ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জুয়েল হাসান

পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকিতে বিশ্ব

প্রকাশিত: ১২:৩২, ১৫ জানুয়ারি ২০২০

পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকিতে বিশ্ব

লিটল বয় ও ফ্যাটম্যান হিরোশিমা এবং নাগাসাকিকে পুড়িয়ে ছারখার করার পর ৭৫ বছর পার হয়ে গেছে এবং পারমাণবিক বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) কার্যকর হওয়ার ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। তবুও বিশ্ব কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কটের পরে যে কোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে বৃহত্তর পারমাণবিক যুদ্ধের বিপদে রয়েছে। জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টক্কর দিতে ইরান পরমাণু বোমা বানাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে এবং এক বছরের মধ্যে তা তারা করতে পারে বলেও বিশেষজ্ঞদের অভিমত। যদি তাই হয় তবে সৌদি আরব এবং তুরস্কও অবশ্যই ইরানের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। ইসরাইলও পরমাণু বোমার অধিকারী। এশিয়ায়ও বেশ কয়েকটি পারমাণবিক প্ল্যান্ট রযেছে। তবে সবচেয়ে ভযাবহ বিষয় হচ্ছে যে কোন মুহূর্তে এ বোমা সন্ত্রাসবাদী বা অন্যান্য সরকারবহির্ভূত গোষ্ঠীর হাতে পড়তে পারে যাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়া বা নিরস্ত্র করা শক্ত কাজ। পরমাণু বোমার বিস্তারকে ধীর করার জন্য বিশ্ব এখনও এনপিটির ওপর নির্ভর করে। এই চুক্তিতে সই করা বর্তমান সদস্য দেশ ১৯১। কূটনীতিক এবং জনসাধারণ যদি গেম তত্ত্বটি পড়েন তবে তাদের ভয় আরও বাড়বে। এই তত্ত্বের মোদ্দাকথা হচ্ছে ‘তোমার যা আছে আমারও তাই থাকতে হবে বা আমার যা নেই তোমারও তা থাকতে পারবে না।’ ওয়াশিংটন ভিত্তিক নিউক্লিয়ার থ্রেট ইনিশিয়েটিভের মতে ক্ষুদ্রাকৃতির বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক বোমা তৈরি হয়েছে বিশ্বে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া এবং ইসরাইল পরমাণু অস্ত্রে সমৃদ্ধ। পৃথিবীর জন্য এটা আশীর্বাদ যে ভুল করে কোন পারমাণবিক বোমা ছোড়া হয়নি এখন পর্যন্ত। কিন্তু ক্রমেই এই আশঙ্কা বাড়ছে। ভুলে বিস্ফোরণের সম্ভাবনার পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে বহু পক্ষের বিবাদে জড়িয়ে যাওয়াও পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। সমালোচকদের মতে, রাজনীতিবিদ ও জেনারেলদের কাছে ছোট ছোট অস্ত্রই বেশি প্রিয় হয়ে উঠবে। ছোট ছোট এত পারমাণবিক অস্ত্র থাকলে সেগুলো হ্যাকিংয়ের শিকার হতে পারে যে কোন সময়ে। তখন নির্দিষ্ট করে জানাটাও কঠিন হবে আক্রমণটা কোন পক্ষ শুরু করেছিল। তৃতীয় কোন পক্ষ হ্যাকিং করে দুইপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়েও দিতে পারে। নতুন নতুন যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে যে জরুরী অবস্থা দেখা দিচ্ছে তাতে ঐতিহাসিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তিগুলো দিন দিন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে। গত বছর রাশিয়ার সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৮৭ সালে আইএনএফ চুক্তিতে সই করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান ও সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ। এটি পরমাণু যুদ্ধের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা ছিল। কিন্তু সেটি সরে গেল। দেশে দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিরা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসছেন। এরা নিঃসন্দেহে পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। গবেষণা সংাগুলোর ধারণা যুক্তরাষ্ট্রের হাতে পরমাণু অস্ত্র আছে ৬ হাজার ১৮৫, রাশিয়ার ৬ হাজার ৫০০, ফ্রান্সের ৩০০, যুক্তরাজ্যের ২১৫, চীনের ২৯০, ভারতের ১৩০-১৪০, পাকিস্তানের ১৫০-১৬০, ইসরাইলের ৮০-৯০, আর উত্তর কোরিয়ার আছে ২০-৩০টি। সব দেশই এসব তথ্যের বিষয়ে কড়া গোপনীয়তা বজায় রাখে। পরমাণু বোমাগুলো বসানো আছে বিভিন্ন সামরিক বিমান ঘাঁটিতে বা অস্ত্রের গুদামে। বিভিন্ন দেশে এখন শত শত পারমাণবিক বোমা বসানো ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা আছে। আমেরিকান ক্ষেপণাস্ত্রগুলো বসানো আছে বেলজিয়াম, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস এবং তুরস্কে। সব পরমাণু শক্তিধর দেশই এখন তাদের অস্ত্রগুলোর আধুনিকায়ন করছে। ভারত, ইসরাইল আর পাকিস্তান কখনও এনপিটিতে সই করেনি। উত্তর কোরিয়া সই করেও ২০০৩ সালে বেরিয়ে যায়। এই চুক্তি অনুযায়ী স্বীকৃত পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হচ্ছে মাত্র পাঁচটি স্বাক্ষরকারী দেশÑ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও চীন। দক্ষিণ আফ্রিকা, বেলারুস, কাজাকস্তান ও ইউক্রেন তাদের পরমাণু কর্মসূচী পরিত্যাগ করেছে। অন্যদিকে চীন, পাকিস্তান, ভারত ও উত্তর কোরিয়া তাদের পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে পরমাণু যুদ্ধ হলে দুই দেশের সাড়ে ১২ কোটি মানুষের মৃত্যু হবে। আসবে ‘পরমাণু শীত’ যা বিশ্ব জলবায়ুকে আমূল বদলে দেবে। আমেরিকার রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউ বার্নসউইকের সহ-লেখক এ্যালান রোবকের মতে, যেখানে বোমা টার্গেট করা হবে শুধু সেই জায়গাই নয়, এ ধরনের যুদ্ধে ভয় রয়েছে গোটা বিশ্বের। ২০২৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি চলেছে দুই প্রতিবেশী দেশ। মিলিতভাবে তারা ২০২৫ সালের মধ্যে ৪০০ থেকে ৫০০টি পরমাণু অস্ত্র মজুদ করে ফেলবে। পরমাণু যুদ্ধ হলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের জমির ওপর সবুজায়ন ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমে যাবে এবং সমুদ্রের উৎপাদনও ৫ থেকে ১৫ শতাংশ কমে যাবে। প্রত্যেকটি অস্ত্রের বিস্ফোরণে প্রাণ যাবে ৭ লাখেরও বেশি মানুষের। পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্ফোরণের কারণে সৃষ্ট আগুন থেকে ৩ কোটি ৬০ লাখ টনের বেশি কালো কার্বন নিঃসরণ হবে, যা বায়ুম-লের ওপরে চলে যাবে এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। এর ফলে বিশ্বের অনেক অংশে সূর্যের আলো কোনভাবেই পৌঁছাবে না। কারণ ওই কালো কার্বনের স্তর ভেদ করে সূর্যের আলো পৃথিবীতে আসতে পারবে না। শুধু তাই নয়, ভূপৃষ্ঠকে শীতল করবে প্রায় ৯ ডিগ্রী, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাবে ৩০ শতাংশ। যে কারণে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক খাদ্য সঙ্কট এবং গণঅনাহার ও মৃত্যুর হুমকি তৈরি হবে। শীতলতা এমন পর্যায়ে নেমে আসবে, যা গত বরফ যুগের পর আর কখনই দেখা যায়নি। যে কোন ধরনের যৌক্তিক পরিস্থিতি বিবেচনায় পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার হতে পারে না। তবে দুর্ঘটনাবশত অথবা হ্যাকিংয়ের কবলে পড়ে বা আতঙ্কিত হয়ে বিশ্ব নেতারা এই অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন। এটি ঠেকানোর একমাত্র উপায় এই অস্ত্র ধ্বংস করে ফেলা। সূত্র : ব্লুমবার্গ, বিবিসি ও এএফপি
×