ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষার্থীর মানবিক বিকাশে গণমাধ্যম

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ১৩ জানুয়ারি ২০২০

শিক্ষার্থীর মানবিক বিকাশে গণমাধ্যম

শুরুতেই উদ্ধৃত করতে চাই এদেশের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, প্রয়াত ইতিহাসবিদ সালাহউদ্দিন আহমদকে। তিনি বলেছেন, ‘এ যুগে মিডিয়া একইভাবে সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি জনমত গঠন করে যাচ্ছে। তবে এখন এর দায়িত্ব আরও অনেক বেশি। দায়িত্বহীন সংবাদ পরিবেশন থেকে মিডিয়াকে বিরত থাকতে হবে। এটা মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে আদায় করা ঠিক হবে না, মিডিয়াকেই বুঝতে হবে তার দায়িত্ব। মিডিয়ার এখন আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। অসঙ্কোচে সত্য প্রকাশ করতে হবে, করার সাহস রাখতে হবে।’ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের দেশে গণমাধ্যম খুবই শক্তিশালী ও পরিপূর্ণ স্বাধীন। এদেশে নানা সময়ে সামরিক শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। তখন সংবাদপত্রের গলা টিপে ধরার চেষ্টা করা হতো। সেদিক থেকে আমরা এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সময় পার করছি। ফলে এখন গণমাধ্যম নানা ইস্যুতে জনমত গঠন করছে, জনগণকে সচেতন করছে। এই যেমন যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে আমাদের মিডিয়ার একটি শক্তিশালী ভূমিকা রয়েছে। মিডিয়ায় যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধের ধরন-ধারণ ও ব্যাপকতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে বলে এখন সাধারণ মানুষও বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন।’ তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? দাঁড়াচ্ছে এই যে, সমাজে গণমাধ্যমের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আর এই সমাজের একটি বড় অংশ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এই শিক্ষার্থীদের হাত ধরেই এ দেশের ইতিহাস রচিত হয়েছে। সেই ১৯৪৮ সাল থেকে যদি ধরা হয়, তাহলে দেখা যাবে, স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা এবং তারপর স্বৈরাচার উৎখাত থেকে শুরু করে গণআদালত হয়ে জনতার মঞ্চ, এ দেশের ইতিবাচক সব আন্দোলন-সংগ্রামে সামনের সারিতে থেকেছে শিক্ষার্থীরা। আর বার বার শিক্ষার্থীদের সংগঠিত হতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে গণমাধ্যম। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণমাধ্যমকে ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ বলে মনে করা হয়। নানা সময়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনাও কম হয় না। গণমাধ্যম কি শুধু সংবাদ পরিবেশন করবে, নাকি জনমতও গঠন করবে এটা অনেকেই বুঝতে পারেন না। ফলে দেশ ও রাজনীতির স্বার্থে গণমাধ্যমের ভূমিকা পালন নিয়ে বিতর্ক সবসময়ই থাকে। গণমাধ্যম যে জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে, তা উপলব্ধি করেছিলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশিষ্ট সাংবাদিক আবেদ খান তাঁর এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এটা বিশ্বাস করতেন যে, সংবাদপত্রকে ঠিকমতো পরিচর্যা করলে তা এক বিশাল সংগঠকের ভূমিকা পালন করতে পারে। তুখোড় সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী শেখ মুজিব সেই যুব সমাজের অন্যতম নেতা হিসেবে সুস্পষ্টভাবে অনুভব করেছিলেন যে, রাজনৈতিক দর্শনকে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে হলে সংবাদমাধ্যমের কোন বিকল্প নেই।’ আমাদের দেশের মিডিয়া বা সংবাদপত্রগুলো পাশাপাশি দুটো ভূমিকা পালন করে এসেছে। একটি হলো সংবাদ পরিবেশন, দ্বিতীয়টি হলো জনমত গঠন। তার মানে, গণমাধ্যম একই সঙ্গে জনগণের মধ্যে চেতনা তৈরি করেছে এবং জনগণের ভাবনাগুলো তুলে ধরেছে। ঐতিহাসিকভাবেই আমাদের মিডিয়া এসব ভূমিকা পালন করে এসেছে। গণমাধ্যম সময়ের দর্পণ, সমাজের দর্পণ। দেশের সামগ্রিক শিক্ষা কাঠামো সমাজের মূল কাঠামোরই অংশ। সার্বিক বিচারে একটি সমাজ গঠনে শিক্ষা-সংস্কৃতির ভূমিকা অন্যতম। শিক্ষা-সংস্কৃতি মানুষের ব্যক্তিগত আচরণে প্রভাব ফেলে, প্রভাব ফেলে সামাজিক কর্মকান্ডে, যা মানুষের সামগ্রিক কর্মকান্ডে প্রতিফলিত হয়। মানুষের কর্মব্যস্ততা যতই বাড়ছে, গণমাধ্যমের ওপর নির্ভরতা ততই বাড়ছে। শিক্ষা মানুষের মনে জানার আগ্রহ বাড়ায়; গণমাধ্যম তথ্য সরবরাহ করে। আরও পরিষ্কার করে বললে, গণমাধ্যম তথ্য সরবরাহ বা খবর পরিবেশন করে মানুষের জানার আগ্রহকে কার্যকর করে। নিজের প্রয়োজনে মানুষ বিভিন্ন আদলের গণমাধ্যমে নজর দেয়। গণমাধ্যমের চোখে মানুষ সমাজকে দেখে, দেশকে দেখে, বিশ্বকে দেখে। এখন বিশ্বজুড়ে তা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। কারণ গণমাধ্যমের কাজ মানুষ নিয়ে, সমাজ নিয়ে, সমাজকে ঘিরে আবর্তিত শিক্ষা-সংস্কৃতি নিয়ে। এক কথায় জীবন এবং জগতের সবকিছুই গণমাধ্যম তথা সংবাদমাধ্যমের আলেখ্য। সত্য প্রকাশের অদম্য সাহসই গণমাধ্যমের অপ্রতিরোধ্য শক্তি, অনন্য বৈশিষ্ট্য। এই শক্তিই আমাদের আকৃষ্ট করে, প্রভাবিত করে। আদিকাল থেকেই মানুষ নিজের আগ্রহের বিষয়ে তথ্য জানতে চায়, বিভিন্ন খবর জানতে চায়। শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ আছে। কারণ শিক্ষা মানুষকে সমৃদ্ধ করে এবং এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়। গণমাধ্যম সমাজের অসঙ্গতি, বৈষম্য, অনিয়ম, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, অধিকার হরণ জনসমক্ষে তুলে ধরে ন্যায়ের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করে। কখনও কখনও সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে গণমাধ্যমকে সমাজের শক্তিধর কায়েমি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর নজরে পড়তে হয়; সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য গণমাধ্যমকে লড়াই করতে হয়। গণমাধ্যম জনগণের মাধ্যম। গণমাধ্যমকে নিজ বৈশিষ্ট্য মেনে কাজ করতে দেয়াই পরিচালনাকারীদের অন্যতম দায়িত্ব। গণমাধ্যম নিজ বৈশিষ্ট্য হারালে গণমানুষের গ্রহণযোগ্যতাও হারায়। গণমাধ্যমের কাজ শুধু সংবাদ পরিবেশনই নয়, তার চেয়েও বেশি। মানুষ গণমাধ্যমের কাছেই পেতে চায় সংবাদের বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ এবং নির্দেশনা। যথাযথ বিশ্লেষণই বলে দেয় বিষয়ের গতিপ্রকৃতি এবং ভবিষ্যত। এখন নানাবিধ কারণে গণমাধ্যমের ওপর সমাজের নির্ভরতা অনেক বেশি। সুতরাং এখন গণমাধ্যমের প্রভাবও বেশি। এ প্রভাবটাই গণমাধ্যমের মূল শক্তি, সমাজ বদলের হাতিয়ার। সংবাদমাধ্যম সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের বার্তাবাহক। সংবাদপত্র দৈনন্দিন জীবনের তৃতীয় নয়ন। এর মাধ্যমে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে সমগ্র পৃথিবী। সংবাদপত্রের প্রধান কাজ সমাজ জীবনের নানা ত্রুটিবিচ্যুতি পর্যালোচনা করে পথনির্দেশ করা। এ জন্য সংবাদপত্রকে ফোর্থ স্টেট বা চতুর্থ রাষ্ট্র বলা হয়। আসলে সংবাদপত্র হচ্ছে গণতন্ত্রের চোখ। এ চোখ দিয়েই সরকার সমাজের অনেক ভেতর পর্যন্ত দেখতে পায়। সংবাদপত্রের সাহায্যে চলমান পৃথিবীর বিচিত্র ঘটনার সঙ্গে আমরা সহজে পরিচিত হতে পারি। রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সাহিত্য ও যুদ্ধবিগ্রহ সবকিছুই সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পারি। বিদ্রোহ-বিপ্লব, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং দেশের অজস্র চিত্র পাওয়া যায় সংবাদপত্রে। দেশে কোন মন্ত্রিসভা শপথ নিল, কে রাষ্ট্রপ্রধান হলেন, কোন বিশিষ্ট লোক মারা গেল অথবা বিজ্ঞানের কী নতুন আবিষ্কার হলো, কে রাতারাতি বিখ্যাত হলেন, কে দুর্গমপথে পা বাড়াল, কোন্ পুরনো বন্ধুর সন্ধান পাওয়া গেলÑ এসব সংবাদপত্র আমাদের যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এ ছাড়া খেলাধুলা, আইন, আদালত, ব্যবসায়-বাণিজ্য, খুন-জখম, দুর্ঘটনা, চুরি-ডাকাতি, আমোদ-প্রমোদ, ধর্মকর্ম ইত্যাদি হাজারও সংবাদ থাকে সংবাদপত্রে। আজকাল শিক্ষার্থীরা নাকি পত্রিকা খুব একটা পড়েন না। যতটা না গণমাধ্যম, তার চেয়েও অনেক গুণ বেশি তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মনোযোগী। ব্যাপারটা কি তাই? কেউ কেউ বলে থাকেন ব্যাপারটা আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে। সংবাদপত্র ছাড়া জ্ঞান আসবে কোত্থেকে? সংবাদপত্রকে বলা হয় চলমান ইতিহাস। চলন্ত ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে আমাদের প্রস্তুত হতে হবে সুন্দর আগামীর জন্য। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের সংবাদপত্র পড়ার যোগ্যতা অর্জন করাকে একটি প্রান্তিক যোগ্যতা হিসেবে সংযোজন করা উচিত। এখানে হয়ত প্রশ্ন আসতে পারে, গণমাধ্যমের কাজ কী? প-িতরা বলেন, গণমাধ্যমের কাজ খুব বেশি নয় : ১. মানুষকে জানানো ২. এই জানানোর মধ্য দিয়েই মানুষকে শিক্ষিত করে তোলা ৩. মানুষকে বিনোদন দেয়া। এই তিনের মধ্যেই বিতর্কের অবস্থানটি লুকায়িত থাকলেও যখন এই তিনের সঙ্গে পন্ডিতরা আরেকটি সংযোজন করলেন তখন তা প্রকাশ্য রূপ পায়। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে গণমাধ্যমের তিনটি কাজের সঙ্গে যুক্ত করে বলা হলো : জনমানসকে উজ্জীবিত করতে কখনও কখনও কোন কোন কাজে জনগণকে সক্রিয় করে তোলাটাও গণমাধ্যমের দায়িত্ব। দায়িত্বশীলতা ও চ্যালেঞ্জ সাংবাদিকতায় হাত ধরাধরি করে চলে। সাংবাদিকতায় দায়িত্বশীলতার পোশাকী পরিচয় হচ্ছে ‘পেশাদারিত্ব’। এই পেশাদারিত্ব কিভাবে স্পষ্ট হয়, তা সাংবাদিকতায় পড়ানো হয়। অভিজ্ঞ ও সফল পেশাদার সাংবাদিকরা বলেন, ‘সাংবাদিকরা কারও পক্ষে বলে না, কারও বিপক্ষেও নয়, বলে কেবল সত্যটা।’ এই সত্যই কখনও কারও পক্ষে যায়, কখনও কারও বিপক্ষে। এই ‘সত্য’ কিভাবে নিরুপিত হয়, সেটি ভিন্ন আলোচনার বিষয়। সাংবাদিকতায় এই সত্য নিরূপণের মাত্রাগুলো পড়ানো হয়। মিডিয়ার কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। কেউ চান বস্তুনিষ্ঠতা, কেউ বিশেষ সঙ্কটে গণমাধ্যমের সহযোগিতা জরুরী বলে মনে করেন। কেউ এইডস সচেতনতায় গণমাধ্যমের আরও সক্রিয় ভূমিকা কামনা করেন। মানবাধিকার, নারী অধিকার, শিশু অধিকার বাস্তবায়নে মিডিয়ার সহযোগিতা অপরিহার্য বলে বিভিন্ন সেমিনারে বক্তারা নিয়মিত বক্তব্য দেন। তাদের এ প্রত্যাশা মিডিয়া পূরণ করার চেষ্টা করলেও সফল হয় না বেশিরভাগ সময়ে। কারণ মৌলিক পরিবর্তনে মিডিয়া এককভাবে কোন জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে না। সেটা না হলে সমস্যা থেকেই যাবে। মানুষের প্রত্যাশা অব্যাহত থাকবে। ব্যাপক পরিবর্তন বা মৌলিক পরিবর্তনে মিডিয়া রাজনৈতিক আন্দোলনে সহযোগী হতে পারে। সে ভূমিকা আমাদের মিডিয়া ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে, ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে, স্বাধীনতা-উত্তর দেশ গঠনে, আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সাহসের সঙ্গে পালন করেছে। এর পেছনে সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ বড় রকমের শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। শেষ কথা হচ্ছে, মিডিয়াকে শিক্ষার্থীরা কিভাবে গ্রহণ করবে? মিডিয়ার কতটুকু তাদের স্পর্শ করতে পারবে। নিজেদের গড়ে তুলতে মিডিয়াকে কতটুকু নিতে পারবে শিক্ষার্থীরা? আলোচকরাই তুলে আনুন এসব প্রশ্নের জবাব। আজকের মিডিয়া শিক্ষার্থীদের কতটুকু উজ্জীবিত করতে পারছে, সেটাও তো বিবেচনার বিষয়। বর্তমান কাল অথ্যশাসিত, তথ্যপ্লাবিত। তথ্যের প্রবাহে ভেসে যাচ্ছে সব। অতিরিক্ত তথ্যের ভিড়ে তৈরি হতে পারে ‘তথ্যদূষণ’। মুক্তধারার ধনঞ্জয় বলেছিলেন, ‘জগৎটা বাণীময়’। সেই বাণীর জন্য কান পেতে রাখাটাই যথেষ্ট নয়, নিজস্ব বিচারবোধের সজীবতাটাও জরুরী। মনে রাখতে হবে, ‘তথ্য মানুষের সম্বল, কিন্তু সত্য তার ঐশ্বর্য।’ যথেষ্ট বিশ্বাস রেখেই বলি, নতুন যৌবনের শিক্ষার্থী বিচারবোধের সজীবতা দিয়ে ঠিকই বেছে নেবে সম্বল এবং ঐশ্বর্যকে। লেখক : আহ্বায়ক, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
×