প্রত্যেক আবিষ্কারকই একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি কী আবিষ্কার করতে যাচ্ছেন এবং তা করতে তার কী কী উপাদান লাগতে পারে সেটা আগে থেকেই চিন্তা-ভাবনা করে রাখেন। কিন্তু বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে, যা মোটেও তিনি আবিষ্কার করতে চাননি এবং যা হয়েছে তা দুর্ঘটনাবশত। লিখেছেন- প্রদীপ সাহা
পেনিসিলিন
বিখ্যাত অণুজীব স্যার আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং তখন গবেষণা করেন লন্ডনের সেন্ট মেরি হাসপাতালে। তাঁর গবেষণাগার ছিল খুবই নোংরা। ওই সময় তিনি কাজ করছিলেন স্ট্যাফাইলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া নিয়ে। একবার সাপ্তাহিক ছুটিতে বাসায় যাওয়ার আগে তিনি ব্যাকটেরিয়ার পাত্রগুলোকে একটি স্থানে একত্রিত করে রাখেন। অসাবধানতাবশত একটি পাত্র পড়ে যায় নোংরার মাঝে। ৩ সেপ্টেম্বর ১৯২৮ সালে ছুটি থেকে ফিরে তিনি লক্ষ্য করলেন, নোংরায় পড়ে থাকা ওই পাত্রটি এক ধরনের ছত্রাকে আক্রান্ত হয়েছে। নমুনাটি অকাজে নষ্ট হলো ভেবে ফেলে দেবেন ভাবতেই অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, এ পাত্রের ব্যাক্টেরিয়াগুলো মারা গেছে; যেখানে অন্য পাত্রগুলোর ব্যাক্টেরিয়া স্বাভাবিক রয়ে গেছে। ফ্লেমিং দ্রুত আবিষ্কার করেন ছত্রাকটি ছিল পেনিসিলিয়াম ক্রাইসোজেনাম প্রজাতির এবং এটি একাধিক প্রজাতির ব্যাক্টেরিয়া নিধনে কাজ করে।
এক্স-রে
ক্যাথোড রে আবিষ্কার হওয়ার পরও গবেষকরা জানতেন না এটি ব্যবহার করে মানবদেহের কঙ্কালের ছবি তোলা সম্ভব। ১৮৯৫ সালে জার্মান পদার্থবিদ উইলহেম রঞ্জন কালো কার্ডবোর্ডে ঢাকা গ্লাস টিউবে ক্যাথোড রশ্মি চালিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। মূলত তার উদ্দেশ্য ছিল গ্লাস থেকে ক্যাথোড রে বের হয় কিনা তা দেখার জন্য। কিন্তু এ সময় তিনি লক্ষ্য করেন, যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন তার কয়েক ফুট দূরে এক ধরনের আলোকরশ্মি দেখা যাচ্ছে। তিনি ধারণা করলেন, কার্ডবোর্ড কোথাও ফেটে গিয়ে হয়ত আলো বের হচ্ছে। পরীক্ষা করে দেখলেন, কার্ডবোর্ড ফেটে নয় বরং কার্ডবোর্ড ভেদ করে রশ্মি বের হচ্ছে। হঠাৎ তার মাথায় এলো, যে রশ্মি কার্ডবোর্ড ভেদ করতে পারছে তা মানবদেহ কেন পারবে না! তিনি তাঁর স্ত্রীর হাত সামনে রেখে পরীক্ষা চালালেন এবং মানবদেহের কঙ্কালের ফটোগ্রাফিক ইমেজ তৈরিতে সক্ষম হলেন। পরে তিনি এর নাম দেন এক্স-রে।
পেসমেকার
আমেরিকান প্রকৌশলী উইলসন গ্রেটব্যাচ একটি ডিভাইস তৈরি করেছিলেন, যা দ্বারা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন রেকর্ড করা যেত। একবার ভুলবশত যন্ত্রটিতে অন্য একটি রেজিস্টার লাগানো হলে গ্রেটব্যাচ দেখতে পান, যন্ত্রটি একবার স্পন্দিত হয়ে থেমে আবার স্পন্দন দিচ্ছে। গ্রেটব্যাচের মনে হলো, এটি মানুষের হৃদস্পন্দনের অনুরূপ। পরীক্ষা করে তিনি দেখলেন, তিনি যা ভেবেছিলেন তা-ই ঠিক।
এরপরই তিনি তৈরি করলেন প্রথম ইমপ্লানটেবল কার্ডিয়াক পেসমেকার, যা বাঁচিয়ে দিচ্ছে লাখ লাখ দুর্বল হার্টের রোগীকে।
ভায়াগ্রা
ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি ফাইজারের অধীনে ইংল্যান্ডের ওয়েলসে একদল গবেষক ১৯৮৫ সাল থেকে এনজাইনা (বুকে ব্যথা) ও হাইপার টেনশনের অধিক কার্যকরী ওষুধ আবিষ্কারের লক্ষ্যে গবেষণা চালিয়ে আসছিলেন। ১৯৯২ সালে তারা একটি নতুন ওষুধ আবিষ্কার করেন এবং পরীক্ষা চালানোর সময় দেখতে পান, এনজাইনার ক্ষেত্রে খুব অল্প কাজ করলেও দ্রুত লিঙ্গ উত্থানে এটি কাজ করছে।
বিষয়টি গবেষকদের কাছে স¤পূর্ণ অভাবনীয় হলেও ততক্ষণে ওষুধ শিল্পের অন্যতম বৈপ্লবিক আবিষ্কারটি তাঁরা করে ফেলেন। এখন সারা বিশ্বে যৌন সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে গবেষকদের ভুলে আবিষ্কার হওয়া এ ওষুধটি।
মাইক্রোওয়েব ওভেন
১৯৪৫ সালে আমেরিকান প্রকৌশলী পার্সি লেবারন স্পেন্সার কাজ করছিলেন ম্যাগনির্ট্রনস ডিভাইস নিয়ে। এই ডিভাইস রাডারে মাইক্রোওয়েভ রেডিও সঙ্কেত তৈরির জন্য কাজে লাগত। কাজ করার প্রয়োজনে একটি চালু ডিভাইসের সামনে দাঁড়ানোর সময় স্পেন্সারের পকেটে ছিল চকোলেট বার। এ সময় তিনি টের পান, চকোলেটটি গলে গেছে। স্পেন্সার ঠিক বুঝে উঠতে না পারলেও মাইক্রোওয়েভ যে এর পেছনে কাজ করছে তা আন্দাজ করতে পারলেন। তিনি দ্রুত কিছু পপকর্ন এনে ডিভাইসটির সামনে রাখলেন। ফটফট শব্দ তুলে দ্রুতই রুমে ছড়িয়ে পড়ল পপকর্ন। স্পেন্সারের বুঝতে বাকি রইল না, হঠাৎ করে নিজের অজান্তেই তিনি মাইক্রোওয়েভ ওভেন আবিষ্কার করে ফেলেছেন।
পটেটো চিপস
জনপ্রিয় এ খাবারটি তৈরি হয়েছে কিছুটা ভুল আর কিছুটা ক্ষোভবশত। আমেরিকার সারাটোগা স্প্রিংস শহরের এক হোটেলের বাবুর্চি ছিলেন জর্জ ক্রোম। ১৮৫৩ সালের ২৪ আগস্ট রাতে তার এখানে এক খদ্দের এসে আলু ভাজার অর্ডার দেন। সরবরাহ করার পর ভদ্রলোক তা ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, আলুগুলো খুব বেশি মোটা করে কাটা হয়েছে এবং এগুলো খুব বেশি আর্দ্র। আবার সরবরাহ করার পর খদ্দের একই অভিযোগ করেন এবং বলেন, খাবারে লবণও কম দেয়া হয়েছে। ম্যানেজারের ভর্ৎসনা শুনে ক্ষেপে যান বাবুর্চি ক্রোম। তিনি এবার কাগজের মতো পাতলা করে আলুগুলো কাটলেন ও কড়া করে তেলে ভাজলেন, যাতে খদ্দের কাঁটাচামচ দিয়ে খেতে না পারেন। সবশেষে আলু ভাজার ওপর ছড়িয়ে দিলেন মাত্রারিক্ত লবণ। খদ্দেরকে শায়েস্তা করাই ছিল ক্রোমের উদ্দেশ্য। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, নিমেষেই আলুভাজা সাবাড় করে ফেললেন ভদ্রলোক। অর্ডার দিলেন আরও এমন আলুভাজা নিয়ে আসার জন্য। এভাবেই জন্ম নিল মুখরোচক পটেটো চিপসের।
স্যাকারিন
জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে খনিজ আলকাতরা নিয়ে গবেষণা করছিলেন ইরা রেমসন ও সি ফাহালবার্গ। ১৮৭৮ সালে একদিন কাজ করে ক্ষুধার্ত রেমসন ও ফাহালবার্গ খেতে বসলেন। তড়িঘড়ি খেতে বসায় হাত ধুতে ভুলে গেলেন ফাহালবার্গ। খাওয়ার সময় তিনি টের পেলেন খাবার মিষ্টি মিষ্টি লাগছে।
রেমসনকে এ ব্যাপারে জানালে দু’জনই টের পেলেন, যে পদার্থ নিয়ে তারা গবেষণা করছেন তা থেকে কৃত্রিম চিনি জাতীয় পদার্থ উৎপাদন করা সম্ভব। পরে ফাহালবার্গের নাম দেন স্যাকারিন।
ব্রান্ডি
মধ্যযুগে ব্যবসায়ী বা নাবিকরা জাহাজে করে ওয়াইন সরবরাহ করার আগে ওয়াইন থেকে পানি বের করে নেয়ার জন্য সিদ্ধ করত। কিন্তু একবার এক নাবিক ওয়াইন সিদ্ধ না করে ভুলবশত তা কাঠের বাক্সে সংরক্ষণ করে।
দীর্ঘদিন পর পান করার সময় তারা টের পায়, এর স্বাদ সম্পূর্ণ আলাদা এবং আরও উপাদেয়। এভাবেই তৈরি হয় প্রথম ব্রান্ডি।
সুপার গ্লু
স্বচ্ছ প্লাস্টিক আবিষ্কারের জন্য সিয়ানোএক্রিলেটস নিয়ে ১৯৪২ সালে কোডেক ল্যাবরেটরিতে কাজ করছিলেন ড. হ্যারি কুভার ও তার সহকারী ফ্রেড। তখন তিনি দেখতে পান, নতুন তৈরি হওয়া পদার্থটি খুব বেশি আঠালো এবং তা সবকিছুতেই শক্তভাবে লেগে যাচ্ছে। ফালতু ভেবে প্রকল্পটি বাতিল করলেন কুভার। এর ঠিক ছয় বছর পর আবার একদিন কুভার কাজ করছিলেন বিমানের ককপিটের ওপর স্বচ্ছ আচ্ছাদন তৈরির জন্য। এক্ষেত্রেও তিনি সিয়ানোএক্রিলেটস ব্যবহারে একই সমস্যায় পড়েন। কোন তাপ বা চাপ ছাড়াই এটি খুব বেশি আঠালো লাগছিল কুভারের কাছে। এবার আর ভুল করলেন না কুভার। প্রকল্পটি বাতিল না করে দুটি গ্লাসকে সিয়ানোএক্রিলেটস দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করে সফল হলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি নতুন এ আঠাটি সুপার গ্লু নামে বাজারে ছাড়লেন।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: