ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত প্রথম বিজয় দিবসে-

প্রকাশিত: ১০:১৬, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯

রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত প্রথম বিজয়  দিবসে-

মোরসালিন মিজান ॥ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পরিপূর্ণভাবে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ। পরের বছর বাঙালীর মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রথম বিজয় দিবস উদ্যাপিত হয়। দিনটির তেমন কোন বর্ণনা এখন পাওয়া যায় না। তবে মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত দুর্লভ পত্রিকার রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ ও প্রবীণ ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে চমকিত হওয়ার মতো অনেক তথ্য। সংবিধান কার্যকর, সুপ্রীমকোর্ট চালুর বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করাসহ বেশকিছু কারণে দিবসটি ঐতিহাসিক। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ যেদিন শত্রুমুক্ত হয় সেদিন বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। ’৭২ সালের বিজয় দিবসে তাঁর উপস্থিতি রাষ্ট্রীয় আয়োজনকে পূর্ণতা দেয়। তাঁকে কেন্দ্রে রেখেই চলে উৎসব প্রস্তুতি। বর্তমানের বিজয় উৎসবগুলো সেদিনের আয়োজনটিকেই অনুসরণ করে চলেছে। জানা যায়, ১৯৭২ সালের এই দিনের সবচেয়ে বড় এবং ঐতিহাসিক ঘটনাটি ছিল বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হওয়া। ওই বছরের ৪ নবেম্বর জাতীয় সংসদে এ সংবিধান গৃহীত হয়। বিজয় দিবসের প্রথম বার্ষিকীর দিন এটি কার্যকর করা হয়। দিবসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাÑ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পুনরায় শপথ গ্রহণ। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল ঘোষিত স্বাধীনতার সনদ ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের মৌলিক আইনের প্রধান ভিত্তি। তখন এটিই ছিল সংবিধান। অস্থায়ী সংবিধানের আওতায় প্রথমে রাষ্ট্রপতি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। পরে পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে দেশে ফিরে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। বর্তমান সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর এর অধীনে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর একই শপথ নতুন করে নিতে হয় তাঁকে। সরকারীভাবে প্রকাশিত পাক্ষিক ‘বাংলাদেশ’ পত্রিকার প্রথম পাতায় এ সংক্রান্ত সংবাদ এবং ছবি ছাপা হয়। বলা হয়, ‘সিম্পল বাট ইম্প্রেসিভ সিরিমনি’র আয়োজন করা হয় বঙ্গভবনে। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও, তাঁর মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা একই নিয়মে শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন আবু সাঈদ চৌধুরী। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের জন্যও দিনটি ছিল ঐতিহাসিক। এদিন কার্যকর হওয়া সংবিধানে সুপ্রীমকোর্ট প্রতিষ্ঠার আইনী বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংবিধানের ষষ্ঠ অধ্যায়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে সুপ্রীমকোর্ট চালু করার বিধান রাখে সরকার। এর আগে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত ছিল হাইকোর্ট। এ খবরটিও খুব গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করে বিভিন্ন সংবাদপত্র। খবরে বলা হয়, হাইকোর্ট ও আপীল বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রীমকোর্ট ১৮ ডিসেম্বর থেকে কাজ শুরু করবে। তবে প্রথম বিজয় দিবসের রাষ্ট্রীয় উৎসব অনুষ্ঠান নিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে ছিল ব্যাপক কৌতূহল। সরকারের পক্ষ থেকেও যতটা সম্ভব বড় আকারে উৎসব আয়োজন করা হয়। ২৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ’ পত্রিকা থেকে জানা যায়, ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছিল সরকারী ছুটির দিন। এদিন ৩১ গান-সেল্যুটের মধ্য দিয়ে খুব ভোরে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের সূচনা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে গোলাবারুদের শব্দ আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল, হানাদার মুক্ত বাংলাদেশে একই শব্দ মধুর হয়ে বাঙালীর কানে বাজে। তখন অতো টেলিভিশন ছিল না। গ্রামে গঞ্জে পর্যন্ত রেডিও শোনার ব্যবস্থা চালু ছিল। তাই বিশেষ দিবসে সরকারী রেডিও দারুণ তৎপর হয়েছিল। বাংলাদেশ বেতার সূত্রে জানা যাচ্ছে, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়ে যায় আগের রাত থেকেই। ১১১ ঘণ্টার মেরাথন অনুষ্ঠান প্রচার করে বাংলাদেশ বেতার। একই রকম প্রচার ছিল টেলিভিশনে। টেলিভিশনও দীর্ঘ সময় ধরে বিজয় দিবসের বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে বিজয় দিবস উদ্যাপনের দিন ঢাকার নিজ বাসায় অবস্থান ইতিহাসবিদ ড. ফিরোজ মাহমুদ। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমার এখনও মনে আছে, ওই বিজয় দিবস নিয়ে সারাদেশের মানুষ উদ্বেলিত ছিল। খুব উত্তেজনার মধ্য দিয়ে গিয়েছি আমরা। আগেরদিন থেকেই রেডিও চালু করা ছিল। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার জাগরণী গানগুলো বাজছিল। আমরা পরদিন সকাল থেকে সারাদিন টেলিভিশনে চোখ রেখেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের গান কবিতা কথিকা ইত্যাদি সেদিন প্রচার করা হয়। একাত্তরের বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সবার মাঝেই ছিল অদ্ভূত আবেগ। সব অনুষ্ঠানই মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেছি আমরা। প্রবীণ ইতিহাসবিদ আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে বলেন, ১৯৭২ সালের বিজয় দিবসে গোটা জাতি ছিল ঐক্যবদ্ধ। একাত্তরের আবেগ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত হয়েছিল গোটা দেশ। একই প্রসঙ্গ টেনে মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, আজ আমরা দেখছি, সেই ঐক্য নেই। মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম দ্বিধা বিভক্ত। একাত্তরের পরাজিত অপশক্তি এখনও আস্ফালন করে চলেছে। এ অবস্থায় আজকের বিজয় দিবসে নতুন করে জেগে ওঠার শপথ নিতে হবে। আন্তরিকভাবে দেশের জন্য কাজ করার শপথ নিলে তবেই স্বার্থক হবে এত আয়োজন।
×