ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আশরাফ-মঈনুদ্দিনকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে

প্রকাশিত: ১১:২০, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯

আশরাফ-মঈনুদ্দিনকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে

শংকর কুমার দে ॥ বুদ্ধিজীবী হত্যায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে পলাতক দুই আসামি চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে সরকার। আশরাফ-মঈনুদ্দিন ১৮ বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত। একাত্তরে বাঙালী জাতিকে মেধাশূন্য করার নীলনক্সা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেয় এই দুই বদর নেতা। তাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আদালত। জামায়াতে ইসলামীর তখনকার সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় নেতা ছিল এই দুইজন। ছয় বছর আগে ২০১৩ সালে তাদের অনুপস্থিতিতেই মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের পর ৪৮ বছর ধরে পলাতক এই দুই বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী। আইনী জটিলতার কারণে তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব না হওয়ায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের দায়ে মৃত্যুদ- দেয়ার ৬ বছর পরও তাদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা যায়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়জন শিক্ষক, ছয়জন সাংবাদিক ও তিনজন চিকিৎসকসহ ১৮ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যা করার নেতৃত্ব দেন আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মঈনুদ্দিন। পলাতক আশরাফুজ্জামান বর্তমানে আছেন যুক্তরাষ্ট্রে, আর মঈনুদ্দিন যুক্তরাজ্যে। ২০১৩ সালে তাদের অনুপস্থিতিতেই মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল-২ রবিবার জনাকীর্ণ আদালতে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বাধীন আদালত। মানবতাবিরোধী অপরাধের ১১টি অভিযোগের সবগুলোতেই দুই আসামির সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ হওয়ায় ‘আমৃত্যু ফাঁসিতে ঝুলিয়ে’ তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকার করার নির্দেশ দেন বিচারক। ট্রাইব্যুনাল প্রধান বলেন, ‘আমরা ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই মত দিচ্ছি, আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মঈনুদ্দিনের সর্বোচ্চ শাস্তির আদেশ না দিলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে না। চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খান আশরাফুজ্জামান ও মঈনুদ্দিন ১৯৭১ সালের ১১ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে কীভাবে আল বদর সদস্যদের নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ ও হত্যার পর বধ্যভূমিতে লাশ গুম করেছিলেন, তা উঠে এসেছে এই রায়ে। আশরাফুজ্জামান খান ছিলেন সেই হত্যাকাণ্ডের ‘চীফ এক্সিকিউটর’। আর চৌধুরী মঈনুদ্দিন ছিলেন সেই পরিকল্পনার ‘অপারেশন ইনচার্জ’। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশরাফুজ্জামানের নাখালপাড়ার বাসা থেকে উদ্ধার করা তার ব্যক্তিগত দিনপঞ্জিতে এই হত্যা পরিকল্পনা ও একটি তালিকাও পাওয়া যায়। আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মঈনুদ্দিন এ দুই বদর নেতা ও তাদের সহযোগীদের হাতে নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ড. সিরাজুল হক খান, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য্য। সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন, সৈয়দ নাজমুল হক, এএনএম গোলাম মুস্তাফা, নাজিম উদ্দিন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, শহীদুল্লাহ কায়সার এবং চিকিৎসক মোঃ মর্তুজা, মোঃ ফজলে রাব্বি ও আলিম চৌধুরীকেও হত্যার পর গুম করে তারা। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছে, এখন আসামিদের ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকর করতে হবে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামীর প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের আগের রায়গুলোর মতো এবারো বিচারকদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। আদালত বলেছে, সেই সময় জামায়াতে ইসলামী একটি ফ্যাসিস্ট সংগঠন হিসেবে কাজ করেছে। ‘কিলিং স্কোয়াড’ আল বদরের নিয়ন্ত্রণ সে সময় জামায়াতের হাতেই ছিল। এটা প্রমাণ হয়েছে যে, ফ্যাসিস্ট জামায়াতে ইসলামীর সংঘটিত মহাপরিকল্পনার আলোকেই সে সময় আল বদর বাহিনীকে নামানো হয়। বাঙালী জাতিকে প্যারালাইজড করতে তারা বুদ্ধিজীবী-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিহীন করতে চেয়েছিল। কে এই চৌধুরী মঈনুদ্দিন চৌধুরী মঈনুদ্দিনের জন্ম ১৯৪৮ সালের নবেম্বরে, ফেনীর দাগনভূঞা থানার চাঁনপুর গ্রামে। তার বাবার নাম দেলোয়ার হোসাইন। একাত্তরে মঈনুদ্দিন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্র। দৈনিক পূর্বদেশের নিজস্ব প্রতিবেদক হিসাবেও তিনি কাজ করেছেন। মামলার নথিপত্র অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে মঈনুদ্দিন ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তখনকার সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের একজন কেন্দ্রীয় নেতা এবং রাজাকার বাহিনীর সদস্য। সেই হিসাবে পাকিস্তানী হানাদারদের সহযোগিতার জন্য গড়ে তোলা আলবদর বাহিনীতেও তাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়। যুদ্ধের শেষভাগে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মঈনুদ্দিন পালিয়ে পাকিস্তান চলে যান। সেখান থেকে যান যুক্তরাজ্যে। এখন পর্যন্ত তিনি লন্ডনেই অবস্থান করছেন। লন্ডনে জামায়াতের সংগঠন দাওয়াতুল ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি লন্ডনভিত্তিক সাপ্তাহিক দাওয়াতের বিশেষ সম্পাদকের দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন। মঈনুদ্দিন ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের একজন পরিচালক, মুসলিম এইডের ট্রাস্টি এবং টটেনহ্যাম মসজিদ পর্যদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন। একাত্তরে পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে থাকার কথা নিজের ওয়েবসাইটে দেয়া বিবৃতিতে স্বীকারও করেছেন মঈনুদ্দিন। আশরাফুজ্জামান খানের পরিচয় আশরাফুজ্জামান খানের জন্ম ১৯৪৮ সালে, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের চিলেরপাড় গ্রামে। বাবার নাম আজহার আলী খান। ১৯৬৭ সালে সিদ্ধেশ্বরী ডিগ্রী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর আশরাফুজ্জামান ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী স্টাডিজ বিভাগে। ওই বিভাগ থেকেই ১৯৭০ সালে স্নাতক ডিগ্রী পান ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় নেতা আশরাফুজ্জামান। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা আল বদর বাহিনীকে নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব আশরাফুজ্জামানের ওপর বর্তায়। বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী এবং বাস্তবায়নকারী নেতা হিসাবেও তাকে অভিযুক্ত করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি পালিয়ে পাকিস্তানে চলে যান এবং কিছুদিন রেডিও পাকিস্তানে কাজ করেন। পরে সেখান থেকে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। বর্তমানে আশরাফুজ্জামান খানের ঠিকানা নিউইয়র্কের জ্যামাইকা। ইসলামিক সার্কেল অব নর্থ আমেরিকার সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। দুই আলবদরকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। শনিবার শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে জাতির সূর্য সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে এ কথা বলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার হোতা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানকে আইনী জটিলতার কারণে তাদের ফেরত নিয়ে আসা যাচ্ছে না। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পলাতক দুই বদর নেতাকে দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করার চেষ্টা চলছে বলে জানান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী।
×