ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী রাও ফরমান আলী

প্রকাশিত: ১১:২১, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯

বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী রাও ফরমান আলী

রাজন ভট্টাচার্য ॥ স্বাধীনতার পর ‘বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন’ গঠিত হয়। ওই কমিশনের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায়, পাকিস্তানী মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী শুধু ডিসেম্বরেই ২০ হাজার বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। ঘাতকদের নেতৃত্বে ছিলেন চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খান। মঈনুদ্দিন বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে তাদের হত্যা কার্যকর করার পরিকল্পনা করেন। আশরাফুজ্জামান বুদ্ধিজীবীদের মৃত্যু কার্যকর করেন। পরে তাদের লাশ রায়েরবাজার বধ্যভূমিসহ বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেয়া হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর আশরাফুজ্জামানের নাখালপাড়ার বাসা থেকে একটি ডায়েরি জব্দ করা হয়। ওই ডায়েরিতে যেসব বুদ্ধিজীবীর নাম-ঠিকানা পাওয়া যায় তাদের সবাইকে ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করা হয়। রায়েরবাজার ও মিরপুরের শিয়ালবাড়ী বধ্যভূমিতে কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে নিজ হাতে আশরাফুজ্জামান হত্যা করেন বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়। ১৯৮৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর ২৫০ জনের তালিকা নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। যে ২৫০ শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম সংগ্রহ করা হয় তাদের অনেকেরই আবাসিক ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে কিছু শহীদ বুদ্ধিজীবীর বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। কোষগ্রন্থের নাম-ঠিকানা ধরে খোঁজ-খবর নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কয়েকজনের নিকটাত্মীয়ের লেখা সংকলিত করে ১৯৮৮ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে ‘স্মৃতি-৭১’ গ্রন্থ। ‘স্মৃতি-৭১’ গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপক সাড়া জাগায় এবং কোষগ্রন্থে প্রকাশিত তালিকার বাইরে অনেক শহীদ বুদ্ধিজীবীর আত্মীয়স্বজন তাদের তথ্য নিয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে বাংলা একাডেমির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ পর্যায়ে এসে কোষগ্রন্থের তালিকাসহ মোট প্রায় ৩২৫ জনের মতো শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম বাংলা একাডেমির হাতে আসে। পরে একের পর এক ‘স্মৃতি-৭১’ প্রকাশিত হতে থাকে। এ গ্রন্থের দশম খ- প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালের ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। দশম খ- পর্যন্ত বাংলা একাডেমি ২৩৮ শহীদ বুদ্ধিজীবীর আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবের লেখা স্মৃতিকথা প্রকাশ করে। এর বাইরে বাংলা একাডেমি আর কোন তালিকা সংগ্রহ বা প্রকাশ করতে পারেনি। সরকার কয়েক দফা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করার চেষ্টা করে তা সম্পন্ন করা যায়নি। খেলাঘরের গণহত্যার প্রতিকৃতি ॥ ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা প্রসঙ্গে ১৯৭১ সালের ২৪ ডিসেম্বর সাপ্তাহিক ‘বাংলাদেশ’ এর বুলেটিনে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ২৫০ বুদ্ধিজীবী হত্যার কথা। সকল তথ্য উপাত্ত ও প্রমাণ বলছে, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানীদের বড় রকমের নীল নক্সার শিকার হয়েছেন। সেই বীর সন্তানদের স্মরণ করতে প্রতিবছরের মতো এবারও রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে জাতীয় শিশু কিশোর সংগঠন কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর ‘গণহত্যার প্রতিকৃতি’ তুলে ধরে। প্রতীকী এই বধ্যভূমির আয়োজন করা হয় চন্দ্রালোক, সূর্যালোক ও ঘাসফুল খেলাঘর আসরের পক্ষ থেকে। তিন শাখা আসরের ৩০ শিশু কিশোর গণহত্যার প্রতিকৃতিতে অংশ নেয়। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকার বিভিন্ন বাসা থেকে যেসব বীর সন্তানদের তুলে নেয়া হয়েছিল তাদের অনেকের লাশ পাওয়া গিয়েছিল রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে। অসংখ্য লাশের ভিড়ে কেউ নিজের স্বজনকে খোঁজে পেয়েছিলেন, কেউ পাননি। লাশ বিকৃত হয়ে যাওয়ায় অনেকে স্বজনকে চিনতেও পারেননি। বেশকিছু লাশ কুকুর খেয়ে ফেলেছিল। ১৪ ডিসেম্বর দেশের বীর সন্তানদের হত্যার ভয়াল সেই স্মৃতির সাক্ষী এই রায়ের বাজার। তাই বধ্যভূমির সে সময়ের দুঃসহ স্মৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে খেলাঘর এই স্থানটিতে গণহত্যার প্রতিকৃতির জন্য বেছে নেয়। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও দেশীয় দোসরদের নির্মম অত্যাচারে ক্ষত-বিক্ষত শরীর। বস্ত্রহীন দেহ। গায়ে অসংখ্য গুলির চিহ্ন। কালো দাগ। অবিরাম রক্ত ঝড়ছে। তুলে নেয়া হয়েছে চোখ। বিকৃত করা হয়েছে মুখম-ল। কেউ আহত অবস্থায় কাতরাচ্ছেন। চিৎকার করছেন। বাঁচার আকুতি জানাচ্ছেন। রক্তে ভিজে ওঠছে মাটি। শিশুদের করা গণহত্যার প্রতিচিত্রে ১৯৭১ সালের বধ্যভূমির এ রকম দৃশ্য তুলে ধরা হয়। যা জীবন্ত হয়ে দর্শকদের কাছে ফুটে ওঠেছিল। হাজারো দর্শক তা উপভোগ করেন। পাকিস্তানীদের এ রকম বর্বরতা দেখে অনেকে ধিক্কার দেন। শিহরে ওঠেন। ইতিহাস জানার চেষ্টা করেন নতুন প্রজন্মের অনেকই। কেউ কেউ ডুকরে কেঁদে ওঠেন ঘটনা জানার পরই। মনের অজান্তেই দু’চোখ বেয়ে ঝড়ে পড়ে অশ্রু। সকাল সাতটায় রায়ের বাজারে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে খেলাঘরের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা করা। এরপর স্মৃতিসৌধ চত্বরে একাত্তরের বধ্যভূমির হৃদয়স্পর্শী প্রতীকী ডিসপ্লে উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এ্যাডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি। এ সময় তিনি বলেন, পরাজয় বরণের প্রাক্কালে বাঙালী জাতিকে মেধাশূন্য করতে পাকিস্তান সরকার ও তাদের দোসর দেশীয় রাজাকারদের গভীর ষড়যন্ত্র আর নীলনক্সার বাস্তবায়নের অংশ জাতির বীর সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নির্মম হত্যাকা-। তিনি বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বর্ষে দাঁড়িয়ে আমাদের নতুন করে শপথ নিতে হবে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত রাখার। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অক্ষুণœ রাখতে খেলাঘর সংগঠনিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে। খেলাঘর আজও তাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শহীদুল্লাহ কায়সাররের লাশ খুঁজে পায়নি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন খেলাঘর সভাপতিম-লীর সদস্য আব্দুল মতিন ভূঁইয়া, সাধারণ সম্পাদক প্রণয় সাহা, সহ সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট সুনীল কুমার সরকার, সম্পাদকম-লীর সদস্য আসমা আব্বাসী উর্মি, সদস্য জলিলুর রহমান জিতুসহ খেলাঘর কর্মী সংগঠক ও ভাই-বোনরা। খেলাঘর আয়োজিত ব্যতিক্রমধর্মী অনুষ্ঠানে এসে একাত্ম হন বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। ১৩ ডিসেম্বর রাত বারোটা এক মিনিটে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও প্রদীপ প্রজ্বলন করে প্রথম প্রহরেই কেন্দ্রীয় খেলাঘর শহীদের স্মরণ করেছে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রণয় সাহা বলছিলেন, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর যেসব বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল তাদের অনেকের লাশ পাওয়া যায় রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে। তাই নতুন প্রজন্মের মধ্যে সেদিনের দৃশ্য ও বাস্তবতা তুলে ধরতে আমরা প্রতিবছর গণহত্যার প্রতিকৃতি করে থাকি। ১৯৭১ সালে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের নীল নক্সার শিকার হয়েছিলেন সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার। অন্যদের মতো তাকেও বাসা থেকে তুলে নেয়া হয়েছিল। বুদ্ধিজীবী দিবসে বীর সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রায়ের বাজারে হাজির হয়েছিলেন খেলাঘর সংগঠক ও শহীদ পরিবারের সন্তান শমী কায়সার। তিনি বলেন, যতদিন এ দেশে একজন পাকিস্তানের প্রেতাত্মা থাকবে ততদিন আমাদের প্রতিবাদ করে যেতে হবে। আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের দেশে কোন রাজাকার, আলবদর, জামায়াতসহ উগ্রবাদীদের ঠাঁই হতে পারে না। মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের হাতে তুলে দেয়া হয় শহীদুল্লা কায়সারকে ॥ পলাতক চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের ১৩তম সাক্ষী ও শহীদ সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার। জবানবন্দীতে তিনি বলেছেন, একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় খালেক মজুমদারসহ কয়েকজন তার স্বামীকে ধরে নিয়ে যায়। খালেক তার স্বামীকে মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের হাতে তুলে দেয়। জবানবন্দীতে রাষ্ট্রপক্ষের এই সাক্ষী বলেন, তার স্বামী গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ওষুধ ও অর্থ সরবরাহ করতেন। একদিন তিনি স্বামীকে বলেন, তার শিশুরা দুধ খেতে পারছে না। শহীদুল্লা কায়সার তখন সন্তানদের চাল বেটে খাওয়াতে বলেন। অথচ একদিন দেখেন, তার স্বামী বেশ কিছু টাকা একজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে তুলে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, একাত্তরের নবেম্বরের শেষদিকে স্বামী বিভিন্ন স্থানে থাকার পর আবার কায়েতটুলীর বাড়িতে মায়ের কাছে ফিরে আসেন। চারদিকে আলবদর ও রাজাকারদের অত্যাচার বেড়ে গেলে তিনি ১৩ ডিসেম্বর নিরাপত্তার জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যান। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই ফিরে আসেন। ১৪ ডিসেম্বর কারফিউ শিথিল না হওয়ায় শহীদুল্লা কায়সার বাড়িতেই থেকে যান। ওইদিন স্বামী তাকে একটি চিরকুট দেন। সেখানে লেখা ছিল, ‘পান্না, আমি যদি কোন দিন না থাকি, তাহলে তুমি সন্তানদের আমার আদর্শে মানুষ করবে। এটুকু পড়েই তিনি চিরকুটটি ছিঁড়ে ফেলে চিৎকার করে ওঠেন। বলতে বলতে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। পান্না কায়সার বলেন, ১৪ ডিসেম্বর বিকেলে বাড়ির বারান্দায় তিনি দাঁড়িয়ে দেখেন, কয়েকজন যুবক তাদের বাড়ি দেখিয়ে দিচ্ছেন। সন্ধ্যায় স্বামীর পাশে সোফায় ছয় মাস বয়সী ছেলে অমিতাভ কায়সার শুয়ে ছিল। তিনি মেঝেতে বসে দেড় বছরের মেয়ে শমী কায়সারকে ফিডারে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন। শহীদুল্লা কায়সার বলেন, মুক্তিযোদ্ধা এসেছে, দরজা খুলে দাও।’ এক-দুই মিনিট পর চার-পাঁচজন মুখবাঁধা আগন্তুক ঘরে এসে জানতে চায়, শহীদুল্লা কায়সার কে? তার স্বামী স্পষ্টভাবে নিজের পরিচয় দিলে আগন্তুকদের একজন স্বামীর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। তিনিও স্বামীর হাত ধরে টানতে থাকেন। এ অবস্থায় বারান্দায় গেলে তিনি এক হাত দিয়ে বারান্দার বাতি জ্বালান। তার ননদ সাহানা এগিয়ে এলে তারা দুজনে মিলে আগন্তুকদের একজনের মুখের কাপড় খুলে ফেলেন। পরে অস্ত্রের মুখে তার স্বামীকে কাদামাখা একটি মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যায়। পরাজয় জেনেই বুদ্ধিজীবী হত্যা ॥ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে পাকিস্তানি বাহিনী যখন বুঝতে শুরু করে তাদের পক্ষে যুদ্ধে বিজয় অর্জন করা আর সম্ভব নয়, তখন তারা বাংলাদেশকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক, শিক্ষাগত দিক থেকে দুর্বল ও পঙ্গু করে দেয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহায়তায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বাড়ি থেকে তুলে এনে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে। ইতিহাসের ঘৃণ্য এই পরিকল্পিত গণহত্যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- হিসেবে পরিচিত। যাদের বন্দী অবস্থায় বিভিন্ন বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত লাশ রায়ের বাজার এবং মিরপুরের বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। দেশের বরেণ্য এই কৃতী সন্তানদের কেউ ছিলেন শিক্ষক, কেউ সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক অথবা পেশাজীবী। তাদের অনেকের লাশ শনাক্তও করা যায়নি, পাওয়া যায়নি বহু লাশ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে এসব বুদ্ধিজীবী মেধা, মনন ও লেখনীর মাধ্যমে স্বাধীনতার সংগঠকদের প্রেরণা জুগিয়েছেন। আর সেটিই কাল হয়ে দাঁড়ায় তাদের জন্য। এসব কৃতী বুদ্ধিজীবীর তালিকা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে জামায়াতে ইসলামীর সশস্ত্র সংগঠন কুখ্যাত আলবদর ও আলশামস বাহিনী। তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে চোখ বেঁধে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ শিক্ষাবিদ, ১৩ সাংবাদিক, ৪৯ চিকিৎসক, ৪২ আইনজীবী এবং ১৬ শিল্পী, সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। এই ঘাতকেরা কেবল ঢাকায় নয়, সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ মানুষকে নৃশংসভাবে খুন করেছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তথ্যানুযায়ী, এ পর্যন্ত সারাদেশে ৪৬৭টি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। কেবল ঢাকা ও এর আশপাশে ৪৭টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে। যেখানে দখলদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ও লেখক মফিদুল হক তার এক লেখায় বলেছেন, দেশব্যাপী পরিচালিত নয় মাসের গণহত্যায় অগণিত মানুষের প্রাণদানের সীমাহীন ট্র্যাজেডিতে ভয়াবহ মাত্রা যোগ করেছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা, যার কোন সামরিক কার্যকারণ ছিল না, তবে বাঙালী জাতির বিরুদ্ধে প্রবল আক্রোশ যে এখানে ফুটে উঠেছে, সেটা বুঝতে ভুল হওয়ার অবকাশ ছিল না। অচিরেই জানা গেল দুই ঘাতকের পরিচয়। চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খান এবং হন্তারক সংগঠন, ইসলামী ছাত্রসংঘের পরীক্ষিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত আলবদর বাহিনী সম্পর্কিত কিছু তথ্য। গবর্নর হাউসে প্রশাসনের প্রধান মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর ডেস্ক ডায়েরিতে পাওয়া গেল অনেক বুদ্ধিজীবীর নাম, কারও নামের পাশে আছে ক্রসচিহ্ন, কোথাও বা লেখা বাড়ির নম্বর, অথবা কোন মন্তব্য। নোটশিটের এক জায়গায় লেখা ছিল, ক্যাপ্টেন তাহির ব্যবস্থা করবে আলবদরদের গাড়ির। বুঝতে পারা যায়, সামরিক বাহিনী ও রাজনৈতিক শক্তির যোগসাজশ, কিন্তু এর পেছনের দর্শন ও তথাকথিত ধর্মাদর্শ বিচার-বিশ্লেষণ অনেকটা থেকে যায় আড়ালে ...। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী লিখেছেন তার স্মৃতিকথা, লাহোরের জং পাবলিশার্স প্রকাশ করেছে ১৯৯২ সালে, সেখানে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- সম্পর্কে অদ্ভুত সাফাই তিনি গেয়েছেন, লিখেছেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ ছিল যে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতে ২০০ বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যবস্থা আমি করেছি। আগের সন্ধ্যায় ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয় এবং ভারতীয়রা ঢাকা শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। সত্য ঘটনা হচ্ছে, ১৭ ডিসেম্বর সকালে অনেক মৃতদেহ পাওয়া যায়। এর আগে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে, তাই এই হত্যাকা- নিশ্চয় তারা ছাড়া অন্য কেউ করেছে।’
×