ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ স্বাধীনতা জন্মগত অধিকার

প্রকাশিত: ০৯:১৭, ১৭ জানুয়ারি ২০২০

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ স্বাধীনতা জন্মগত অধিকার

(গত শুক্রবারের পর) আমরা জানি ইসলাম প্রকৃত স্বাধীনতার কথা বলে। আইয়ামে জাহিলিয়াতে শুধু আরব সমাজেই নয়, জগতজুড়ে মানবতা এক মারাত্মক হুমকির মধ্যে নিপতিত ছিল। ক্রীতদাস প্রথা এমন মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল যে, গরু-ছাগল, উট-মহিষ, মেষ-দুম্বার মতো মানুষও হাটে-বাজারে বিক্রি হতো। নারী সমাজের মর্যাদা একেবারে ছিল না। তারা সাধারণ পণ্যসামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হতো। তাদের আত্মাহীনা, শয়তানের ফাঁদ, ছলনাময়ী প্রভৃতি নানা বদনামে ভূষিত করা হয়েছিল। মদ্যপান, সুদ, লুণ্ঠন, কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া, গুম, খুন, হত্যা, রাহাজানি, কল্পনাপ্রসূত দেব-দেবী, কাঠ-পাথর-মাটি দিয়ে বানিয়ে সেগুলোর পূজা করা প্রভৃতি মানবতাকে এক করুণ ও অপমানজনক অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। আইনের শাসন বলতে কোথাও কিছু ছিল না। মানবিক মূল্যবোধ বলতে কোথাও কিছু ছিল না। সর্বত্র বিরাজ করছিল নৈরাজ্য ও নৈরাশ্য। স্বাধীনতা কল্পনাতীত বিষয়ে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে ইসলামের শান্তির বাণী, স্বাধীনতার বাণী নিয়ে আবির্ভূত হলেন হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম। তিনি আল্লাহর দেয়া পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা আল ইসলামের দিকে সবাইকে আহ্বান করলেন। তিনি সর্বস্তরের মানুষকে, নারী-পুরুষ সবাইকে একটি সুসংহত স্বাধীন সত্তা বিকাশের দিকে পরিচালিত করলেন। তিনি বললেন : প্রতিটি মানব শিশুই ভূমিষ্ঠ হয় ফিত্রতের ওপর। এই ফিত্রত বা প্রকৃতিই মানুষের স্বাধীন সত্তার পরিচয় বহন করে। এই স্বাধীনতাকে হরণ করা, ক্ষুণœ করা কিংবা কারও স্বাধীনতাকে বিপন্ন করার অধিকার ইসলাম দেয় না। তবে স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, যা ইচ্ছা তা-ই করা যাবে, অন্যের সম্পদ গায়ের জোরে আত্মসাত করা যাবে, বিনা অপরাধে কাউকে হত্যা করা যাবে, দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করা যাবে। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : লা তুফসিদু ফিল্্ আরদ-পৃথিবীতে সন্ত্রাস সৃষ্টি করো না। (সূরা বাকারা : আয়াত ১১)। কুরআন মজিদে এটাও ইরশাদ হয়েছে যে, প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং জখমের বদলে অনুরূপ জখম। অতঃপর কেউ ক্ষমা করলে তাতে তারই পাপ মোচন হবে। আল্লাহ্ যা নাজিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না তারাই জালিম। (সূরা মায়িদা : আয়াত ৪৫)। স্বাধীন দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব একটি অমূল্য সম্পদ এবং আল্লাহর এক মহানিয়ামত। একে রক্ষা করার জন্য যারা সীমান্ত প্রহরায় থাকে কিংবা এর হিফাজতের জন্য সর্বস্তরের মানুষ নিজেদের গরজে এবং জনস্বার্থে দেশ গঠনমূলক কাজে ব্যাপৃত থাকে তাদের জন্যও রয়েছে অশেষ পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি। সুদ, ঘুষ, ব্যভিচার, চুরি, রাহাজানি, ছিনতাই এসবই স্বাধীনতার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অপরের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে-শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকের নিকট পেশ কর না। (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৮)। প্রিয়নবী হযরত রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : আররাশী ওয়াল মুরতাশী কিলাহুমা ফীন্ নার- ঘুষদাতা এবং ঘুষ গ্রহীতা উভয়েই জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। (ইবনে মাজা)। ঘুষ যেমন মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দেয়, সমাজরন্ধ্রে দুর্নীতির বিষবাষ্প ছড়িয়ে সমাজ জীবনকে নিশ্চিত অবক্ষয়ের পথে নিয়ে যায়, তেমনি সুদও শোষণের এক মস্তবড় হাতিয়ার, যা অর্থনৈতিক জীবনে একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির জন্ম দেয়। সাময়িক লাভের স্বপ্ন দৃষ্ট হলেও এটা মারাত্মক ব্যাধির মতো হয়ে দাঁড়ায়, অনেক সময় দেউলিয়া পর্যায়ে নিয়ে যায়। কুরআন মজিদে সুদের ব্যাপারে কঠোর নিষেধসূচক বিধান দিয়ে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : যারা সুদ খায় তারা কিয়ামতে সেই ব্যক্তিরই মতো দাঁড়াবে যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে। এটা এই জন্য যে, তারা বলে ক্রয়-বিক্রয় তো সুদের মতো। অথচ আল্লাহ্ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম। (সূরা বাকারা : আয়াত ২৭৫)। আল্লাহ্ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বাড়িয়ে দেন। (সূরা বাকারা : আয়াত ২৭৬)। স্বাধীনতা মানুষের সুখী জীবনযাপনের নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে। তবে ইসলাম যা হারাম করেছে, যা পানাহার করতে নিষেধ করেছে তা করার স্বাধীনতা ইসলাম দেয় না। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : হে মানব জাতি! পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ, পবিত্র (হালালান্ তাইয়েবা) খাবার জিনিস আছে তার থেকে তোমরা আহার করো। (সূরা বাকারা : আয়াত ১৬৮)। ইসলাম পরনিন্দা, পরচর্চা, কারও বাড়িতে বা জমিতে জোর করে অনুপ্রবেশ ইত্যাদি কর্ম করার স্বাধীনতা দেয় না। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : তোমরা একে অপরের গিবত করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশ্ত খেতে পছন্দ করবে? না, তোমরা তো তা অপছন্দ করো। (সূরা হুজুরাত : আয়াত ১২)। গিবত করাও যেমন জঘন্য কাজ, তা শোনাটাও জঘন্য কাজ। এমনিভাবে আমরা লক্ষ্য করি স্বাধীনতা মানে মানবাধিকারের নিশ্চয়তা বিধানের একটা সুন্দর, সুশোভিত ও সুমিষ্ট ফল। যারা স্বাধীনতাকে বিপন্ন করে তোলে, তারা মানবতাকে অপমান করে- আল্লাহ্র এই মহা নিয়ামতকে অবজ্ঞা করে। (সমাপ্ত) লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ
×