ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অভিমত ॥ শিকলে বন্দী জীবন!

প্রকাশিত: ০৯:০১, ১৫ জানুয়ারি ২০২০

অভিমত ॥ শিকলে বন্দী জীবন!

আধুনিক কথাশিল্পের পথিকৃত ফ্রান্স কাফকার ‘মেটামরফোসিস’ বা রূপান্তর গল্পের মূল চরিত্র যুবক গ্রেগর সামসার কথা আমরা অনেকেই কমবেশি জানি। সেই সামসা শরীরের রূপান্তরে মানুষ থেকে পোকা হয়েছিলেন। কিন্তু তার চিন্তাশক্তি বিবেচনা ও বাস্তবজ্ঞান ছিল একজন সুস্থ মানুষের। এই গল্পের মাধ্যমে কাফকা পুঁজিবাদী শাসক ও শোষক শ্রেণীর অকল্যাণমূলক সমাজ ও অর্থনীতির জাঁতাকলে সীমিত আয়ের গ্রেগর হয়ে গেল পোকা। এরপর গ্রেগরের আয়ের উপর নির্ভরশীল তার বোন, মা-বাবা সকলে গ্রেগরের রূপান্তরিত পোকার জীবন কেমনে সামাল দেয়? গ্রেগর এখন বন্দী পোকা। কাফকার গল্পটি মোটামুটি এরকম। সময়টা ছিল ১৯১৫ সালের দিকে। এই বাস্তবতার এক শ’ বছর পেরিয়ে ২০২০ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে ‘মধুপুরে শুকুরের শিকলবন্দী জীবন’ শিরোনামের একটি খবর প্রকাশ পেল সম্প্রতি। এই শুকুর কে? এই শুকুর ছাত্র হিসেবে দারুণ মেধাবী। কৃতিত্বের সঙ্গেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে উচ্চবিদ্যালয়েও ভর্তি হয়েছিল। সমস্যা হলো তার বাবা হতদরিদ্র এক দিনমজুর। এটাই তার কাল হয়ে এলো। আর্থিক টানাপোড়েনে পড়াশোনা আর চালিয়ে যেতে পারল না। স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে নির্মাণ শ্রমিকের কাজে যোগ দিল। তাতেও ভালই চলছিল। তার কাজে সকলেই খুশি। একদিন কয়েক পরিজন একটা ঠুনকো অজুহাতে শুকুরকে মারধর করে। মাথায় প্রচ- আঘাত লাগে। তারপর তার কথাবর্তা আর আচরণ অস্বাভাবিক হতে শুরু করে। গরিব বাবা-মা টাকা পয়সার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেন না। শেষে যা হবার ছিল না তাই হয়ে গেল। আশপাশে লোকজন পাগল ডাকা শুরু করে দিল। শুকুর হয়ে গেল বদ্ধ এক পাগল। অসহায় বাবা-মা ছেলে হারিয়ে যাবার ভয়ে শিকলে বন্দী করে রাখে- একদিন নয় দুই দিন নয়, একে একে পনেরো বছর। একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় শিকলে বাঁধা শুকুরের বন্দী জীবনের শুরু ২০০৪ সালে। প্রতিবেদনে শুকুরের গ্রামটিকে অজপাড়া গাঁ বলা হলেও দিগর বাইদ আজ আর সে অর্থে অজপাড়া গাঁ নয়। গ্রামে রয়েছে সরকারী বিদ্যালয়। প্রায় সারাক্ষণ জমজমাট হাটবাজার। যেখানে রয়েছে নানা বাহারি দোকান, বিকিকিনির পসার বসে প্রতিদিন। উপজেলা সদর থেকে গ্রাম অবধি পাকা রাস্তা। এই গ্রামে মসজিদ যেমন রয়েছে, ধার্মিক লোকেরও কমতি নেই। সরকারী চাকরিজীবী যেমন রয়েছেন, তেমন রয়েছেন ব্যাংকার, উকিল, মাস্টার, অধ্যাপক, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যও। তবে কারও নজরেই পড়েনি হতভাগ্য শুকুরের জীবনের এই করুণ দশা। আদম সন্তানরূপী অক্ষম এক পোকার কথা বলি। গালিটা নিজেই নিজেকে দিলাম। আমার জন্মও শুকুরের গ্রামেই। এই পনেরো বছর ধরেই আমি জীবিত। খবরটা জানতাম না। রুটিরুজির পেছনে ছুটে দেশে বিদেশের নানা জায়গায় দৌড়ের ওপর থেকে জানতে পারিনি নিজের জন্মগ্রামের শুকুরের যে এই পরিণতি। মাস কয়েক আগে আমার ছোট ভাই ফোন করে জানাল শুকুরের দুর্দশার কথা। ঘটনা শোনার পর আমি তো থ মেরে গেলাম। আমার বন্ধু যুগান্তরের নামকরা সাংবাদিক এসএম শহীদকে ঘটনাটা জানালাম। শহীদের কল্যাণে শুকুরের ছবি আজ জাতীয় পত্রিকায়। আহা! এই জন্যেই কি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ বর্বরদের উদ্দেশে লিখেছিলেন, শিকল পরা ছলরে মোদের শিকল পরা ছল- এই শিকল পরে শিকল তোদের করবেরে বিকল। নজরুলের এই প্রকাশ ছিল শত বছর পূর্বে। মেধাবী শুকুরের জীবনে পরিজনের অন্যায়ে যে শিকল, এই শিকল কি বিকল হবে না? এই অন্যায়ের কি বিচার হবে না? শুকুর কেন শুধু আমাদের বিবেক ও মনুষ্যত্বও কি শিকলে বন্দী নয়? যে গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম। কাফকার মেটামরফোসিস। গল্পে গ্রেগর মানুষ থেকে পোকা হয়ে চিন্তাশক্তিটা মানুষেরই রাখতে পেরেছিল। আর আমরা শরীরে গড়নে গঠনে মানুষ থেকে বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে নিজের ভালটা বুঝে যাব, সফল হব, আর শুকুরের জীবন বিনা চিকিৎসায়, শিকলে বাঁধা পড়ে রবে? না! না! এই জীবন আমাদের পোকার জীবনের চেয়ে উত্তম কোন অংশে? তবে কর্তৃপক্ষ যদি শুকুরের মতো হতভাগ্যদের ব্যাপারে তথ্যানুসন্ধান শুরু করে- সারাদেশে এরকম আরও অনেক শুকুর বেরিয়ে এলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না। যেমন এখন যদি আমাদের মানুষের পরিবর্তে পোকা আখ্যা দেয়া হয়, অবাক হবার কি আছে শুনি? কারণ আমরা তো পোকাই, জেগেও ঘুমাই, আবার ঘুমালেও জাগতে চাই না! আমরা কি আদতে পোকা হয়ে গেলাম? একটি প্রশ্ন রেখে লেখাটি শেষ করতে চাই। পনেরো বছর ধরে শিকলে বন্দী মেধাবী ছাত্র শুকুরকে শিকল থেকে মুক্ত করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য আমার, আপনার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কি কিছুই করার নেই? লেখক : কথাসাহিত্যিক
×