ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

মুজিববর্ষ ॥ কাউন্টডাউন শুরু বাঙালী জাতি ও স্বাধীনতা নতুন করে আবিষ্কার করবে

প্রকাশিত: ০৯:১৬, ১১ জানুয়ারি ২০২০

মুজিববর্ষ ॥ কাউন্টডাউন শুরু বাঙালী জাতি ও স্বাধীনতা নতুন করে আবিষ্কার করবে

লিখতে শুরু করলাম আজ ১০ জানুয়ারি শুক্রবার পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে জাতির পিতার স্বপ্নের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস, ছাপা হবে কাল শনিবার ১১ জনুয়ারি। এরই মধ্যে পিতার জন্মশতবর্ষ মুজিববর্ষের কাউন্টডাউন বা ক্ষণগণনা শুরু হয়ে গেছে। ২০২০ এবং ২০২১ আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। একদিকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, অপরদিকে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি বা সুবর্ণজয়ন্তী- ঈদের পর শুক্রবার। জন্মশতবার্ষিকী এবং সুবর্ণজয়ন্তী ইভেন্ট দুটি হলেও সত্তা এক। বরং একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমার্থক, তেমনি আমাদের স্বাধীনতাও বঙ্গবন্ধুর সমার্থক। একে অপর থেকে আলাদা করা যাবে না। অভিন্ন সত্তা। বরং এই দুটি ইভেন্ট উদযাপনের মাধ্যমে বাঙালী জাতি তার জাতিরাষ্ট্রের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নতুন করে আবিষ্কার করবে। - একটি জীবন (১৭ মার্চ ১৯২০-১৫ আগস্ট ১৯৭৫, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া শেখ পরিবারে) - হাজার বছরের পথ চলা - নেতাজী বলতেন- আমি সুভাষ বলছি - শেখের বেটা বঙ্গবন্ধু বলতেন- ভাইয়েরা আমার, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি বাংলার মানুষের অধিকার চাই - বাবা-মা আদর করে ডাকতেন খোকা বলে -মাঠের সাধারণ মানুষের দেয়া নাম শেখ সাব - আরও কত শত নাম - শেখ মুজিবুর রহমান - শেখ মুজিব - (তিনি যেমন ভালবেসে ডাকতেন আমার গরিব-দুঃখী মানুষ, তেমনি তারাও ডাকতেন) আমাদের শেখের বেটা -(রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে) মুজিব ভাই - (ইসলামিয়া কলেজ, কলকাতা, ছাত্র সংসদের জিএস) ছাত্রনেতা মুজিব - গ্রাজুয়েট মুজিব (১৯৪৭ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল’-এর ছাত্র মুজিব (১৯৪৭) - (রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে) মুজিব (১৯৪৭-৫২) -(ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত) মুজিব (১৯৪৮) - (আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায়) মুজিব (১৯৪৯) - (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী আন্দোলনে) মুজিব - (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার) মুজিব (১৯৪৮) - (যুক্তফ্রন্টে) মুজিব - (পাকিস্তান জাতীয় সংসদে) মুজিব - (প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী) মুজিব - (মন্ত্রিত্ব ত্যাগ ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক) মুজিব - (আইয়ুবের মিলিটারি শাসনবিরোধী নেতা) মুজিব -(৬২-র শিক্ষা আন্দোলনে) মুজিব - (ফেব্রুয়ারি ৫, ১৯৬৬, লাহোরে সর্বদলীয় শীর্ষ বৈঠকে) মুজিব - (বাঙালীর মুক্তি সনদ) ৬ দফার মুজিব - (বারে বারে কারাগারে) মুজিব - (পাকিস্তানের ২৩ বছরে ১৩ বছর কারাগারে) মুজিব - (তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ১ নং আসামি) মুজিব - (ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসি টার্গেট) মুজিব - (বাঙালীর অবিসংবাদী নেতা) মুজিব - (হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী) মুজিব - (বাঙালীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান) মুজিব - বিশ্বনেতা মুজিব - বিপ্লবী মুজিব - (২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে কারামুক্ত) মুজিব - (২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ রেসকোর্স ময়দানে জাতির পক্ষে তৎকালীন ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ কর্তৃক উপাধি) বঙ্গবন্ধু - (রেসকোর্সের ১০ লাখ মানুষের ২০ লাখ হাত তুলে জয় বাংলা বলে সমর্থন) মুজিব - (সত্তুরের ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচন) মুজিব - (ঐ নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে) মুজিব - (প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে) মুজিব - (বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শাসনতান্ত্রিক নেতা) মুজিব - (মিলিটারি আইয়ুবের পতনে) মুজিব - (মিলিটারি ইয়াহিয়ার সংসদ অধিবেশন বাতিলের প্রতিবাদে একাত্তরের মার্চব্যাপী দুনিয়া কাঁপানো অসহযোগ আন্দোলনে) মুজিব এই দীর্ঘ আন্দোলনের স্লোগান : ১. রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই- দিতে হবে ২. রাষ্ট্রভাষার দাবি- মেনে নাও মানতে হবে ৩. তোমার ভাষা আমার ভাষা- বাংলা ভাষা বাংলা ভাষা ৪. তুমি কে আমি কে- বাঙালী বাঙালী ৫. পদ্মা-মেঘনা-যমুনা- তোমার আমার ঠিকানা ৬. পিন্ডি না ঢাকা- ঢাকা ঢাকা ৭. রফিক-সালামের রক্ত- বৃথা যেতে দেব না ৮. কথায় কথায় গুলি চালানো- চলবে না চলবে না ৯. কথায় কথায় গুলি- মানি না মানব না ১০. কথায় কথায় গুলি- জবাব পাবে জবাব দেব ১১. নুরুল আমিনের বিচার চাই- হতে হবে হতে হবে ১২. নুরুল আমিনের ফাঁসি চাই- হতে হবে হতে হবে ১৩. কুখ্যাত মিলিটারি শাসন- মানি না মানব না ১৪. কুখ্যাত মিলিটারি শাসন- তুলে নাও নিতে হবে ১৫. কুখ্যাত শিক্ষা কমিশন- মানি না মানব না ১৬. ৬ দফা- মেনে নাও নিতে হবে ১৭. শেখ মুজিবের ৬ দফা- মেনে নাও নিতে হবে ১৮. শেখ মুজিবের ৬ দফা- বাঙালির মুক্তির সনদ মুক্তির সনদ ১৯. শেখ মুজিবের মুক্তি চাই- দিতে হবে দিতে হবে ২০. রাজবন্দীদের মুক্তি চাই- দিতে হবে দিতে হবে ২১. জেলের তালা ভাংবো- শেখ মুজিবকে আনব ২২. আইয়ুব গেছে যে পথে- ইয়াহিয়া যাবে সে পথে ২৩. জয় বাংলা ২৪. জয় বঙ্গবন্ধু ২৫. বীর বাঙালী অস্ত্র ধর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর ২৬. জিন্না মিয়ার পাকিস্তান- আজিমপুরের গোরস্তান এ পর্যায়ে মিলিটারি জান্তা প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া জাতীয় সংসদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন। বললেন ‘Mujib is a traitor (?), this time he will not go unpunished.’ সমস্ত বাংলা ফুঁসে উঠল। এ সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্লোগান হয়ে উঠল: - জয় বাংলা - বীর বাঙালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর এরই প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন গোটা বিশ্বের সাড়া জাগানো বিপ্লবী জননেতা। মিছিল চলছে ক্যাম্পাসে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হয়ে উঠেছে মিছিল-সমাবেশের এক উত্তাল অঙ্গন। ক্যাম্পাসের মিছিল ততদিনে সকল বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং স্কুল পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। গোটা বাংলাদেশটাই যেন এক মিছিলের রাজপথ আর সভা-সমাবেশের ময়দান। কোথাও কোথাও ছাত্র-ছাত্রীরা ড্যামি রাইফেল দিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে ২ মার্চ ৭১ ক্যাম্পাসে প্রস্তাবিত জাতীয় পতাকা উড়ালেন আ স ম আব্দুর রব, ছাত্রলীগের পল্টন ময়দানে (৩ মার্চ ৭১) স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ। পাঠ করলেন তৎকালীন ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ। ইশতেহারে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা ঘোষণা করা হয়, যা পরবর্তীকালে কুষ্টিয়ার আম্রকাননে ১০ এপ্রিল গণপরিষদের অধিবেশনে পঠিত স্বাধীনতার ইশতেহার অনুমোদন দেয়া হয়। এরই প্রেক্ষাপটে জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ’৭০-এর নির্বাচনের ম্যান্ডেট অনুযায়ী প্রদত্ত সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের বর্তমান স্বাধীনতা স্তম্ভের স্থলে মঞ্চ পাতিয়া ১০ লাখ বাঙালীর উত্তাল জনসমুদ্রে একাত্তরের ৭ মার্চ যে ভাষণ দিয়েছিলেন, যা ঐতিহাসিক ভাষণ নামে ইতিহাস-ঐতিহ্যখাত ‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ’, যা আজ বিগত আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত, যে ভাষণ মূলত স্বাধীনতার আহ্বান বা প্রথম ঘোষণা হিসেবে চিহ্নিত। বঙ্গবন্ধু মিলিটারি জেনারেল ছিলেন না, কোন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীও নন, তবুও গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার দিকনির্দেশনা দেন। যুদ্ধকালে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, বিদেশনীতি কি হবে তা বিস্তারিত তুলে ধরেন। মনে হলো পৃথিবীর সকল যুদ্ধের তিনি সর্বাধিনায়ক, সকল রাষ্ট্রের তিনি সফল রাষ্ট্রনায়ক, সকল মানুষের তিনি নেতা, মুজিব ভাই, বঙ্গবন্ধু, কেবল বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর তাবৎ মুক্তিকামী জনপদে তাঁর সদর্প বিচরণ। নেতাজী সুভাষ বোস ডাক দিয়েছিলেন- - ‘Give me blood, I will give you Independence.’ ভারতবাসী রক্ত দিয়েছিল, নেতাজী স্বাধীনতা দিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ফকির মজনু শাহের আখড়া থেকে সিপাই বিদ্রোহের দেয়াল টপকে, নজরুলের কারার লৌহ কপাট ভেঙ্গে, রবীন্দ্রনাথের বাঁধভাঙ্গার আহ্বানে নেতৃত্ব দিয়ে উচ্চারণ করলেন : - ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। জয় বাংলা’। আলহামদুলিল্লাহ, তিনি মানুষকে মুক্ত করে ছেড়েছেন, জাতিরাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছে। কী কী ছিল সেই ভাষণে: - ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল - পাড়ায়-মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল - যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে - আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না - আমি বাংলার মানুষের অধিকার চাই - তোমরা ব্যারাকে থাক, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না - সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না - আর আমার বুকে গুলি চালাবার চেষ্টা কর না - ভাল হবে না (তর্জনি উঁচিয়ে) - আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব - জয় বাংলা হোটেল ইন্টারকনে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনায় বঙ্গবন্ধু ৬ দফার এক দফাও ছাড় দিলেন না। আলোচনা ভেঙ্গে গেল। কী ছিল ৬ দফায় ক্স বঙ্গবন্ধুর ‘৬ দফায় কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা কেবল দুটি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে, যথা দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে প্রদেশ তথা অঙ্গ রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা হবে নিরঙ্কুশ (অর্থাৎ প্রতিরক্ষা কেন্দ্রের হাতে থাকলেও অঙ্গ রাষ্ট্রের হাতে নিজস্ব মিলিশিয়া, নিজস্ব কারেন্সি, রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা থাকবে) -বস্তুত বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছিল যা স্বাধীনতারই নামান্তর এখানে একটা মজার কথা তখন শোনা গেছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর এই ৬ দফা পেশ করার জন্য আতাউর রহমান খানকে প্রস্তাব করলে তিনি নাকি বলেছিলেন : -‘মাথা খারাপ। তুমি কি চাও আমি কল্লাটা পাকিস্তানীদের দিকে বাড়িয়ে দেই?’ এই অবস্থায় মিলিটারি জান্তা ইয়াহিয়ার সেনারা অপারেশন সার্চলাইট নাম দিয়ে একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসসহ গোটা বাংলাদেশে ট্যাংক-কামান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালাতে শুরু করে, গণহত্যা শুরু করে। তারা বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে গেল রাত ১টার দিকে। তার আগেই বঙ্গবন্ধু রাত সাড়ে ১২টার দিকে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক চূড়ান্ত ঘোষণা দিলেন (ইংরেজীতে): ‘This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on and till the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved’ বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি তৎকালীন ঊচজ, বর্তমান ইএই-র ওয়্যারলেসের মাধ্যমে প্রথমে সরাসরি চট্টগ্রাম ও পরে দেশব্যাপী প্রচার করা হয়। এক্ষেত্রে টেলিফোন, ফ্যাক্স, টেলিগ্রামও ব্যবহার করা হয়। শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা প্রথমে পাঠ করেন তৎকালীন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হান্নান ২৬ মার্চ ৭১ বেলা ২টা ৩০ মিনিট বঙ্গবন্ধুর পক্ষে। কিন্তু ঐ ট্রান্সমিটারটি ছিল মাত্র ১০ কিলোহার্টসের। তাই মাত্র ৬০ মাইলের মধ্যে শোনা গেছে। কিন্তু পরদিন ২৭ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিঃ মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে যে ঘোষণা পাঠ করেন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তার ক্ষমতা ছিল অনেক বেশি এবং তাই বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতীয় ভূখণ্ডে বেতার তরঙ্গে শোনা গেছে। মিলিটারি জিয়ার ঘোষণাটি ছিল এরকম- ‘I, Major Ziaur Rahman, do hereby declare independence of Bangladesh on behalf of our great national leader Bongobondhu Sheikh Mujibur Rahman’. কিন্তু বিএনপির আনাড়ি কিছু নেতা আছে যারা বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে জিয়াকে বড় করার হীন উদ্দেশ্যে বলার চেষ্টা করে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। তারা জিয়াকে ঘোষক বানাবার চেষ্টা করে চলেছে আজও। অথচ তাদের এ কথায় কোন সায় নেই, কোন প্রমাণ নেই। জিয়ার অর্ধশিক্ষিত ছেলে দণ্ড মাথায় নিয়ে লন্ডনে পলাতক তারেক জিয়া লন্ডনে বসে এমনি বানোয়াট প্রচারণা চালানোর চেষ্টা করে। তাদের যদি প্রশ্ন করা হয় স্বাধীনতা ঘোষণা দেবার মতো নৈতিক রাজনৈতিক সাংবিধানিক ম্যান্ডেট বা ক্ষমতা জিয়ার ছিল কি? জবাব দিতে পারবে না। কেননা ওই ম্যান্ডেট ছিল কেবল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের, যা তাঁকে দিয়েছে ঐতিহাসিক ৬ দফা এবং ৭০-এর নির্বাচন। জিয়াও তাই on behalf of our great leader Bongobondhu Sheikh Mujibur Rahman কথাটি উচ্চারণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম তার A tale of millions গ্রন্থে একই সমাধান দিয়েছেন। তাছাড়া কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা পাঠ করেন ২৭ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিট। এই ক্ষণ এবং দিনের ব্যাপারে কোন মতানৈক্য নেই। তাহলে ২৭ মার্চের সকালে সংবাদপত্র তা কিভাবে প্রকাশ করল? যেমন: - ‘২৭ মার্চ বিবিসির সকালের অধিবেশনে বলা হয়... শেখ মুজিবুর রহমান প্রদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন’। - ‘২৭ মার্চ দ্য টাইমসের প্রথম পাতায় শিরোনাম ছিল- Heavy fighting as Sheikh Mujib declares E. Pakistan independent.’ - ‘The guardian (২৭ মার্চ) লিখেছে- Shortly before his arrest, Mujeeb had issued a proclamation to his people which informed them you are citi“ens of a free country.’ তাহলে বলতে হয় যে শিশুর জন্ম হলো ২৭ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে সে কি করে ঐদিনই সকালের পত্রিকার পাতায় কথা বলে? বস্তুত নিজেদের কিছু নেই, তাই খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায় বিএনপি। তারপরের ইতিহাস ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। এর জন্য সাংবিধানিক ভিত্তি দরকার। কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে বসলেন ’৭০-এর নির্বাচনের জনপ্রতিনিধিগণ, অর্থাৎ জাতীয় সংসদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের (১৬৭+২৮৮) সদস্যগণ গণপরিষদ গঠন করে স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা (১০ এপ্রিল ৭১) এবং প্রবাসী বা বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে (১৭ এপ্রিল ৭১)। তাতে বলা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ গ্রেফতার হবার পূর্বে প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হয় একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক (supreme commander of arm forces)। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে। তাঁর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী এবং এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান প্রমুখ মন্ত্রী নির্বাচিত হন। যে কারণে বৈদ্যনাথতলাকে নাম দেয়া হয় মুজিবনগর, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী। এই বিপ্লবী সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। জেনারেল এম এ জি ওসমানী হন মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি। আর্মি (বেঙ্গল রেজিমেন্ট), পুলিশ, ইপিআর (বিজিবি), ইউ-ওটিসি, আনসার, গ্রাম পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে মুক্তিকামী জনগণ গণবাহিনী গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং এ যুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালী শহীদ হন ও ৫ লক্ষাধিক মা-বোনের সম্মান লুণ্ঠন করে পাকিস্তানী হায়েনার দল এবং তাদের সঙ্গে জামায়াত-শিবির, মুসলিম লীগ ও নেজামী ইসলামী বেইমানের দল। এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় এবং দেশাভ্যন্তরে তিন কোটি আজ এ বাড়ি, কাল ও বাড়ি করে ঘরহারা জীবনযাপন করে। ৯ মাসের সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারত সরাসরি আমাদের পাশে দাঁড়ায়। বিশেষ করে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী বা ইন্দিরা গান্ধী আমাদের পাশে দাঁড়ান। এ যেন তার নিজেরই যুদ্ধ। এভাবে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন এবং দেশ শত্রুমুক্ত হয়। যুদ্ধে ভারতেরও ১৩ হাজার সৈন্য শহীদ হন। পাকিস্তানের ৯৩ হাজার আর্মি আমাদের যৌথ কমান্ডারের কাছে আত্মসমর্পণ করে ঠিক যে জায়গায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এ যুদ্ধে ভারতের সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং বিশ্বের তাবৎ মুক্তিকামী জনগণ আমাদের পাশে দাঁড়ান। মিসেস ইন্দিরা গান্ধী আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য ও বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করে তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায় ফিরে আসতে তাঁর রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ প্রচেষ্টা জাতি চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ শেষে ’৭২-এর ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন ও দিল্লী হয়ে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন ১০ জানুয়ারি। সেদিন কোটি জনতা নেমেছিলেন রাজপথে প্রিয় নেতাকে এক নজর দেখার জন্য। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ভারতীয় সাংবাদিক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরেলা কণ্ঠের ধারাবিবরণী আর বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সেই গান আজও চোখ বন্ধ করলে শুনতে পাই: ‘বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায় তাই আজ ঘরে ঘরে এতো খুশি কি ভালো তোমাকে বাসি আমরা বল কি করে বোঝাই....’ (রচনা আবিদুর রহমান, সুর- সুধীন দাশগুপ্ত) মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে যেসব গান মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে শক্তি সঞ্চার করেছে: - শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি...। - কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট...। - বাঁধ ভেঙ্গে দাও... ভাঙ্গো... - পাল উড়াইয়া দেরে মাঝি... - মুজিব বাইয়া যাওরে... ক্স আমার সোনার বাংলা...(ইত্যাদি) ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু তেজগাঁও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে সেই মুহূর্তটির প্রতীকী ডিসপ্লের মাধ্যমে মুজিববর্ষের কাউন্টডাউন বা ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে গতকাল ৯৯তম ১০ জানুয়ারি... ঢাকা- ১০ জানু : ২০২০ লেখক : সংসদ সদস্য, সদস্য- মুজিববর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটি, সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×