ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থনীতিতে নোবেল ॥ ২০১৯

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ১৩ জানুয়ারি ২০২০

অর্থনীতিতে নোবেল ॥ ২০১৯

২০১৯ এ অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী হয়েছেন ৩ জন, যথাক্রমে অভিজিৎ ব্যানার্জী, ইসথার ডুফলো ও মাইকেল ক্রেমার। তাদের মধ্যে ব্যানার্জী ও ডুফলো বস্টনস্থ ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) এবং ক্রেমার হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। এই পুরস্কার দেয়ার কারণ হিসাবে রাজকীয় সুইডিস বিজ্ঞান একাডেমি উল্লেখ করেন, যে বিশ্বের দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে এই তিন অর্থনীতিবিদ তাদের পরীক্ষামূলক ক্ষৈত্রিক বিশ্লেষণ দিয়ে সহায়তা করেছেন। একাডেমির ভাষ্য অনুযায়ী এই তিন অর্থনীতিবিদদের পরীক্ষামূলক গবেষণা প্রণালী সমকালে উন্নয়ন অর্থনীতির সর্বাংশের আধিপত্যে বৈশিষ্ট্যমান। অভিজিৎ ব্যানার্জীর জন্ম ভারতের মুম্বাইয়ে ১৯৬১ এর ২১ ফেব্রুয়ারি। পড়াশোনার শুরু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসসি), মাঠ পর্যায়ের সাধনা দিল্লীর জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (এমএ) এবং পরিণত পর্যায়ে সমাপ্তি বস্টনস্থ ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (পিএইচডি)। তিনি এখন এমআইটিতে অর্থনীতির (ফোর্ড ফাউন্ডেশন) আন্তর্জাতিক অধ্যাপক। এর আগে তিনি হার্ভাড ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। এসথার ডুফলোর জন্ম প্যারিসে ১৯৭২ এর ২৫ অক্টোবর। প্যারিসের সামাজিক বিজ্ঞানের উচ্চ শিক্ষার স্কুলে পড়াশোনার পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পড়াশোনা শেষে সেখান থেকে ব্যানার্জীর তত্ত্বাবধানে ১৯৯৯ এ পিএইচডি লাভ করেন। এরপর থেকে তিনি এমআইটিতে অধ্যাপনা করে আসছেন। তিনি এখন সেখানে দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক। ব্যানার্জী ও ডুফলো ২০১৫ থেকে স্বামী-স্ত্রী এবং সহগবেষক। ব্যানার্জী এর বহু প্রকাশনার মধ্যে ২০০৫ প্রকাশিত Making Aid Work (২০১১) বেশ নাম করেছে। ব্যানার্জী ও ডুফলোর Poor Economics : A Radical Way to Fight Global Poverty এবং Good Economics For Hard Times (২০১৯) ভিন্নতর প্রেক্ষিতে অর্থনীতির সমীক্ষণ হিসেবে বিজ্ঞজনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মাইকেল ক্রেমারের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬৪ সালের ১২ নবেম্বর। পড়াশোনা আগাগোড়া হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএ, এমএ, পিএইচডি)। তিনি এখন হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নশীল সমাজের গেটস অধ্যাপক। এর আগে তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় ও এমআইটির অধ্যাপক ছিলেন। ব্যানার্জী, ডুফলো ও ক্রেমার উন্নয়ন অর্থনীতির প্রয়োগিক সফলতা বিশ্লেষণ করেছেন জনগণের আচার-ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে। তাদের এই বিশ্লেষণের প্রক্রিয়া হলো দৈবচয়নিক নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা (Randomised Controlled Trial) । উন্নয়ন অর্থনীতির প্রথাগত তত্ত্ব ও বিধানপত্রে সাধারণভাবে দারিদ্র্য বিমোচনীয় প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হিসেবে সঞ্চয়, বিনিয়োগ, প্রযুক্তিক উপকরণ আহরণ ও প্রয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, উদ্যোগী শ্রেণীর অনুকূলে বিনিয়োগীয় সম্পদ সঞ্চালন এবং এই সকল কাজের সঙ্গে দরিদ্রদের ওপরে ওঠার সিঁড়ি খুলে দেয়া এবং একই সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে হতদরিদ্রদিগকে ত্রাণমূলক সহায়তা প্রদান স্থান পেয়েছে। (দ্রষ্টব্য, উদাহরণত এভারেট হেগেন, উন্নয়ন অর্থনীতি ১৯৮৬)। প্রথাগত এই উন্নয়ন তত্ত্বের মৌল অনুকল্প হলো- যথাযথ সুযোগ ও সহায়তা পেলে সকল ব্যক্তি যৌক্তিক মানুষ হিসেবে তার অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনে সর্বাত্মক মাত্রায় প্রবৃত্ত হবেন এবং ফলত সর্বজনীন প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। উন্নয়ন অর্থনীতির মৌল উপকরণসমূহের কার্যকারিতা অনুকল্পনের ভিত্তিতে বিভিন্ন দরিদ্র দেশে ক্ষৈত্রিক পর্যায়ে দৈবচয়নিক নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা সম্পন্ন করে ব্যানার্জী, ডুফলো ও ক্রেমার তাদের বিভিন্ন বই ও প্রতিবেদনে বলতে চেয়েছেন যে, সকল ক্ষেত্রে ও সময়ে উন্নয়নের সারথী বা কর্মীরা যৌক্তিক মানুষ হিসেবে তাদের আচরণ-ব্যবহার প্রয়োগ করেন না। ফলত উন্নয়ন অর্থনীতির মৌল বিধানপত্রে জনগণের ব্যবহারিক প্রতিক্রিয়া অনুধাবন এবং তার আলোকে উন্নয়ন ও সহায়ক কার্যক্রম পরিশীলিত করা ইপ্সিত। প্রায় ২ যুগ ধরে পৃথিবীর সব এলাকায় জনগণের জীবনের মান দর্শনীয় মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। ১৯৯৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে মাথাপিছু মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি দরিদ্রতম দেশসমূহে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। এতদ্বসত্ত্বেও ব্যানার্জী, ডুফলো ও ক্রেমারের মতে কতিপয় বিরাট চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে বিদ্যমান। প্রায় ৭০ কোটি জনগণ এখনও অত্যন্ত নিম্ন আয় নিয়ে বেঁচে আছে। প্রতি বছর পৃথিবীব্যাপী প্রায় ৫ মিলিয়ন শিশু তাদের বয়স ৫ম বছর না হতেই মারা যাচ্ছে। তাদের এই অকাল মৃত্যু সহজে এবং অল্প ব্যয়ে নিবৃত্ত কিংবা উপশমায়িত করা যায়। এখনও পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক সংখ্যক শিশু মৌলিক অক্ষর জ্ঞান ও হিসাব-দক্ষতা না পেয়েই স্কুল ত্যাগ করে। এই তিন নোবেল বিজয়ীর ক্ষৈত্রিক পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, প্রাথমিক শিক্ষার পর্যায়ে অধুনা অনুসৃত অধিক সংখ্যক পাঠ্যপুস্তক ও বিনামূল্যে দুপুরের খাবার সরবরাহ করার কার্যক্রমের চেয়ে অধিক সংখ্যক যোগ্য শিক্ষকদের দিয়ে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের দিকে মনোযোগ দেয়া উন্নততর শিক্ষাভিত্তিক ফল বা ফিরতি দেয়। এর ভিত্তিতে তারা বলতে চেয়েছেন যে, স্কুলের প্রশাসন এবং শিক্ষকদের দায়িত্বশীল আচরণ সাধারণভাবে স্কুলের অবকাঠামো উন্নয়নের চেয়ে অধিকতর ফলদায়ক। অবশ্য তারা বলতে পারেননি যে, স্কুলের অবকাঠামো সৃষ্টি না করে স্কুলের প্রশাসন ও শিক্ষকদের দায়িত্বশীল আচরণ কিভাবে নিশ্চিত করা যায়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে অনুরূপভাবে সেবার নিম্নমান দরিদ্র পরিবারদিগকে প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমে তাদের তরফ থেকে বিনিয়োগ বাড়াতে উৎসাহিত করে না। এই গবেষক ত্রয়ী বলেছেন এক্ষেত্রে দরিদ্র পরিবারসমূহ সম্পূর্ণ মাত্রায় যৌক্তিক আচরণ করে না বলে তা ঘটে যাচ্ছে । অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে, বিদ্যমান স্বাস্থ্য সেবা উচ্চমান অর্জন করতে না পারায় তা পরিত্যাজ্য। তারা দেখিয়েছেন যে, সাহারা মরুর প্রান্ত সীমায় দরিদ্র চাষীরা পূর্ণমাত্রায় ভর্তুকি প্রদত্ত রাসায়নিক সার আশানুরূপ মাত্রায় ব্যবহার করেন না এ জন্য যে তারা এই সহায়তার সুফলের উপযোগ ফসল ওঠানোর সময় পর্যন্ত অপেক্ষা না করে তাৎক্ষণিকভাবে সহায়তা লাভে উদগ্রীব। এ জন্য তাদের অনুকূলে তাৎক্ষণিক নগদ সহায়তা অধিকতর কার্যকর বলে এই গবেষক ত্রয়ীর ধারণা। এর অর্থ এই নয় যে, এই প্রেক্ষিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার পরিত্যাজ্য। ক্ষুদ্র ঋণের ক্ষেত্রে এদের গবেষণা লব্ধ ফল হলো যে, এরূপ ঋণ ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রসারণে তেমন ফলদায়ক নয়। অধিকিন্তু সামাজিক ভরণ-পোষণের ওপর এর তেমন কোন ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া নেই। তাদের মতে, ক্ষুদ্র ঋণের সফলতার সামনে এখন মাঝারি উদ্যমের অনুকূলে প্রথাগত ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে উৎপাদনশীল ঋণ প্রসারিত করা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের এসব তথ্য তারা ভারত, বসনিয়া-হারজেগভিনা, ইথিওপিয়া, মরক্কো, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া ও মেক্সিকেতে দৈবচয়নিক নিয়ন্ত্রিত ক্ষৈত্রিক জরিপে পেয়েছেন বলে প্রকাশ করেছেন। এসব ফল ও প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে তারা বলেছেন যে, প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত ও সফল করতে হলে প্রয়োজন প্রবৃদ্ধির প্রত্যক্ষ উপকরণের যথার্থ ব্যবহার ও ফলদায়কতা অর্জন এবং তা নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন সম্পূরক সামাজিক নীতি ও কার্যক্রম। তাদের মতে এ ধরনের সামাজিক নীতির অবর্তমানে অর্থনীতি হবে ও থাকবে দরিদ্র। কেবলমাত্র উন্নয়নের বিশ্লেষণ ও বিধানপত্র অনুসরণ করে তা প্রবৃদ্ধি অর্জনের সক্ষমতা পাবে না। গত ২ যুগ ধরে এই তিন নোবেল বিজয়ীর গবেষণার উপরোক্ত ফল-ফলাদি ও অভিমত দরিদ্র দেশসমূহের উন্নয়ন ও ত্রাণের ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণে প্রান্তিক ভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে বলা চলে। কিন্তু তাদের এই ধরনের গবেষণা লব্ধ ফল উন্নয়ন অর্থনীতির মৌলতত্ত্বকে কোন ক্রমেই বিকল্পায়িত করছে বা করতে পারে বলা চলে না। তাদের দৈবচয়নিক নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষার ফলফলাদি ইতোমধ্যে মূল অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ দারিদ্র্য বিমোচনমূলক কার্যক্রমে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ সর্বক্ষেত্রে প্রসারণের জন্য যে বিধান দিয়েছে, তা শাণিত করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা, গৃহায়ন ও ক্ষুদ্র ঋণের ক্ষেত্রে যেসব কার্যক্রম ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে, তা সংশোধনের বাহানায় বিকল্পায়িত করতে পারে না। এই তিন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ তাদের বিশ্লেষণ প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে প্রবৃদ্ধি বিস্তৃত, দ্রুততর ও নিবিড়তর করার লক্ষ্যে ৫টি করণীয়র প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে (২০১৯ পর্যন্ত) তাদের উন্নয়নের বিধানপত্র ও মতাদর্শ তুলে ধরেছেন। এই ৫টি করণীয় ব্যানার্জী ও ডুফলো তাদের সবচেয়ে নামকরা বই ‘দরিদ্র অর্থনীতি’তে (Poor Economics) তুলে ধরেছেন। এক, দরিদ্রদের উন্নয়নের লক্ষ্যে উন্নয়নের সুফল ও সম্ভাবনা বিষয়ে অধিকতর তথ্য আহরণ ও বিচ্ছুরণ করতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, প্রযুক্তির লভ্যতা ইত্যাদি বিষয়ে যথার্থ তথ্যের আহরণ ও লভ্যতা দ্রুততর ও সফলতার প্রবৃদ্ধিমূলক পদক্ষেপ নিতে আমাদের সন্দিপীত করবে। দুই, দরিদ্রদের জীবনের সর্ব দিকের দায়িত্ব থেকে সামাজিক বা প্রতিষ্ঠানগতভাবে মুক্ত রেখে যথার্থ প্রবৃদ্ধির অনুকূলে তাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ও পরিধি সৃষ্টি করতে হবে। তিন, বিনিময়, লাভ ও আয় অর্জনের লক্ষ্যে দরিদ্রদের জন্য উৎপাদন ও বিপণনের বাজার উন্মুক্ত রাখতে হবে। চার, প্রবৃদ্ধির অনুকূলে সংস্কৃতি ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। পাঁচ, দরিদ্রদের অর্জনের (মানসিক) প্রত্যাশা প্রসারিত করতে হবে। (দ্রষ্টব্য, অভিজিৎ ব্যানার্জী ও ইসথার ডুফলো, দরিদ্র অর্থনীতি, ১০ পরিচ্ছেদ)। গত শতাব্দীতে অর্থনীতির বিস্তৃত বিশ্লেষণ ও নিরবচ্ছিন্ন চর্চার আলোকে বলা চলে যে, উপরোক্ত ৫টি করণীয় অর্থনীতির প্রত্যক্ষ বিষয় পরিধিবহিভূর্ত। উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষণ ও বিধানপত্রে সমাজ চর্চার উপকরণ হিসাবে তাদের দৈবচয়নিক নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষায় প্রাপ্ত উপাত্তাদি প্রাসঙ্গিক। অন্য কথায়, এসব উপাত্তাদি অর্থনীতির মূল বিশ্লেষণ ও চর্চার মৌলিক কিংবা গুরুত্বপূর্ণ সহগ বা উপকরণ নয়। এই প্রেক্ষিতে বলা হয়ত অযৌক্তিক হবে না যে, ২০১৯ সালে রাজকীয় সুইডিস বিজ্ঞান একাডেমি অভিজিৎ ব্যানার্জী, এসথার ডুফলো ও মাইকেল ক্রেমারের বাইরেও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ কিংবা দিশারী অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া বিবেচনা করতে পারতেন। লেখক : সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী
×