ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাকি সেনার ব্রাশ ফায়ারে কেতনা বিলে ২ হাজার গ্রামবাসী শহীদ হয়

প্রকাশিত: ১০:৩৭, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯

পাকি সেনার ব্রাশ ফায়ারে কেতনা বিলে ২ হাজার গ্রামবাসী শহীদ হয়

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ শ্যালা উদারসে ইদারাও-মুক্তি কিয়া আশ্রয় দাও- এ কথা বলেই আমাদের গ্রামসহ আশপাশের গ্রাম থেকে ধরে আনা ৪৫ জন নিরীহ গ্রামবাসী নারী-পুরুষকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানী মিলিটারিরা। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের নীরব সাক্ষী বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার কাঠিরা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা শতীশ চন্দ্র রায় (৭০)। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, আমার বাবা শ্যাম কান্ত রায়সহ ৪৫ জনকে ১৯৭১ সালের ২০মে কাঠিরা গ্রামে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করে পাক সেনারা। বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে আমি ভারতে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরেও আমাদের ভাগ্যে জোটেনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের স্বীকৃতি। এমনকি আমার নিজের নামও মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত করা হয়নি। তিনি জানান, মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য একাধিকবার সংশ্লিষ্ট দফতরে আবেদন করেও কোন সুফল মেলেনি। একই গ্রামের হরেন মধু (৭৭) জানান, পাকসেনারা তাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে তার বাবা নারায়ণ মধু, কাকা মনোরঞ্জন মধু, জগীন্দ্র নাথ মধু, রনজিত মধুসহ ১৮ জনকে ওই বাড়িতে বসেই হত্যা করে। গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি মনোহর অধিকারী (৯০) জানান, কাঠিরা গ্রামে বিভিন্ন এলাকার সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিয়েছে। স্থানীয় রাজাকারদের কাছে পাকসেনারা এমন খবর পেয়ে ’৭১’র ২০ মে (রবিবার) সকালে কাঠিরা বাজারে দুইজন ভিক্ষুককে হত্যা করে গ্রামের চারপাশ ঘেরাও দিয়ে। পরবর্তীতে হানাদাররা মুক্তিবাহিনীদের আশ্রয় দেয়ায় কাঠিরা গ্রামের ১৫ জন, ঘোড়ারপাড় গ্রামের সাত জনসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের ৪৫ জন নিরীহ নারী-পুরুষকে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করে। পাক সেনারা ওই ৪৫ জনের লাশ কাঠিরা গ্রামের গীর্জার পাশের একটি ডোবায় ফেলে রাখে। পরে এলাকাবাসী ওই ডোবার মধ্যেই লাশগুলো মাটিচাপা দিয়ে রাখেন। দেশ স্বাধীনের পর এলাকার সর্বস্তরের মানুষের দাবি ছিল ওই বধ্যভূমির ওপর শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার। স্থানীয় হিমাংশু কর্মকার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, স্বাধীনতার পর কতো সরকার আইলো আর গ্যালো কেউ শহীদদের স্মরণ করেননি। পরবর্তীতে এলাকাবাসীর সহায়তায় ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সিসিডিবির সহযোগিতায় ১৯৯৭ সালের ২০ মে বধ্যভূমির ওপর একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। সেই থেকে প্রতিবছর ২০মে এলাকাবাসী বধ্যভূমির শহীদদের স্মরণে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে আসছে। সরকারী উদ্যোগে এখানে আজও কোন কর্মসূচী পালন করা হয়নি। শহীদ পরিবারের সদস্যরা ‘শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি’ পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ বধ্যভূমি কেতনার বিল স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার ইউনিয়নের রাংতা গ্রামের কেতনার বিলে পাক সেনাদের নির্মম বুলেটে প্রায় দুই সহস্রাধিক নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হয়েছিলেন। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহত বধ্যভূমি কেতনার বিল এলাকায় সম্প্রতি সরকারী উদ্যোগে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ চলছে। রাংতা গ্রামের শহীদ কাশীনাথ পাত্রের পুত্র জগদীশ পাত্র (৬৫) জানান, ঘটনার দিন পহেলা জৈষ্ঠ প্রাণ বাঁচাতে পালাতে গিয়ে পাকিবাহিনীর গুলিতে এলাকার দুই সহস্রাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোর কেতনার বিলে শহীদ হন। ওই সময় তার বাবার সঙ্গে পালাতে গিয়ে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও তার বাবার শরীরে পাঁচটি গুলি বিদ্ধ হওয়ার পর ঘটনাস্থলেই তিনি শহীদ হন। ওইদিন সকালে চেঙ্গুটিয়া এলাকা দিয়ে হাজার-হাজার লোক জীবন বাঁচাতে কেতনার বিল পাড়ি দিয়ে আগৈলঝাড়ার কোদালধোয়া, রামানন্দেরআঁক ও বাকাল এলাকায় পালানোর সময় অধিকাংশই কেতনার বিলের পার্শ্ববর্তী কেষ্ট পাত্রের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। যখন পাক সেনারা পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে আসতে থাকে তখন তাদের দেখে দৌড়ে পালানোর সময় পাকি সেনাদের ব্রাশ ফায়ারে কেতনার বিলে দুই সহস্রাধিক লোক শহীদ হয়। ওইসময় সমস্ত কেতনার বিল লাশের স্তূপে পরিণত হয়েছিল। অনেক লাশ শিয়াল, কুকুরে ছিঁড়ে খেয়েছে। পরেরদিন এলাকার অমূল্য পাত্র ও হরলাল পাত্রের নেতৃত্বে পাত্র বাড়ির বিভিন্নস্থানে ৫/৬টি গর্ত করে অসংখ্য লাশ মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়। মাটি দেয়া ছাড়া বাকি লাশগুলো কেতনার বিলেই পচে গলে নষ্ট হয়ে যায়। অধিকাংশ গণকবর অরক্ষিত স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকবাহিনী ও স্থানীয় রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের বর্বর নির্যাতনে নিহত শহীদদের ৩৪টি গণকবরের স্মৃতি রক্ষার্থে এখনও বরিশালের অধিকাংশ স্থানে নির্মিত হয়নি স্মৃতিস্তম্ভ। যে সবস্থানে সরকারী কিংবা বেসরকারী উদ্যোগে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে তাও অযন্ত অবহেলায় পড়ে রয়েছে। সরকারী উদ্যোগে দীর্ঘ ৪৮ বছরে গণকবরগুলো সনাক্ত করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান না করায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বরিশাল অঞ্চলের বধ্যভূমির সম্ভাব্য তালিকার মধ্যে রয়েছে বরিশাল সদরের পানি উন্নয়ন বোর্ড সংলগ্ন কীর্তনখোলা নদীর তীরে সরকারীভাবে স্তম্ভ নির্মিত বধ্যভূমি (চিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় এক থেকে দেড় হাজার লোক, তালতলী বধ্যভূমি বেসরকারীভাবে ফলক নির্মিত (চিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় অর্ধ শতাধিক। চরকাউয়া মোসলেম মিয়ার বাড়ি সংলগ্ন খালের পাড় বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় ৩০ থেকে ৪০ জনকে। বরিশাল নগরীর ১নং সিএন্ডবি পুল বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যার শিকার হয় ৮ থেকে ১০ জন। গৌরনদীর বাটাজোর হরহর মৌজার মরার ভিটার বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় দেড় থেকে দুইশ’ জনকে, গৌরনদীর পালরদী নদীর তীরে সহকারী পুলিশ সুপারের অফিসের সামনে বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় দুই থেকে তিন শতাধিক, গৌরনদী গয়নাঘাটা পুল বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় দুই থেকে তিন শতাধিক, গৌরনদী কলেজ সংলগ্ন হাতেম পিয়নের বাড়ির ঘাটলা বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় চার থেকে পাঁচ শতাধিক গ্রামবাসীকে। শান্তি কমিটিতে যারা ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বরিশাল জেলা শান্তি কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিল ৩২ জন। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে শান্তি কমিটির জেলা সভাপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস ছিলেন বিএনপি সরকারের আমলে রাষ্ট্রপতি। ওই তালিকা অনুযায়ী জেলা শান্তি কমিটিতে সভাপতি ছিলেন দুইজন। প্রথমজন এ্যাডভোকেট আব্দুর রব। তিনি ১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের রাষ্ট্রপতি থাকা আব্দুর রহমান বিশ্বাস। মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া তথ্যে জানা গেছে, ওই শান্তি কমিটিতে একজন হিন্দু আইনজীবীও ছিলেন। চারজন সহ-সভাপতি পদের একজন ছিলেন বরিশাল নগরীর হাসপাতাল রোডের বাসিন্দা এ্যাডভোকেট প্রমথ কুমার সেন। তিনি (প্রমথ কুমার সেন) দেশ স্বাধীনের পর ভারতে পালিয়ে যান। সেখানে অবস্থানকালেই মারা যান। কমিটির অপর তিন সহ-সভাপতি বরিশাল নগরীর সদর রোডের শাহজাহান চৌধুরী, প্যারারা রোডের বাসিন্দা এ্যাডভোকেট সামসের আলী এবং স্ব-রোডের সৈয়দ হাতেম আলী (হাতেম মীরা)। এদের মধ্যে দেশ স্বাধীন হবার পর পাকিস্তানীদের সঙ্গে পালাতে গিয়ে সদর রোডের শাহজাহান চৌধুরী মারা যান। শান্তি কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন-নগরীর সিএন্ডবি রোডের বাসিন্দা এ্যাডভোকেট আবুল হোসেন সিকদার। জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন জামায়াত নেতা নগরীর নুরিয়া স্কুলের তৎকালীন প্রধানশিক্ষক খলিলুর রহমান। ট্রেজারার ছিলেন বরিশালের সাবেক পৌর চেয়ারম্যান গোলাম মাওলা। দফতর সম্পাদক ছিলেন নগরীর আমানতগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা সৈয়দ শের আলী (মোক্তার)। ওই কমিটির সদস্যরা হলেন-নগরীর গীর্জামহল্লা সড়কের বাসিন্দা মাওলানা বশিরুল্লাহ আতাহারী, নগরীর কলেজ রোডের এ্যাডভোকেট বিডি হাবিবুল্লাহ, আলেকান্দার আদম আলী হাজী, সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ কাজী মোতাহার হোসেন, সদর রোডের নজিব উদ্দীন আহম্মেদ, হাটখোলার সামসুদ্দিন তালুকদার, সদর রোডের ডাঃ ইমান আলী, কাউনিয়ার নোয়াব আলী, হাটখোলার আমজেদ মৃধা, নবগ্রাম রোডের মিনহাজ উদ্দিন আহমেদ খান, আলেকান্দার মীর আনোয়ার হোসেন, বগুড়া রোডের সৈয়দ ফজলে আলী, সৈয়দ মুনসুর আলী (মুনসুর মীর), ভাটিখানার আতাউর রহমান মুন্সী, নতুনবাজারের মতিয়ার রহমান তালুকদার, বৈদ্যপাড়ার কাঞ্চন গাজী, নবগ্রাম রোডের রাজ্জাক চৌধুরী, বাজার রোডের স্বরুব আলী মিয়া, হাসপাতাল রোডের জবান আলী খান, ব্রাউন কম্পাউন্ড রোডের আফসার উদ্দিন সরদার এবং বিএম স্কুল রোড এলাকার বাসিন্দা আব্দুল মজিদ মুন্সী।
×