গা এবং বিপ্লব সেই কথার চূড়ান্ত প্রতিবাদ। মাত্র ১৫ বছর বয়সে নিকো কিউবান পিপলস পার্টিতে যোগ দেন এবং খুব শিক্ষিত না হয়েও একক দক্ষতা বলে দলের কর্র্মী এবং ছাত্রবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ পদ অর্জন করেন। কিউবান পিপলস পার্টিতে নিকোর নেতৃত্ব ছিল পরিচ্ছন্ন, সে দৃঢ়ভাবে সামনে থেকে কথা বলতেন এবং দলের অসৎ কর্মীদের সভায় তিরস্কার করতে ভুল করতেন না। নিকোর নির্মল নেতৃত্ব দলের জন্য ভালো হলেও দলের অনেক রক্ষণশীল নেতা তা পছন্দ করতেন না। ১০ মার্চ ১৯৫২ সালে মার্কিন মদদপুষ্ট ফুলজেনসিও বাতিস্তা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতা দখল করে। ঘৃণিত এই সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে রাজপথে বিক্ষোভ করার সময় পুলিশের নির্যাতনে মারা যায় কার্লোস রদ্রিগেজ। অন্যায় অভ্যুত্থান এবং পুলিশী নির্যাতনে কার্লোস রদ্রিগেজের মৃত্যুর প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত সভায় কিউবান পিপলস পার্টির একজন নেতা হিসেবে ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে দেখা করেন নিকো। ফিদেল নিকোর নেতৃত্বে মুগ্ধ হন এবং অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ভবিষ্যৎ বিপ্লব পরিকল্পনায় যুক্ত করে গেরিলাবিষয়ক লিফলেট বিতরণসহ যাবতীয় প্রচার ও প্রকাশনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। চাতাল কলে কাজ করতে যাবেন বাবা মাকে এই বলে ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন তরুণ নিকো লোপেজ। ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই বিকেল পাঁচটা নাগাদ আর্মি গ্যারিশন বায়োমো আক্রমণ এবং নির্যাতন উপেক্ষা করে কিউবাস্থ গুয়াতেমালা দূতাবাসে আশ্রয় গ্রহণ। এর পরের কথা কেবলই ইতিহাস। খুব অল্প সময়ের মধ্যে নিকো আরও কয়েকজন বিপ্লবীসহ কিউবা ছেড়ে গুয়াতেমালায় পৌঁছান এবং রাজনৈতিক নির্যাতনে নির্বাসিত কিউবান হিসেবে গুয়াতেমালায় জীবনযাপন শুরু করেন। আর্জেন্টিনা থেকে আগত ভবঘুরে ডাক্তার আর্নেস্তো গুয়েভারা লাতিন আমেরিকায় তাঁর দ্বিতীয় সফরকালে নিকারাগুয়া হয়ে গুয়াতেমালায় আসেন ১৯৫৩ সালের ১৪ ডিসেম্ভর। গুয়াতেমালায় এসে ১৯৫৪ সালের প্রথম দিকে ডাক্তার আর্নেস্তোর সাথে পরিচয় হয় পেরু থেকে নির্বাসিতা বিপ্লবী হিলদা গাদেয়া আকোস্তার সঙ্গে। পেরুভিয়ান নির্বাসিতা হিলদার মাধ্যমে গুয়াতেমালায় আরও বেশ ক’জন নির্বাসিত বিপ্লবীর সঙ্গে পরিচয় হয় যারা সরাসরি কিউবা বিপ্লবের সঙ্গে জড়িত। মূলত হিলদার মাধ্যমেই একদিন ডা. আর্নেস্তো গুয়েভারার সঙ্গে কথা হয় কিউবা থেকে নির্বাসিত বিপ্লবী আন্তেনিও নিকো লোপেজ ফার্নান্দেজ বা নিকো লোপেজের সঙ্গে। প্রথম সাক্ষাতেই পরস্পরে মুগ্ধ নিকো ডা. আর্নেস্তোকে এল চে’ বলে সম্বোধন করেন। সে সময় আর্জেন্টিনা বা উরুগুয়ে থেকে গুয়াতেমালায় আগত ব্যক্তিদের সম্মান করে এল চে বা চে বলে সম্বোধন করা হতো। মূলত প্রথম সাক্ষাতে আর্নেস্তোকে দেওয়া গেরিলা বন্ধু নিকো লোপেজের চে নামটিই একসময় বিশ্বময় জনপ্রিয় এক নামে পরিণত হয় যা ইতিহাসকে হার মানানো এক অনন্য ইতিহাস। হনডুরাস বাহিনীর গুয়াতেমালা আক্রমণ এবং ১৯৫৪ সালের ২৭ জুন কর্নেল জাকোবো আরবেনজ গুজমানকে উৎখাত করা হলে ১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বরে আর্নেস্তো আরও ক’জন নির্বাসিতের সঙ্গে মেক্সিকোতে এসে পৌঁছেন। মেক্সিকোতে এসে চে পেরুবিয়ান নির্বাসিতা হিলদা গাদেয়াকে বিয়ে করেন। মেক্সিকোতে এসেও সংসার জীবনের পাশাপাশি চে স্ত্রী হিলদার মাধ্যমে নির্বাসিত বিপ্লবী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। মেক্সিকোতে চে’র সঙ্গে আবারও দেখা হয় নির্বাসিত বন্ধু নিকো লোপেজের সঙ্গে যার অন্যতম পরিচয় তিনি মানকডা ব্যারাক আক্রমণের নায়ক ফিদেল কাস্ত্রোর ছোট ভাই রাউল কাস্ত্রোর বন্ধু। নিকো লোপেজের মাধ্যমে ১৯৫৫ সালের জুন মাসে চে’র পরিচয় হয় গেরিলা নেতা রাউল কাস্ত্রোর সঙ্গে এবং নিকো লোপেজের হাত ধরেই রাউল কাস্ত্রোর মাধ্যমে ১৯৫৫ সালের ৮ জুলাই রাতের বেলায় মারিয়া এন্তোনিয়ার বাড়িতে কথা হয় চে এবং ফিদেল কাস্ত্রোর। এভাবেই ইতিহাসের মোড় নির্মাণে এক গুরুত্ববহ ভূমিকা রাখেন নিকো লোপেজ। নিকোর মাধ্যমে চে ফিদেলের সাক্ষাতে মেক্সিকো থেকে কিউবা আক্রমণের নতুন ছক আঁকা হয়। গেরিলা আক্রমণের রণকৌশল হিসেবে স্থির করা হলো মেক্সিকো থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পূর্ব উপকূল বরাবর কলোরাডাস দিয়ে কিউবা দ্বীপ আক্রমণ করা হবে। ১৯৫৬ সালের ২৫ নবেম্বর মধ্যরাতে মেক্সিকোর ভেরাক্রুজ প্রদেশের টাক্সপান বন্দর থেকে ফিদেল, চে, নিকোসহ ৮২ জন গেরিলা যোদ্ধা গ্রানমা জাহাজে চড়ে কিউবার উদ্দেশ্যে ক্যারাবিয়ান সাগর পাড়ি দেন। সাতদিন সমুদ্র পথ পাড়ি দিয়ে ১৯৫৬ সালের ২ ডিসেম্বর গেরিলাবাহী গ্রানমা চর লাস কলোরাডাসের গহীন গ্রাম নিকোয়েরো আসেন। একজন কৃষকের সহায়তায় গেরিলারা গহীন জঙ্গলের নিরাপদ জায়গায় এলেন যার পাশেই ছিল নিঝুঁম আখ ক্ষেত। কৃষকটি গেরিলাদের পথ দেখিয়ে ফিরে যায় এবং অদূরে থাকা বাতিস্তা বাহিনীকে খবর দেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ক্লান্ত ক্ষুধার্ত গেরিলাদের উপর শুরু হলো মেশিনগানের গুলি। একদিকে স্থল বাহিনীর আক্রমণ অন্যদিকে হেলিকপ্টার থেকে নাপাম বোমা আর বৃষ্টির মতো গোলাবারুদ পড়তে লাগল। নাপাম বোমার আঘাতে আখ ক্ষেত আর আশপাশের জঙ্গল দাউ দাউ জ্বলছে। অতর্কিত আক্রমণে হতভম্ব গেরিলা বাহিনী প্রতিরোধ আক্রমণ করে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ফিদেল, চে বিছিন্ন হয়ে গহীন জঙ্গলে আশ্রয় নিলেও গেরিলাদের অনেকেই বাতিস্তা বাহিনীর হাতে বন্দী ও নিহত হন। অতর্কিত আক্রমণে ক্লান্ত নিকো আরও চার গেরিলা যোদ্ধাসহ গহীন জঙ্গলে আত্মগোপন করেন এবং ৭ ডিসেম্বর লেফটেন্যান্ট জুলিও লরেন্টের হাতে বন্দী হলে তাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর। অনেক দিনÑঅনেক বছর আগে। আজ নিকো মানে ২৪ বছরের একটা জ্বলন্ত গেরিলা জীবন যা কক্ষণই নিভে যাবে না। অনাদিকাল গেরিলা নিকো নীতি আদর্শ আর দেশেপ্রেমের কথা বলছে অনাগত যোদ্ধার কাছে।
×