ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৯:০৭, ১৪ জানুয়ারি ২০২০

ঢাকার দিনরাত

শীতের কেচ্ছা দিয়ে কলাম শুরু করতে চাইছি না। যদিও ঢাকাবাসীর সামনে এটিই এখন বড় এজেন্ডা। এই শীতে মাঝেমধ্যে ছিটেফোঁটা বৃষ্টিও হচ্ছে। শনিবার পুরোটাই গেল সূর্যালোকবিহীন। তবু শীত নিয়ে বিশেষ কিছু বলতে চাই না কেবল মানুষের ভেতর মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সহজাত স্বতঃস্ফূর্ত স্বভাবের বিষয়টি ছাড়া। শীতার্তদের শীতবস্ত্র বিতরণের কর্মসূচী কেবল কর্পোরেট কালচার হয়ে উঠেছে, একথা যারা বলেন তাদের কথা শতভাগ মিথ্যা বলতে পারলে স্বস্তি পেতাম। এখন নির্লজ্জভাবে প্রদর্শন চলে নগণ্য উপকারের। বরং তার চাইতে বেশিই হয়তো উপকার করে চলেন সাধারণ মানুষ। তারা কোন প্রচারের ধার ধারেন না। এমনকি নিজেদের মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় একখানা ছবিও তুলে রাখেন না। এই শীতের মধ্যে এক বস্তা আর এক স্যুটকেস ভর্তি গরম কাপড় নিয়ে এক বন্ধু গিয়েছিলেন পূর্বাচল সড়ক ধরে রূপনগর পেরিয়ে আরও দূরের একটি গ্রামে। সফরসঙ্গী হওয়ার বদৌলতে সবই প্রত্যক্ষ করেছি। ওই গ্রামের একজন প্রায় বিত্তহীন মানুষের কাছেই পৌঁছে দেয়া হলো শীতবস্ত্রগুলো। তিনিই সত্যিকার বুঝবেন ওই গ্রামে কার কার বাড়িতে প্রকৃতই অভাব রয়েছে শীতবস্ত্রের। সে যাক। অভাবিত অভূতপূর্ব ঢাকায় কোন কোন ঘটনা ঘটার পর আমাদের এমন উপলব্ধি হয় যে এ ধরনের ঘটনা অভূতপূর্ব। এর আগে কখনও ঘটেনি। এমন অপরাধ ঢাকায় প্রথম সংঘটিত হলো। অথচ বিষয়টি তা নয়। যারা একটু সচেতন এবং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সংবাদপত্র পড়ে থাকেন তারা বিলক্ষণ জানেন প্রায় প্রতি বছরই জাল নোট তৈরির সরঞ্জামসহ ধরা পড়েন কেউ না কেউ। ঢাকায় কত বিচিত্র পেশার মানুষই না রয়েছে। এমনকি মানুষ খুন করার পেশার লোকও এখানে মিলবে। আর জাল নোট ছাপানোর কাজ তো নস্যি। তবে এবার ধানম-ির মতো জায়গায় এমন একটি ‘কারখানা’র খোঁজ মেলায় আমরা কিছুটা বিস্মিতই হয়েছি। কেননা এসব ‘কারখানা’ থাকবে বাড্ডায়, বস্তিতে, পুরনো ঢাকার তস্যগলি কিংবা কেরানীগঞ্জেÑ এমনটাই আমাদের ধারণা। এবার তাই মহানগরীর অন্যতম অভিজাত এলাকায় এমন কা-কারখানার হদিস পেয়ে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। খবরের কাগজগুলোও বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে এ সংবাদের। লেখা হয়েছে : বিশ বছর আগে জাল নোট তৈরির সঙ্গে যুক্ত হয় ফরিদপুরের সাইফুল ইসলাম ও পটুয়াখালীর শাহ আলম। গত বিশ বছরে তাদের চক্রটি কোটি কোটি টাকার জাল নোট দেশের বাজারে ছেড়েছে। তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে এ কাজে জড়িত রয়েছে বেশ কয়েকজন। এছাড়া দেশজুড়েই রয়েছে তাদের প্রতিনিধি ও ক্রেতা। এই চক্রের সদস্যদের আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র‌্যাব ১০-এর কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানান। গত বিশ বছরে কয়েকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতারের পর ছাড়া পেয়ে আবার একই কাজে জড়িত হয়েছে তারা। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) রাতে কদমতলী এলাকা থেকে শাহ আলমকে প্রায় দুই লাখ জাল টাকাসহ আটক করে র‌্যাব। এরপর তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ধানম-ির ৭/এ সড়কে কারখানাটির সন্ধান পায় র‌্যাব-১০। শুক্রবার সকাল থেকে বাসাটির তৃতীয় তলায় অভিযান চালিয়ে এক কোটির বেশি টাকার মূল্যের জাল নোটসহ সাইফুল ইসলামকে আটক করা হয়। আসা যাক আরেকটি প্রসঙ্গে, ধর্ষণ। ঢাকায় প্রতি মাসেই ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। বলতে পারেন তার সংখ্যা কত? সব ঘটনা মিডিয়ায় আসে না। যেগুলো মিডিয়ায় আসে সেগুলোই আইন ও সালিশ কেন্দ্র কিংবা এ ধরনের কোন প্রতিষ্ঠান হিসাব করে রাখে। কুর্মিটোলা হাসপাতালের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হলেন সেটি আমাদের কাছে অভিনবই মনে হলো। আমরা অনেক প্রতিক্রিয়া দেখালাম কয়েকটি কারণে। রাস্তায় একজন ছাত্রী হেঁটে যাবে আর তাকে চেপে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন চলবেÑ ঢাকা শহর কি কোন সভ্যভব্যহীন এবং আইনকানুনহীন জঙ্গল নাকি? মানুষ প্রচ- ক্ষুব্ধ হয়। এ নিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে আন্দোলন শুরু হয়। র‌্যাবও অল্প সময়ের মধ্যেই ধর্ষককে আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছে। নিকট অতীতে ঢাকায় এ ধরনের ধর্ষণের ঘটনা ঘটার সংবাদ কাগজে পায়নি মানুষ। তাই ওই সংবাদে মানুষ বিমূঢ় হয়ে পড়ে। ধর্ষণ ঠেকানোর জন্য সমাজের নানা প্রান্ত থেকে নানা প্রস্তাব উঠে আসছে। বিশেষ করে মৃত্যুদ- দেয়ার কথাও উঠছে। সমাজে ধর্ষণের মতো পাশবিক ঘটনা অনেক বেশি বেড়ে যাওয়াতে এর একটা বিহিত করার ভাবনা উঠে আসছে নানা পক্ষ থেকে। কিন্তু উদ্যোগ নিতে হবে আইন প্রণেতা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকেই। আমরা বড়জোর তাদের সহৃদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি মাত্র। এই কলাম লেখার সময়ে ফোন এলো। করেছিলেন একজন শহীদজায়া। ডক্টরেট ডিগ্রীধারী এই ভদ্রমহিলা নিজেই গাড়ি চালিয়ে অফিস করেন। অত্যন্ত ক্ষুব্ধ তিনি। টিভিতে মুজিববর্ষ উপলক্ষে দুয়েকটি অনুষ্ঠান দেখেছেন। সেখানে বাঙালী সংস্কৃতির অভাব, রুচি ও শালীনতাবোধের অভাব এবং সর্বোপরি মানহীনতা তাকে ব্যথিত করেছে। তার সাফ কথা, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তৈরি কোন অনুষ্ঠানেই অরুচিকর, হাস্যকর ও বাঙালী সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্ক নেই- এমন কিছু দেখতে চাই না। মুজিববর্ষের ক্ষণগণনার সূচনা মুজিববর্ষের ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ১০ জানুয়ারি থেকে। ঢাকায় রীতিমতো উৎসবের ছটা। পথেঘাটে প্রতিষ্ঠিত তার উপকরণ। মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা কাজ করছে। তবে প্রথম দিনই আয়োজনে ত্রুটি বিচ্যুতি চোখে পড়েছে। এটি কাম্য ছিল না। আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক বলে পরিচিত একজনের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় মহতী আয়োজনের সূচনার দায়িত্বপ্রাপ্ত অথচ দায়িত্বজ্ঞানহীনদের কর্মকা-। তিনি যা লিখেছেন তার সঙ্গে যে বহু লোক একমত হবেন তা বিশ্বাস করি। কথাগুলো তুলে ধরা এ কারণে যে মুজিববর্ষ সবে শুরু হলো। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই মহাআয়োজন চলবে। তাই এখুনি সতর্ক ও শতভাগ আন্তরিক হওয়া চাই। কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন শামীম আহমেদ। তিনি লিখলেন: ‘আজকে টিভিতে একটা লেজার শো’র মতো অনুষ্ঠানের অংশবিশেষ ভিডিওর মাধ্যমে দেখলাম। বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন এমন একটি বিমানের দরজায় অত্যন্ত নিম্নমানের লেজার লাইটের প্রতিচ্ছবির মাধ্যমে তাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তারপর সেই লেজার লাইট খানিকটা দলা পাকিয়ে একটা লাল কার্পেটের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে, একদল মানুষ সেই সবুজ আলোর ওপর ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছে আর উল্লাস করছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম, আমার বিস্ময় কাটে না। বঙ্গবন্ধুর জীবন পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা রাজনীতিবিদের মর্যাদা পাবার যোগ্য। তার জীবনীর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ জীবনী আর কোন রাজনীতিবিদের আছে কিনা আমার জানা নেই। তার ৭ মার্চের ভাষণের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ কোন রাজনীতিবিদ আগে দিয়েছেন কিনা আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। এই মানুষটির জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন নয়, পালন করা দরকার ছিল। তার আদর্শকে বাস্তবায়ন করা, দেশের ধনী-দরিদ্রের মাঝে অসমতা কমিয়ে আনা, সমাজতন্ত্রের মূলমন্ত্র কায়েম, ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা- এগুলোতে গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়ারা প্রচুর মিথ্যা কথা ছড়িয়েছে। আমি নিজেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পেরেছি ২০১২ সালে তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি পড়ে। আজকে যারা বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন করছেন, তাদের ১০ শতাংশও বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়েননি, তার জীবনদর্শন অধ্যায়ন করেননি, কিন্তু হরিলুট ও সাধারণ মানুষের অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুকে প্রকৃতপক্ষে ভালবাসলে তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি বাংলাদেশের ৫ কোটি পরিবারের জন্য ৫ কোটি কপি ছাপিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে পাঠানো যেত। তার এই বইটি পৃথিবীর প্রচলিত সব ভাষায় অনুবাদ করে তাদের সবগুলো লাইব্রেরিতে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করা যেত। এই বই ১০ কোটি ছাপিয়ে ১০০০ কোটি টাকা খরচ করলেও সেটা হতো একটা মূল্যবান বিনিয়োগ। একটা প্রজন্ম বেড়ে ওঠার জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা পেত। এইসব অর্থহীন লেজার শো, কিংবা নিরন্তর লজ্জাকর ও নিম্নমানের হাজার হাজার কোটি টাকার হরিলুট ক্যাম্পেইনের চাইতে অনেক অনেক কার্যকরী হতো সে কাজটা- আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের মানুষদের বুদ্ধি-বিবেচনা এতটাই খারাপ পর্যায়ে চলে গেছে যে আমার মতো মানুষের আজকে সরকার, দলের হঠকারী কাজকর্মের মাধ্যমে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীকে খেলো করে তোলার ব্যাপারে উষ্মা প্রকাশ করতে হচ্ছে?’ আরেক কবির বিদায় প্রতি শীতই কি কেড়ে নেবে একজন করে কবি! বিদায় নিলেন এক কবি, যিনি এই ঢাকায় সুদীর্ঘকাল বসবাস করে পরে ফিরে গিয়েছিলেন জন্মভিটেয়। তিনি মুশাররফ করিম। বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। ষাটের দশকের আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের অন্যতম ছাত্রনেতা ও ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মুশাররাফ করিম কবি ও শিশুসাহিত্যিক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। ২০০৩ সালে তিনি শিশুসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘পাথরের পথে’, ‘অন্য এক আদিবাসে’, ‘সে নয় সুন্দরী শিরিন’, ‘কোথায় সেই দীর্ঘ দেবদারু’, ‘অন্তরের ব্যাকুল ব্যাধি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তিনি নেত্রকোনার দুর্গাপুরে বিরিশিরি কালচারাল একাডেমির পরিচালকও ছিলেন। কবিকে নিয়ে তারই সমসাময়িক লেখক আতা সরকার করেছেন মর্মস্পর্শী উচ্চারণ। লিখেছেন: ‘এক মুশাররাফ করিম। এক তিলোত্তমা কাল। উন্মাতাল কবিতার শহর। বুদ্ধিবৃত্তিক মননচর্চা সংস্কৃতির শহর ময়মনসিংহ। মহুয়া মলুয়া গান গীতিকার দেশ। এ শহরে আধুনিক কবিতার অভিঘাত সত্তরের দশকে। টগবগে তরুণ কবিদের অঘোষিত আড্ডা জমে ওঠে এক কবিতাপত্রকে কেন্দ্র করে। তিলোত্তমা। আর তার মধ্যমণি মুশাররাফ করিম । কবি নই। তারপরও কোন্ মোহ টানে প্রথম থেকেই জড়িয়ে যাই এর সাথে। প্রায় প্রতিটি সংখ্যায় লিখতে হয়েছে। প্রবন্ধ। নামে বেনামে কবিতাও। লিখতে বাধ্য করেছেন। এভাবে অনেক তরুণকেও। যতদিন ময়মনসিং ছিলাম মুশাররাফ করিমকে ঘিরে আমরা কজন একসাথে ছিলাম। এরপর সাংবাদিকতা। দৈনিক দেশ-এ আমরা সহকর্মী ছিলাম । আমি পেশা পরিবর্তন করি। মুশাররাফ করিম ফিরে যান নিজ শহরে। চিরচেনা ভালোবাসার ময়মনসিংহে। মুশাররাফ করিম কি প্রিয় শহর ছেড়ে যাচ্ছেন! না। তিনি ফিরে ফিরে আসবেন। তরুণদের কবিতাবেলায়। তিলোত্তমা কালে। ১২ জানুয়ারি ২০২০ [email protected]
×