ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কৌশল

প্রকাশিত: ০৭:৪২, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯

 ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কৌশল

॥ তিন ॥ ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর কৌশলাদি : আমরা যদি ২০০৮ সালের ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বরকে বিবেচনা করি তবে সেদিন থেকেই বস্তুত আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচীর দ্বিতীয় স্তরে পা রাখব। এরই মাঝে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচীর প্রথম ধাপ অতিক্রম করে তারও পরের দুই বছর তথা শেখ হাসিনার ধারাবাহিক তৃতীয় সরকারের মেয়াদ শেষে কি কি লক্ষ্য অর্জন করব তার বিবরণ আওয়ামী লীগের ১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে সবিস্তারে উল্লেখ আছে। আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালে ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারে ২৩ সালের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করায় আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ ২.০ এর সূচনার কাজগুলো সেখান থেকেই জেনে গেছি। আমি মনে করি, বিশেষত ডিজিটাল দুনিয়ার লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের পাশাপাশি ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের বহমান কর্মকান্ড বাস্তবায়নের ফলে ডিজিটাল বাংলাদেশ ২.০ এর লক্ষ্যমাত্রাকেও সহজে নির্ধারণ করতে পারব। তবে আমি বহুবার বলেছি যে, আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচীর দ্বিতীয় স্তর শুরু হবে ২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে। ২৩ সালের মাঝে বর্তমান সরকার যেসব কর্মসূচী বাস্তবায়ন করবে বা যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করবে তারই ধারাবাহিকতা ডিজিটাল বাংলাদেশ ২.০ এ বহমান থাকবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের জন্য এর আগে আমি ৫টি কৌশল ও প্রতিটি কৌশলের জন্য ৬টি কর্মসূচী নির্ণয় করেছি। আমি মনে করি কালক্রমে সেই কৌশলগুলোর সামান্য নবায়ন হয়তো প্রয়োজন হবে। তবে আপাতত ২৩ সাল অবধি আমাদের ডিজিটাল যাত্রায় আমরা নির্ণীত কৌশল-কর্মসূচী ও জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালার কর্মসূচীগুলোকে অনুসরণ করতে পারি। একই সঙ্গে আমাদের অন্যান্য দেশের ডিজিটাল কর্মসূচী, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, সোসাইটি ৫.০ ও পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের কথাও মনে রাখতে হবে। আমার নিজের বিশ্বাস ২১ সালের মাঝে পৃথিবী জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, ৫জি, চতুর্থ বা ৫ম শিল্প বিপ্লব বা সোসাইটি ৫.০ এর বদৌলতে সামনের দিনগুলোকে আরও স্পষ্ট করতে সক্ষম হবে। প্রথমেই দেখা যাক ডিজিটাল বাংলাদেশ এর জন্য আমাদের কৌশল ও কর্মসূচীগুলো কি। প্রথম কৌশলটি হলো : ১) শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর ও ডিজিটাল দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ উন্নয়ন: এর জন্য আমি ছয়টি কর্মসূচী গ্রহণেরও প্রস্তাব করেছি: ক) পাঠ্যসূচীতে ডিজিটাল প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তি খ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন: গ) ডিজিটাল ক্লাসরুম গড়ে তোলা ও ডিজিটাল উপাত্ত সৃষ্টি ও সেইসব উপাত্ত দিয়ে পাঠদান ঘ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা ঙ) শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রদান: চ) প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরের জনগোষ্ঠীকে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণ দান: ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য দেশের সকল জনগোষ্ঠীকে ডিজিটাল দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদে পরিণত করা হচ্ছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমি নিশ্চিতভাবেই এটি উপলব্ধি করি যে ২১ সাল নাগাদ এই ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন অতি সামান্যই হবে। আমি দুঃখের সঙ্গে এক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যথাযথ উদ্যোগের অভাব অনুভব করি এবং সেজন্য আমাদের প্রস্তুতিও নগণ্য। এমনকি ডিজিটাল যুগে আমাদের শিশুদের যে ডিজিটাল দক্ষতা থাকা দরকার তার প্রতিও সামান্যতম নজর দিচ্ছি না আমরা। শিশুদের যেসব দক্ষতা থাকা দরকার সেগুলো হলো: ক) ডিজিটাল পরিচিতি নিশ্চিত করা খ) ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা অর্জন গ) ডিজিটাল সুরক্ষা নিশ্চিত করা ঘ) ডিজিটাল নিরাপত্তা বিধান: ঙ) ডিজিটাল আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা অর্জন চ) ডিজিটাল যোগাযোগ স্থাাপনে দক্ষতা অর্জন করা ছ) ডিজিটাল স্বাক্ষরতা অর্জন জ) ডিজিটাল বিশ্বে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় অধিকারগুলো সচেতনভাবে আয়ত্তে রাখা। আমরা এই বিষয়ে তেমনটা সচেতন নই এবং আমাদের নতুন প্রজন্ম জানে না যে, তাদেরকে এমন দক্ষতা অর্জন করতে হবে। তারা এটিও জানে না যে এসব দক্ষতা তিনটি স্তরে অর্জন করতে পারে। স্তরগুলো হলো: ডিজিটাল নাগরিকত্ব ২) ডিজিটাল উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতা এবং ৩) ডিজিটাল উদ্যোক্তা। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে আমাদের দ্বিতীয় কৌশল হলো: সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর ও জনগণের সকল সেবা ডিজিটালকরণ: এই কৌশলটির জন্য ছয়টি কর্মসূচী হলো: ক) কাগজবিহীন সরকার প্রতিষ্ঠা: খ) সরকারী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান: গ) সরকারের ডিজিটাল সংযুক্তিব্যবস্থা গড়ে তোলা: ঘ) ডাকবিভাগসহ সরকারের ডিজিটাল সেবাকেন্দ্র সম্প্রসারণ করা ঙ) ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা: চ) সরকারের সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে ডিজিটাল করা: এইসব কৌশল অবলম্বন করে আমাদের অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে ভাল। কিন্তু সেই অর্জনকেও আমরা খুব সন্তোষজনক বলতে পারব না। আমরা কেবল সরকারী সেবাসমূহের কথাই বেশি ভাবছি। বিশেষত সরকারী কর্মচারীদের বিশাল বাহিনীকে ডিজিটাল যুগের দক্ষতাসম্পন্ন করতে কোন সঠিক পরিকল্পনা আমরা হাতে নিইনি। বেসরকারী খাতের এই বিষয়ক কর্মকান্ড মোটেই সন্তোষজনক নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে তৃতীয় কৌশল হলো: কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্যা ও অর্থনীতির ডিজিটাল রূপান্তর: এই কৌশলটি প্রয়োগ করার জন্য ছয়টি কৌশল হলো: ক) সকল খাতে কাগজবিহীন লেনদেন নিশ্চিত করা: খ) সকল খাতের ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল করা: গ) উৎপাদনের সকল স্তরে ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রয়োগ: ঘ) সর্বত্র ডিজিটাল প্রযুক্তির শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান: ঙ) সৃজনশীল, উদ্ভাবন ও তথ্য ভিত্তি গড়ে তোলা চ) ডিজিটাল পদ্ধতিতে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানসহ কৃষি, শিল্প স্থাপন, বাণিজ্য এবং অর্থনীতির ভিত্তি ডিজিটাল করা। এসব কৌশলাদি বাস্তবায়নে কেবলমাত্র আর্থিক লেনদেনে আমাদের অর্জন উল্লেখযোগ্য। বাকি ক্ষেত্রগুলোতে আমরা এখনও যাত্রাই শুরু করতে পারিনি। বরং আমাদের শিল্প ও বাণিজ্য এনালগ যুগের। অর্থনীতির অতি নগণ্য অংশ ডিজিটাল। আমাদের চতুর্থ কৌশলটি হলো: ডিজিটাল সংযুক্তি: এই কৌশলটির জন্যও ৬টি কৌশল আমি চিহ্নিত করেছি। ক) ঘরে ঘরে ডিজিটাল সংযুক্তি প্রদান: খ) দ্রুতগতির তারের সংযোগ প্রতিষ্ঠা গ) সমন্বিত সংযুক্তি: ঘ) মাতৃভাষায় দেশীয় উপাত্ত প্রস্তুত: ঙ) নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবস্থা গড়ে তোলা : চ) শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে ইন্টারনেট প্রদান। আমাদের সংযুক্তির ক্ষেত্রটি সচল ও সজীব আছে। তবে গতিটা সম্ভবত মন্থর। ৫জি আমাদের সেই গতিটাকে দ্রুততর করে দেবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমাদের পঞ্চম কৌশলটি বস্তুত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কৌশল। এটি হলো: ডিজিটাল জীবনধারা ও জন্মের ঠিকানায় রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা: এই কৌশলটি বাস্তবায়নে আমরা ছয়টি কর্মসূচীর কথা উল্লেখ করেছি। সেগুলো হলো: ক) ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কল-কারখানা, কৃষি, স্বাস্থ্য সেবা, আইন-আদালত, সালিশ, সরকারী সেবা, হাট বাজার, জলমহাল, ভূমি ব্যবস্থাপনাসহ জীবনের সামগ্রিক কর্মকা- ডিজিটাল করতে হবে খ) মেধাশিল্প, সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন ও সেবাখাতকে প্রাধান্য দিয়ে শিল্পনীতি তৈরি করতে হবে। গ) দেশের সকল আইনকে জ্ঞানভিত্তিক সমাজের উপযোগী করতে হবে। ঘ) ডিজিটাল বৈষম্যসহ সমাজে বিরাজমান সকল বৈষম্য দূর করতে হবে এবং রাষ্ট্রকে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ও ইন্টারনেটসহ জীবনের ন্যূনতম চাহিদা পূরণের সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ঙ) ডিজিটাল বিশ্বের ডিজিটাল জীবনধারার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা। সেই ক্ষেত্রে প্রাইভেসি রক্ষা করার পাশাপাশি ডাটার নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। চ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোকে তার জন্মের অঙ্গীকারে স্থাপন করার জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার পাশাপাশি দেশকে জঙ্গীবাদ, ধর্মান্ধতা, সন্ত্রাস, রাষ্ট্রধর্র্ম ইত্যাদির হাত থেকে রক্ষা করতে হবে এবং একাত্তরের ঘোষণা অনুযায়ী দেশের নীতি ও আদর্শকে গড়ে তুলতে হবে। আমরা বৈষম্যহীন সমাজের কথা বলি। বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচীতে সেই সমাজের কথা বলেছেন। আমাদের ডিজিটাল যুগে মার্ক্স-এঙ্গেলস, লেনিন-মাও সেতুং এর সমাজতন্ত্র যে হুবহু প্রয়োগযোগ্য নয় সেটিও বুঝতে হবে। এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা : আমরা যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ ২.০ এর সময়কালে থাকব তখন জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রার সময়ও রয়েছে। আমরা লক্ষ্য করতে পারি সেই লক্ষ্যমাত্রাগুলো কি কি। ১) দারিদ্র্যহীন বিশ্ব, ২) ক্ষুধাহীন বিশ্ব, ৩) সুস্বাস্থ্য ৪) উন্নত শিক্ষা ৫) লিঙ্গ সমতা ৬) সুপেয় পানি ও স্যানিটেসন ৭) ক্রয়ক্ষমতায় থাকা বিশুদ্ধ জ্বালানি শক্তি ৮) সুকর্ম ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৯) শিল্প, উদ্ভাবন ও অবকাঠামো ১০) হ্রাসকৃত অসমতা ১১) টেকসই নগর ও সম্প্রদায় ১২) দায়িত্বশীল ভোগ ও উৎপাদন ১৩) জলবায়ু বিষয়ক কার্যক্রম ১৪) জলজ প্রাণীর জীবন ১৫) ভূমিতে বসবাসকারী প্রাণীর জীবন ১৬) শান্তি, বিচার ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ১৭) লক্ষ্য অর্জনে পারস্পরিক সহায়তা। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব: চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এর বৈশিষ্ট্যগুলোকে নিম্নরূপে বর্ণণা করা হয়েছে। ১) কর্মসংস্থান ও দক্ষতার আমূল পরিবর্তন, ২) উদ্ভাবন ও উৎপাদনশীলতা, ৩) বৈষম্য, ৪) গতিশীল প্রশাসন, ৫) নিরাপত্তা ও বিরোধ এর বিস্তৃতি, ৬) ব্যবসার আমূল পরিবর্তন, ৭) অভাবিত প্রযুক্তি এবং ৮) নৈতিকতা ও ব্যক্তি পরিচয় সঙ্কট। এই আটটি বিষয় পর্যালোচনা করলেই একদিকে যেমন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আগ্রাসন অনুভব করা যায় তেমনি এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সঙ্কটগুলোও বোঝা যায়। সেজন্যই হয়তো বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের মতো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যান্ত্রিকতা অতিক্রম করে পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের মানবিকতার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা বা শিল্পোন্নত দেশগুলোর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মাতামাতির মাঝে আকস্মিকভাবে এর নেতিবাচক দিকগুলোও আলোচনায় আসতে পারে সেটি আমি অন্তত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের কাছ থেকে আশা করিনি। ৫ম শিল্প বিপ্লব: বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম নিজেই স্বীকার করেছে যে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এতোটাই যান্ত্রিক যে মানুষের জন্য সেটি বিপজ্জনক হতে পারে। মানুষের কর্মচ্যূতির পাশাপাশি প্রযুক্তির দাপট এমনভাবেই সম্প্রসারিত হতে পারে যে মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় মানুষ একটু থমকে দাড়াতেই পারে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম যাকে পঞ্চম শিল্প বিপ্লব বলছে তার একটু বিবরণ পেশ করা যেতে পারে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম ৫ম শিল্প বিপ্লবকে মানবিক বলছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ভয়ঙ্কর দিকটা কাটিয়ে চলার বিষয়ে একাধিক আশাবাদের কথা বলা হয়েছে। ক) বাণিজ্যের ডিজিটাল রূপান্তর পুঁজিবাদী অর্থনীতিতেও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে-শিল্প কল কারখানাকে ক্রেতামুখী করবে। ৫ম শিল্প বিপ্লবের লক্ষ্যটা তাই মানুষকে তথা ক্রেতাকে বাদ দিয়ে নয়। খ) ৫ম শিল্প বিপ্লব প্রযুক্তি দিয়ে মানুষকে স্থালাভিষিক্ত না করে মানুষের জন্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করবে। জাপানের সোসাইটি ৫.০: জাপান ফেডারেশন অব বিজনেসের রূপরেখা অনুসারে সোসাইটি ৫.০ এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে- অর্থনীতি থেকে শুরু করে জাপান সমাজের সকল স্তরকে ডিজিটাল করার মাধ্যমে সমাজকে রূপান্তর করা। আমরা যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ এর কথা ভাবি তবে আমাদের লক্ষ্যও এর চাইতে অনেক বেশি সম্প্রসারিত বলে মনে হতে পারে। কাকতালীয়ভাবে আমরা এই ঘোষণাটি এক দশক আগে দিয়েছি। তবে আমাদের সঙ্গে তাদের ভাবনার কিছু পার্থক্যতো আছেই। আমার ডিজিটাল বাংলাদেশ বইটি পাঠ করলে পুরো চিত্রটা পাওয়া যাবে। জাপানের জন্য বৃদ্ধ বয়সী জনসংখ্যা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সোসাইটি ৫.০ এর প্রবক্তারা মনে করেন যে, প্রযুক্তির সক্ষমতা প্রকাশ করে স্মার্ট কর্মপন্থার ফলে কিছু সমস্যা হ্রাস করা সম্ভব। জাপান মনে করে, স্বাস্থ্যসেবা ব্যতীত অন্য চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে, অন্যান্য দেশের তুলনায় জাপানকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয় এবং দূষণের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। সেজন্য সোসাইটি ৫.০ বা সুপার স্মার্ট সোসাইটিতে বিষয়টিকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। জাপানের পঞ্চম সমাজের ছোট্ট একটা বিবরণ এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। কেইদারেনের রূপরেখায়, ৫টি পর্যায়ের সামাজিক বিবর্তন হিসেবে সোসাইটি ৫.০ চিত্রিত হয়েছে। ১) শিকারী সমাজ ২) কৃষি সমাজ ৩) শিল্প সমাজ ৪) তথ্য সমাজ ৫) সুপার স্মার্ট সমাজ বা সোসাইটি ৫.০। জাপান বিজনেস ফেডারেশন সোসাইটি ৫.০ বিষয়ে একটি রূপরেখা প্রকাশ করেছে যাতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, আমরা যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছি তার জন্য ৫টি দেয়াল ভাঙ্গার প্রয়োজন হবে। প্রকৃতপক্ষে তারা মনে করে দেয়াল ভাঙার পরে সৃষ্ট সমাজই সোসাইটি ৫.০ বা সুপার স্মার্ট সোসাইটি। শুরুতেই বলা হচ্ছে সমাজ ৫.০ এর জন্য পাঁচটি দেয়াল ভাঙতে হবে। ১) প্রথমেই তারা মনে করে যে প্রশাসন, মন্ত্রণালয় ও সরকারী অফিস সংস্থা জনগণের সঙ্গে যে দেয়াল তুলে রেখেছে সেটি ভাঙতে হবে। ২) জাপানের পঞ্চম সমাজের দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটা হলো আইনের দেয়াল ভাঙ্গা। ৩) সমাজ ৫.০ এর তৃতীয় দেয়ালটা হলো প্রযুক্তির দেয়াল। নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করা ও সমাজের বিবর্তনে একে কাজে লাগানো হচ্ছে এই দেয়ালটা ভাঙ্গা। ৪) মানব সম্পদ উন্নয়নবিষয়ক দেয়ালটা চতুর্থ দেয়াল। ৫) পঞ্চম দেয়ালটি হচ্ছে পঞ্চম সমাজকে সমাজের সকল মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করা। জাপান চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে অংশ নিতে শুরু করায় তার সমাজ ও উৎপাদন ব্যবস্থায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, আইওটি, বিগ ডাটা ইত্যাদি প্রযুক্তি দেশটির রূপান্তরে একটি নতুন ভূমিকা পালন করছে এবং শিল্প উৎপাদন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ ২.০ এর কৌশল ও কর্মসূচী প্রণয়নে আমাদের তাই ডিজিটাল বাংলাদেশ ১.০, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, পঞ্চম শিল্প বিপ্লব ও সোসাইটি ৫.০ এর সামগ্রিক বিষয়াদির পাশাপাশি জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে। ঢাকা, ১২ ডিসেম্বর ১৯ ॥ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কী-বোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক [email protected]
×