ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রফেসর ড. কামাল উদ্দিন আহাম্মদ

বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফিরে না এলে-

প্রকাশিত: ০৮:৫২, ১২ জানুয়ারি ২০২০

বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফিরে না এলে-

বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি এক ঐতিহাসিক দিন। ৪৮ বছর পূর্বে এ দিনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন বিজয়ীর বেশে। এ বীরের প্রত্যাবর্তনের ফলেই আমার মতো কোটি কোটি মানুষের লালিত সত্যিকারের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় পূর্ণতা পায়। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু তাঁর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আসলে এ বিজয় ছিল বাংলার জনগণের। বাঙালী জাতিই সংগ্রাম করে, রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে জয়যুক্ত করেছে। ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে তাকে ফিরিয়ে এনেছে। তাঁর মুক্তির জন্য এদেশের অগণিত মানুষ রোজা রেখেছে, নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেছে, মসজিদে-মন্দিরেও বিশেষ দোয়া করা হতো। কিন্তু কেন? এর একটাই কারণ। বাঙালী জাতির আত্মার অমোঘ বাণীকে নিজের কণ্ঠে তুলে নিয়েই তিনি বাঙালীর হৃদয় জয় করেছিলেন। পরিণত হয়েছিলেন বাঙালীর বিবেকের প্রতীকে। তাঁর ৭ মার্চ ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাকে প্রকারান্তরে স্বাধীনতার ঘোষণার কারণে ৩০ লাখ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মদান ও মিত্র বাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশ হয় স্বাধীন। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে আমরা গভীর আগ্রহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে সকল দেশবাসী সব কিছু অবলোকন করছিলাম। ঢাকা শহর সেদিন লোকে লোকারন্য। কণ্ঠে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’ অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ। ওই দিন দুপুর ২টায় দিল্লী থেকে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান বাংলার মাটি স্পর্শ করলে সৃষ্টি হয় এক আবেগঘন মুহূর্ত। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে জড়িয়ে ধরে আবেগময় চেহারায় জাতির প্রতি, জনগনের প্রতি অভিব্যক্তি প্রকাশ করছিলেন। প্রত্যাবর্তনের পরে আবেগ মথিত কন্ঠে বলেছিলেন, ‘হে কবিগুরু আপনি এসে দেখে যান, আমার ৭ কোটি বাঙালী আজ মানুষ হয়েছে।’ এত আবেগ ও এত আবেগময় দৃশ্য আর কোন নেতার কাছ থেকেই আমরা অবলোকন করিনি। আনন্দ আর বিষাদের অশ্রু দিয়ে মুক্তি পাগল বাংলার জনগন তাঁকে সেদিন বরণ করে নেয়। বিমানবন্দরে নেমেই তিনি ৯ মাসে বাংলার জনগণের দুঃখ-কষ্ট, নির্যাতন-নিপীড়নের যে ভয়াবহ কাহিনী শুনতে পান, তারপর থেকেই তিনি ছিলেন অসহ্য আবেগে-আপুøত। অতঃপর শুরু হয় রমনা রেসকোর্স মাঠের সংবর্ধনা সভার উদ্দেশে যাত্রা। চতুর্দিক থেকে জনতার বাঁধভাঙ্গা ঢল নামে। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতৃবৃন্দ একটি খোলা ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে জনতার অভিবাদন ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করছেন আর ধীরগতিতে তাঁকে বহনকারী ট্রাকটি সভাস্থলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে জনতার ঢল ট্রাকের পেছনে পেছনে চলতে থাকে। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে এসে পৌঁছাতে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। সে দিন সোহ্্রাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলার জনগণের উদ্দেশে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তার থেকে আবেগঘন বক্তৃতা আর কখনও দিয়েছেন বলে মনে হয় না। সেদিন বিকেল ৫টায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, ‘নেতা হিসেবে নয়, ভাই হিসেবে আমি আমার দেশবাসীকে বলছি, আমাদের সাধারণ মানুষ যদি আশ্রয় না পায়, খাবার না পায়, যুবকরা যদি চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে আমাদের এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে, পূর্ণ হবে না। আমাদের এখন তাই অনেক কাজ করতে হবে। আমাদের রাস্তাঘাট ভেঙ্গে গেছে, সেগুলো মেরামত করতে হবে। অনেকেই আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে। আমি তাদের জানি। আপনারা আরও জানেন যে, আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। আমার সেলের পাশেই কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি মুসলমান। আমি জানি, মুসলমান মাত্র একবারই মরে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের কাছে নতি স্বীকার করব না। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালী, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা।’ বক্তৃতাদানকালে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ বার বার বাকরুদ্ধ হয়ে আসছিল। রুমাল দিয়ে তিনি চোখ মুছে নিচ্ছিলেন। জাতির পিতার রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১৭ মিনিট জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। যা ছিল জাতির জন্য দিকনির্দেশনা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণও ছিল ১৮ মিনিট সময়ের, শব্দ ১১০৫ (এক হাজার একশত পাঁচ)। বাংলাদেশের আদর্শগত ভিত্তি কী হবে, রাষ্ট্র কাঠামো কী ধরনের হবে, পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে যারা দালালি ও সহযোগিতা করেছে তাদের কী হবে, বাংলাদেশকে বহির্বিশ্ব স্বীকৃতি দেয়ার জন্য অনুরোধ, মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ, কৃষক, শ্রমিকদের কাজ কী হবে, এসব বিষয়সহ বিভিন্ন দিক নিয়ে যে নিদের্শনামূলক ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই ভাষণকে একজন প্রাজ্ঞ রাষ্ট্রনায়কের নীতিনির্ধারণী ভাষণ বলে উল্লেখ করা যায়। তিনি ডাক দিলেন দেশ গড়ার সংগ্রামে। রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনতা দু’হাত তুলে সেই সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন। একজন নেতা একটি জাতির কাছে কত কাছের মানুষ, কত প্রাণের মানুষ হতে পারেন, ১০ জানুয়ারিতে প্রতীক্ষমাণ মানুষের ঢল ও আবেগ তার অনন্য উদাহরণ হয়ে আছে। সারাবিশ্বের সংবাদকর্মীরা সেদিন উপস্থিত ছিলেন ঢাকায়। বিশ্ববাসীও বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করেছেন বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা কত বিশাল, কত ব্যাপক হতে পারে! ধ্বংসযজ্ঞের ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শুরু করেন পুনরুদ্ধারের কাজ। মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মাথায় তিনি দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে পালন করেন। স্বাধীনতার পর পর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি লাভ সহজ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর দক্ষ বিদেশনীতি স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিকে আমাদের পক্ষে আনতে বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। মুসলিম উম্মাহর অনেক দেশ পাকিস্তান ভাঙ্গার কারণে বেশ কিছুটা ক্ষুব্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধু তাদের বাংলাদেশের বাস্তবতা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। অর্থনৈতিক মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে তিনি ছিলেন এক এবং অদ্বিতীয়। তিনি দেশে ফিরে না আসলে অর্থনৈতিক মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার কেউ ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু স্বদেশে এসেছিলেন বলেই ভারতীয় সৈন্য অতি দ্রুত সময়ে প্রত্যাবর্তন করেছিল। পৃথিবীর কোন দেশের স্বাধীনতার পর এত কম সময়ে মিত্র শক্তি সহজে দেশ ছাড়ে না। বঙ্গবন্ধু তখন ফিরে না এলে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্রও এত তাড়াতাড়ি জমা পড়ত না এবং রাজাকার, দালালদের নিয়ে সম্ভবত এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। মুক্তিযোদ্ধারা ও জনগণ স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতি এতই ক্ষুব্ধ ছিল যে, দেশে রক্তের বন্যা বয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অভিভাবকত্বে একটি শান্তিময় বিচারিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। যে কারণে মারাত্মক অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হয় এবং তাতে জনগণের মনে কিছুটা হলেও স্থিরতা আসে। পরিস্থিতির শিকার ব্যক্তিদের প্রতি তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। সর্বোপরি, বঙ্গবন্ধু তখন ফিরে না এলে মাত্র ১০ মাসের মধ্যে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন এবং সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক পথে জাতির অগ্রযাত্রা সম্ভব হতো না। আর এসব কারণেই বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন দেশের কৃষক, শ্রমিক, দরিদ্র ও মেহনতী মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য। সোনার বাংলা গড়ার জন্য। প্রতিটি ক্ষেত্রে যে পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন, তারই ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এদেশকে আজ উন্নত দেশে পরিণত করার দ্বারপ্রান্তে। হে বাঙালী জাতি জাগ্রত হও, সচেতন হও, একটি সুশিক্ষিত, সুনীতি সম্পন্ন, বিজ্ঞানমনষ্ক, মানবিক ও সুশৃঙ্খল উন্নত স্বনির্ভর জাতিতে রূপান্তরিত হও। তবেই বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবারের, ৩০ লাখ শহীদের ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত ও শ্রমের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং সুদীর্ঘ সংগ্রামী জীবন থেকে প্রেরণা নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমাদের নতুনভাবে এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্বের বুকে উন্নত-সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে চির অম্লান হয়ে থাকবে। লেখক : উপাচার্য, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×