ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বোরহান বিশ্বাস

বঙ্গবন্ধুর সেই উক্তি ‘আমি বাঙালী, আমি মুসলমান’

প্রকাশিত: ০৮:২৭, ১৩ জানুয়ারি ২০২০

 বঙ্গবন্ধুর সেই উক্তি ‘আমি বাঙালী, আমি মুসলমান’

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলেও বঙ্গবন্ধু তখনও বন্দী ছিলেন পাকিস্তান কারাগারে। দেশ-বিদেশে চলছিল বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম। তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ৩০ লাখ মানুষের আত্মাহুতি ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর বেদনার ইতিহাস- সবকিছুই ছিল অসম্পূর্ণ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদাররা বাঙালীর এই অবিসংবাদিত নেতাকে তাঁর ধানমন্ডির বাসা থেকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী করে রাখে। বাঙালী যখন স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করছে, বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে প্রহসনের বিচারে ফাঁসির আসামি হিসেবে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। আন্তর্জাতিক চাপে পরাজিত পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বন্দীদশা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৯০ দিন পাকিস্তানের কারাগারে কাটানোর পর লন্ডন-দিল্লী হয়ে তিনি ঢাকায় পৌঁছান ১০ জানুয়ারি। সেদিন বাংলাদেশে ছিল উৎসবের আমেজ। পূর্ণতা পেয়েছিল অর্জিত স্বাধীনতা আর বিজয়। বঙ্গবন্ধুর জন্য গোটা বাঙালী জাতির সে কি রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা! বিমানবন্দর থেকে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পর্যন্ত রাস্তা ছিল লোকে লোকারণ্য। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের গণহত্যার কথা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। তেজগাঁও বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করার পর খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে জনসমুদ্রের ভেতর দিয়ে রেসকোর্স ময়দানে এসে পৌঁছাতে আড়াই ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এই ময়দানেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বজ্রকণ্ঠে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেটি ছিল ১৮ মিনিটের। আর ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে তিনি প্রায় ১৭ মিনিট জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা করেন। যাদের ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সেদিন বঙ্গবন্ধু ভাষণের শুরুতে বলেছিলেন, ‘স্মরণ করি আমার বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, সিপাই, পুলিশ, জনগণ, হিন্দু, মুসলমান যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আপনাদের কাছে দুই একটা কথা বলতে চাই।’ আবেগের আতিশয্যে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শিশুর মতো কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী করে মানুষ করোনি। কবিগুরুর কথা মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে, আমার বাঙালী আজ মানুষ।’ ভাষণের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আমার সেলের পাশে কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমি বাঙালী, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, মুসলমান একবার মরে দুইবার মরে না।’ কত বড় দার্শনিকের কথা! ‘বাঙালী’ এবং ‘মুসলমান’। বাঙালী হয়ে আমরা সবাই বাংলা নববর্ষ ‘পহেলা বৈশাখ’ উদযাপন করি। বৈশাখী মেলায় যাই। এই সংস্কৃতি বাঙালীর চিরায়ত ঐতিহ্যেরই অংশ। আবার ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গা থেকে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান হিসেবে আমরা ঈদ, পূজা, পূর্ণিমা কিংবা বড়দিন উদযাপন করে থাকি। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থেকে মুসলমান হয়েও বাঙালী হিসেবে আমরা মন্দিরে যাই। বন্ধু হিসেবে তাদের আতিথেয়তা গ্রহণ করি। তাইতো বলা হয়ে থাকে ধর্ম যার যার উৎসব সবার। কখনও কখনও ঈদ, পূজায় আমরা হয়তো ভাগ হয়ে যাই। যার যার মতো করে উৎসব পালন করি। কিন্তু বৈশাখের প্রথম দিন, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে সবাই এক হয়ে যাই। কারণ ওই দিনগুলোতে আমরা হিন্দু-মুসলিম থাকি না, বাঙালী হয়ে যাই; দেশটা হয়ে যায় সবার। ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান, মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম/আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম...।’ এর চেয়ে সুন্দর কথা কি হতে পারে! হিন্দু অধ্যুষিত বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে ফেরার পথে দিল্লীর প্যারেড গ্রাউন্ডের জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর সংক্ষিপ্ত ও মর্মস্পর্শী ভাষণের এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘আমাকে প্রশ্ন করা হয় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আপনার আদর্শের এত মিল কেন? আমি বলি- এটা আদর্শের মিল, নীতির মিল, এটা মনুষ্যত্বের মিল, এটা বিশ্বশান্তির জন্য মিল।’ বংশপরম্পরায় বাগদাদের দরবেশ বংশের উত্তরাধিকার ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর বাবা-মা ছিলেন ধার্মিক মানুষ। মানুষের নিজ নিজ ধর্মের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার উৎস ছিল রাসুল (সা.)-এর মদিনা সনদের শিক্ষার অনুসরণে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বেতার ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে, আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই। এ কথার জবাবে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য, আমরা লেবাসসর্বস্ব ইসলামে বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হজরত রাসুলে করিম (সা.)-এর ইসলাম। যে ইসলাম জগদ্বাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে বারবার যারা অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ, বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করছে, আমাদের সংগ্রাম সেই মুনাফিকদের বিরুদ্ধে। যে দেশের শতকরা ৯৫ জন মুসলমান, সে দেশে ইসলামবিরোধী আইন পাসের ভাবনা ভাবতে পারে তারাই, ইসলামকে যারা ব্যবহার করে দুনিয়াকে শায়েস্তা করার জন্য।’ ১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অধ্যাদেশ জারি করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। মেশকাত শরিফের অনুবাদক হিসেবে সুপরিচিত মাওলানা ফজলুল করিমকে সেই ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক নিয়োগ করেন। ‘বায়তুল মোকাররম সোসাইটি’ এবং ‘ইসলামিক একাডেমি’ নামে তৎকালীন দুটি সংস্থার বিলোপ সাধন করে এই ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধু মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডকে পুনর্গঠন করেন। জুয়া, হাউজি, মদসহ অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে শাস্তির বিধান করেন। কাকরাইল মসজিদের সম্প্রসারণ করে রমনা পার্কের অনেকখানি জায়গা নেয়ার প্রয়োজন দেখা দিলে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু নির্দ্বিধায় সরকারের পক্ষ থেকে জমি দেয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেন। বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে ‘বাঙালী’ ও ‘মুসলমান’ বিষয়ে যে জ্ঞানগর্ভ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন আজ সময় এসেছে তা নিয়ে গবেষণার। বিষয় দুটির ওপর আলোকপাত করে তার যথার্থ ও সুষ্ঠু প্রয়োগ করা গেলেই রাতারাতি পাল্টে যেতে পারে আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা। প্রকৃত বাঙালী ও মুসলমানের দ্বারা কখনই অন্যায় ও নীতিহীন কাজ সম্ভব নয়। লেখক : সাংবাদিক
×