ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

হিন্দুদের আধ্যাত্মিক গান শুনে ভোরে ঘুম ভাঙতো আমাদের ॥ রিকাত

প্রকাশিত: ০৩:৩১, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯

হিন্দুদের আধ্যাত্মিক গান শুনে ভোরে ঘুম ভাঙতো আমাদের ॥ রিকাত

অনলাইন ডেস্ক ॥ ভারতের অন্য মুসলিমদের মতো, ভবিষ্যতে কি হবে তা ভেবেই আমার দিনগুলো কেটে যায়। আমার ধর্ম বিশ্বাসের কারণে কি আমার চাকরি হবে না? আমাকে কি আমার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে? আমাকে কি কোন এক দল মানুষ মেরে ফেলবে? এই ভয় কি কখনো যাবে? "ধৈর্য্য ধরো", ভারতের রাজধানী দিল্লীতে, আমার বিশ্ববিদ্যালয় জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ায় এক সহিংস রাতের পর একথা বলেছিলেন আমার মা। বিবিসির পুজা ছাবরিয়াকে এসব কথা বলছিলেন, দিল্লীর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ছাত্রী রিকাত হাশমি। দেশে নতুন একটি আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বন্ধ করতে শিক্ষার্থীদের মারধর করা হয়েছিল, লাইব্রেরি আর বাথরুমে টিয়ার গ্যাস দেয়া হয়েছিল এবং তাদেরকে সম্ভাব্য সব ধরণের উপায়ে হুমকি দেয়া হয়েছিল। এই আইনটি বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে পাড়ি জমানো মুসলিম ছাড়া অন্য ছয়টি ধর্মের মানুষদের নাগরিকত্বের অধিকার দেয়। মুসলিমদেরকে আলাদা ভাবে লক্ষ্য করে বাদ দেয়া হয়েছিল এবং এই আইনি বৈষম্যগুলোই ছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মূল বিষয়। রিকাত হাশমির প্রশ্ন, তাহলে পুলিশ কেন এ ধরণের সহিংস পদক্ষেপ নিলো? তারা বলে যে, এর কারণ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা যানবাহনে আগুন দেয়ায় এই প্রতিক্রিয়া এসেছে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ কোথায়? তারা বলে যে, তারা গুলি চালায়নি, তাহলে হাসপাতালে যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা আহত হলেন কিভাবে? এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দন্ত চিকিৎসায় ডিগ্রি নেয়ার বিষয়ে পড়াশোনা করছি আমি এবং এই সময়ে এখানে আমি অনেক শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হতে দেখেছি। আমি এই বিক্ষোভে অংশ নেইনি যা পরে সহিংস সংঘর্ষে রূপ নেয়, কিন্তু এর পরিণতির শিকার হয়েছিলাম আমি যাতে পুলিশ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে হামলা শুরু করে। আমার মনে আছে, পুলিশ যখন আমাদের হোস্টেলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে তখন আমি ভয়ে চিৎকার করছিলাম।আমরা আমাদের বাতি বন্ধ করে দিয়েছিলাম এবং অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। রাত কেটে যাওয়ার পর সৌভাগ্যক্রমে আমরা সুরক্ষিত ছিলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে যা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল তা হল: আমরা সমালোচনা করেছি কিনা সেটি কোন বিষয় নয়, তবে যেহেতু আমরা লক্ষ্যবস্তু তাই ধরেই নেয়া হতো যে আমরা করেছি। আমরা নতুন ভারতের মুসলিম। আমার মনে আছে, ছোট বেলায় হিন্দুদের আধ্যাত্মিক গান গাওয়া শুনে ভোর বেলা ঘুম ভাঙতো আমাদের। পূর্বাঞ্চলীয় ওডিশা বা সাবেক উড়িষ্যা রাজ্যে প্রধানত হিন্দুপাড়ায় আমরা একমাত্র মুসলিম পরিবার ছিলাম। যেকোন উৎসব আমরা সব সময় একসাথে উদযাপন করতাম - ঈদের সময় তারা আমার হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিতো, আর নবরাত্রির অনুষ্ঠান উদযাপন করতে তাদের বাড়িতে চলে যেতাম আমরা। যা খারাপের বিরুদ্ধে ভালোর জয়ের অনুষ্ঠান। আমার অনেক হিন্দু বন্ধু ছিল যারা বিরিয়ানি খাওয়ার জন্য আমাদের বাসায় আসতো। এটি এমন একটি খাবার যেখানে প্রচুর পরিমাণে মাংস এবং মশলা থাকে। আশেপাশে কোন মসজিদ ছিল না। কিন্তু এটা নিয়ে আমার বাবার কোন আক্ষেপও ছিল না। কারণ তিনি ধর্ম-কর্ম পালন করা মুসলিম ছিলেন না। আমার মা আমাদের বাড়িতেই ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। আমি আরও অনেক হিন্দু ছেলে মেয়েদের সাথে কনভেন্ট স্কুলে পড়েছি আর সেখানে এক মুহূর্তের জন্যও ধর্মীয় বৈষম্য ছিল না। শুধু একবার আমার এক বন্ধু আমাকে বলেছিল যে, 'মুসলিমরা প্রতিদিন গোসল করে না'র মতো মিথের কথা বলেছিল যা শোনার পর আমি অনেক হাসাহাসি করেছিলাম। আমি উত্তর দিয়েছিলাম, "আমরা- আমি- প্রতিদিন গোসল করি।" ধর্ম আমাদের জীবনযাপনের একটা অংশ ছিল, কিন্তু মুসলমান হিসেবে আমি কখনো আলাদা করে পরিচয় দেয়ার বিষয়ে সচেতন ছিলাম না। তবে তা অবশ্যই বর্তমান সময় আসার আগে পর্যন্ত। আমাদেরকে বিভক্ত করতে বাহিনী রয়েছে এবং আমি নিশ্চিত নই যে আগের সেই চিন্তামুক্ত অভিজ্ঞতা আমার আর কখনো হবে কি না। প্রতিনিয়তই আমাদেরকে মাংস-খেকো, ধর্ষণকামী সমাজ, পাকিস্তানকে সমর্থন করা সন্ত্রাসী, ধর্মান্তরিত হিন্দু এবং সংখ্যালঘু যারা দেশকে দখল করে নেবে বলে ছোট করা হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, আমরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হতে যাচ্ছি যাদেরকে ভয়ের মধ্যে কিভাবে বাঁচতে হয় তা শিখতে হবে। নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে চলা বিক্ষোভের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজের একটি মাত্র টুইটে তিনি সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান এবং বলেন: "এই সময় শান্তি, ঐক্য এবং ভ্রাতৃত্ব ধরে রাখার সময়।" একদিন আগে তিনি হাজার হাজার মানুষ এবং কয়েক ডজন ক্যামেরার সামনে বলেছিলেন: "যারা সম্পদে আগুন দিচ্ছে তাদেরকে টিভিতে দেখা যায়... তাদের পরিহিত পোশাক দেখে তাদের সনাক্ত করা যায়।" তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি কিন্তু আমার ধর্মের উপর পরোক্ষ এই আক্রমণ হাস্যকরভাবে আমাকে আরো বেশি ধার্মিক করে তুলেছে। আমি শুধু বাহ্যিকভাবে এটা বোঝাইনি। ১৬ বছর বয়সে আমি হিজাব পরতে শুরু করি। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা নেয়ার জন্য আমি উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য উত্তর প্রদেশে আসি এবং হিজাব পরে এমন অনেক মেয়েকে আমি চিনি। এটা আমার কাছে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল এবং আমি হিজাবকে আমার ব্যক্তিত্বের অংশ হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেই। আজ ২২ বছর বয়সে আমি আমার ধর্ম এবং দেশের সংবিধানের বিরুদ্ধে নির্লজ্জভাবে যে ভুল তথ্য প্রচার করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার তাগিদ অনুভব করছি। আমি বৈষম্যমূলক নীতি এবং পড়তি অর্থনীতির বিরুদ্ধে সমালোচনা করতে চাই। কিন্তু প্রতিবারই আমাকে 'জাতীয়তাবাদ বিরোধী' এবং 'হিন্দ বিরোধী' বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং আড়ালে ঠেলে দেয়া হয়েছে। যদি আমি প্রধানমন্ত্রীর চালু করা নীতির বিরুদ্ধে মত দেই তাহলে আমাকে বলা হয়েছে যে আমি 'হিন্দু-মুসলিম ইস্যুকে উস্কে' দিচ্ছি। আমরা এমন একটি বিপজ্জনক নতুন যুগে বাস করছি যেখানে ধর্ম এবং জাতীয়তাবাদ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মাঝে মাঝে আমি দেখি যে, রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার সময় হিজাব পরার কারণে লোকজন আমার দিকে তাকিয়ে থাকছে। এটা হয়তো অযৌক্তিক ভয়ের কারণে, কিন্তু ইসলাম ভীতির পরিস্থিতি নিশ্চিতভাবেই দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি এটা বন্ধ করতে চাই কিন্তু এটা হচ্ছে মিডিয়া এবং সরকারের দৃষ্টিসীমার মধ্যেই। ক্ষমতাসীন বিজেপি নির্লজ্জভাবে একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী আদর্শকে ধারণ করে এবং কিছু আইন তৈরি করা হয়েছে ধর্মীয় বৈষম্যকে পুঁজি করে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে 'হেট ক্রাইম' সংগঠনের জন্য ক্ষমতা দেয়া হয়েছে বিশেষ ধরণের নজরদারি কমিটিকে। এমন চরম দুর্ভাগা পরিস্থিতিতে, ভিন্নমতগুলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এটা সেই ভারত নয় যেখানে আমি বেড়ে উঠেছি এবং এর চেয়ে অনেক ভাল পরিস্থিতি পাওয়ার অধিকার রয়েছে আমাদের। আমরা, নতুন ভারতের ২০ কোটি মুসলিম বলছি। নতুন ধরণের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। আমরা আলোচনা করতে থাকি যে, প্রস্তাবিত আরেকটি নাগরিকত্ব আইন যেটি পাস হলে পুরো দেশের মানুষকে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে তখন পরিস্থিতি আরো কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন যে ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে সেই আইনটি পাস করাবেন তিনি। কিন্তু এখনো কিছুটা আশা রয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঘৃণা এবং দুর্বল গোঁড়ামির বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠতে শুরু করেছে। হয়তো যারা আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান করছেন তাদেরকে কিছুটা মানবিক এবং যৌক্তিকভাবে চিন্তা করতে অনুপ্রাণিত করবে। আপাতত, যেহেতু আমার দুনিয়ায় ভাঙন ধরেছে তাই নীরবে অপেক্ষা করা ছাড়া আমার আর উপায় নাই। আমাকে হোস্টেল থেকে নিয়ে এসে জোর করে ছুটি কাটাকে বাধ্য করা হচ্ছে। এতে আমার পড়াশোনায় প্রভাব পড়ছে। আমি অন্য শহরে থাকা আমার পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করতে যেতে পারি না কারণ সেখানে পুরোদমে বিক্ষোভে ফুঁসছে মানুষ। তাই আপাতত স্থানীয় এক অভিভাবকের জিম্মায় রয়েছি, আর আমার মায়ের কথা বারবার ভাবছি: "ধৈর্য্য ধরো আর সর্বশক্তি দিয়ে টিকে থাকতে চেষ্টা করো" সূত্র : বিবিসি বাংলা
×