ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দীপংকর গৌতম

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও রায়েরবাজার

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও রায়েরবাজার

রায়েরবাজার মনে করতেই চোখের গহীনে ভেসে ওঠে একটা ছবি। খালের মতো স্থির জলাভূমি। পাশে ইটের স্তূপ। তার মধ্যে পাশে পড়ে আছে হাত বাঁধা চোখ বাঁধা অনেক মানুষ। এরা ছিল দেশের সূর্য সন্তান। অসম মেধাবী এসব মানুষকে এখানে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। সবার পোশাকে বোঝা যায় বাসায় যে ভাবে ছিল তাকে সেভাবে তুলে আনা হয়েছে। সেইসব সূর্য সন্তানদের পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে আরেকটি বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে-সেটা হলো এসব সূর্য সন্তানদের বেশ আগে থেকেই লক্ষ্য করা হতো। তাদের ১০ ডিসেম্বর থেকে তুলে নেয়া শুরু হয়। তাদের আল-বদর বা পাকিস্তানী বর্বর বাহিনী তুলে নেয়ার সময় ওই পরিবারগুলো জেনেছিল কারা তাদের ধরিয়ে দিল। আবার এমন হয়েছে ধরে নেয়ার পরে কোন আল-বদর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে হয়ত তার পরিবার গিয়েছে, অমনি ওই ব্যক্তি বলেছে , ওরা কেন নিয়ে যেত জানি না, তবে বাসায় যান ফিরে আসবে। আর ফিরে আসেনি । দেশবরেণ্য চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ আলীম চৌধুরীর বাসার নিচে থাকতেন মাওলানা মান্নান। সব সময় তার দরজা খোলা থাকত। কিন্তু ডাঃ আলীম চৌধুরীকে যেদিন ধরে নিয়ে যাওয়া হয় সেদিন দরজা বন্ধ ছিল। শত করাঘাতেও দরজা খোলেনি। শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দীন হোসেনকে ১০ ডিসেম্বর রাত সাড়ে তিনটায় ধরে নিয়ে যায় পাক হানাদার ও তাদের দোসররা। তাকে পাঞ্জাবি পরার সুযোগও দেয়া হয়নি। দেশের সূর্য সন্তানদের অনেকের লাশ পাওয়া গিয়েছিল রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। তাদের লাশ দেখে একান্ত কাছের লোক ছাড়া শনাক্ত করা সম্ভব ছিল না। বুদ্ধিজীবী হত্যায় জামায়াতে ইসলামীর সে সময়ের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ হানাদার বাহিনীর চোখ ও কান হিসেবে কাজ করেছে। মাওলানা নিজামী ছিলেন সে সময় ছাত্র সংঘের মূল নেতা। আল-বদর বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডারও ছিলেন তিনি। জামায়াত নেতা মুজাহিদ, কামারুজ্জামান ছিলেন ঘাতক আল-বদর বাহিনীর কমান্ডে। এ বাহিনীর সদস্যরা বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে নিয়ে যেত নির্যাতন ক্যাম্পে। যেখানে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হতো। সারা দেহ ক্ষত-বিক্ষত করে আনন্দ পেত আল-বদর নামের নব্য ড্রাকুলারা। একটি জাতিকে অন্ধ করে দেয়ার জন্য পাকিস্তানী জানোয়াররা সিদ্ধান্ত নেয় জাতিকে বুদ্ধিজীবী শূন্য করে দেয়ার। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় নিরীহ জনগণের ওপর পাকবাহিনীর আক্রমণের সময় থেকেই শুরু হয় বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ। পাকিস্তানী সেনারা তাদের অপারেশন সার্চলাইট কর্মসূচীর আওতায় চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে বের করে হত্যা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে ২৫ মার্চ রাতেই হত্যা করা হয়। তবে বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের বেশ কয়েকদিন আগে বিশেষত ঢাকা শহর ভয়াবহ রূপ নেয়। ১৪ ডিসেম্বর রাতে ঢাকায় দুই শ’রও বেশি বুদ্ধিজীবীকে তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে নেয়া হয় এবং জানা যায় ওই রাতে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতেই হত্যা করা হয় প্রায় দুই হাজার মানুষকে। ঢাকায় এ হত্যাকা- শুরু হয় এবং ক্রমে ক্রমে তা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে, বিশেষত জেলা ও মহকুমা শহরে সম্প্রসারিত হয়। হত্যাকারীরা চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের তাঁদের নিজ নিজ বাড়ি থেকে বিভিন্ন কায়দায় তুলে নিয়ে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে কোন বিশেষ নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যেত। এসব নির্যাতন কেন্দ্র ছিল মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগ, ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (মোহাম্মদপুর) এবং শহরের অন্যান্য এলাকায়। বেশিরভাগ সময় তারা শহরে জারিকৃত কারফিউ-এর সুযোগে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যেত। তাঁদের ওপর চলত নির্মম দৈহিক নির্যাতন। তারপর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেয়নেটের আঘাতে তাঁদের দেহ ক্ষতিবিক্ষত করে হত্যা করা হতো। ঢাকা শহরের প্রধান প্রধান বধ্যভূমি ছিল আলেকদি, কালাপানি, জল্লাদখানা, রাইনখোলা, মিরপুর বাংলা কলেজের পশ্চাদভাগ, হরিরামপুর গোরস্তান, মিরপুরের শিয়ালবাড়ি, মোহাম্মদপুর থানার পূর্বপ্রান্ত ও রায়েরবাজার। রায়েরবাজার ও মিরপুরের জলাভূমিতে ডোবানালা, নিচু জমি ও ইটের পাঁজার মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের বহুসংখ্যক মৃতদেহ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। কালো কাপড়ে চোখ বাঁধা এবং পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় ক্ষতবিক্ষত এই লাশগুলোর অধিকাংশেরই দেহ ফুলে উঠেছিল। তাঁদের বুকে মাথায় ও পিঠে ছিল বুলেটের আঘাত এবং সারাদেহে বেয়নেটের ক্ষতচিহ্ন। এঁদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ৯ জন সাহিত্যিক ও শিল্পী, ৫ জন প্রকৌশলী, এবং অন্যান্য ২ জন। এই পরিকল্পিত গণহত্যাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- নামে পরিচিত। বন্দী অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষতবিক্ষত ও বিকৃত লাশ রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। অনেকের লাশ শনাক্তও করা যায়নি, পাওয়াও যায়নি বহু লাশ। পাকিস্তানী সামরিক জান্তার পক্ষে এ হত্যাকা-ের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। আর তাকে তালিকা প্রস্তুতিতে সহযোগিতা ও হত্যাকা- বাস্তবায়নের পেছনে ছিল মূলত জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক গঠিত কুখ্যাত আল-বদর বাহিনী। বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান ঘাতক ছিল বদর বাহিনীর চৌধুরী মঈনুদ্দীন (অপারেশন ইনচার্জ) ও আশরাফুজ্জামান খান (প্রধান জল্লাদ)। ১৬ ডিসেম্বরের পর আশরাফুজ্জামান খানের নাখালপাড়ার বাড়ি থেকে তার একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি উদ্ধার করা হয়, যার দুটি পৃষ্ঠায় প্রায় ২০ জন বুদ্ধিজীবীর নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কোয়ার্টার নম্বরসহ লেখা ছিল। তার গাড়ির ড্রাইভার মফিজুদ্দিনের দেয়া সাক্ষ্য অনুযায়ী রায়েরবাজারের বিল ও মিরপুরের শিয়ালবাড়ি বদ্ধভূমি হতে বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর গলিত লাশ পাওয়া যায় যাদের সে নিজ হাতে গুলি করে মেরেছিল। আর চৌধুরী মঈনুদ্দীন ’৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিল। বুদ্ধিজীবীদের গতিবিধি দেখার জন্য তাকে পূর্বদেশ পত্রিকায় চাকরি দেয়া হয়েছিল। যে কারণে সে অবজারভার ভবন হতে বুদ্ধিজীবীদের নাম ঠিকানা রাও ফরমান আলী ও ব্রিগেডিয়ার বশীর আহমেদকে পৌঁছে দিত। এছাড়া আরও ছিলেন এবিএম খালেক মজুমদার (শহীদুল্লাহ কায়সারের হত্যাকারী), মাওলানা আবদুল মান্নান (ডাঃ আলীম চৌধুরীর হত্যাকারী), আবদুল কাদের মোল্লা (কবি মেহেরুন্নেসার হত্যাকারী) প্রমুখ। চট্টগ্রামে প্রধান হত্যাকারী ছিলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী ও তার দুই ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং গিয়াস কাদের চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বধ্যভূমির একটি বর্ণনা শুনলে শরীর হিম হয়ে আসে ‘পাশে দুটো লাশ, তার একটির হৃৎপি- কে যেন ছিঁড়ে নিয়েছে। সেই হৃৎপি- ছেঁড়া মানুষটিই হলো ড. রাব্বী। ড. রাব্বীর লাশটা তখনও তাজা। জল্লাদ বাহিনী বুকের ভেতর থেকে কলিজাটা তুলে নিয়েছে। তারা জানত যে তিনি চিকিৎসক ছিলেন। তাই তার হৃৎপি-টা ছিঁড়ে ফেলেছে।’ এমনি আরও অজস্র লোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। এই ঘাতক দালালচক্র দেশের সঙ্গে, স্বজনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার চূড়ান্ত ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে নিজেদের তৈরি করে নিয়েছে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম জায়গায়। জাতিকে মেধাশূন্য করার যে প্রক্রিয়া একাত্তরের ঘাতকচক্র শুরু করেছিল তাদের উত্তরসূরিরাও একই উদ্দেশ্যে এই দেশের নতুন প্রজন্মের কাছে নানা ভুল তথ্য, ভুল ইতিহাস পরিবেশন করে যাচ্ছে যাতে করে এদেশের মানুষ ও প্রজন্মের পর প্রজন্ম একটা বিভ্রান্ত জাতিতে পরিণত হয়। এই ঘাতক দালালদের সম্পূর্ণরূপে নির্মূল ও এই রক্তাক্ত ইতিহাস পাঠ্যক্রমে বিস্তারিতভাবে সংযোজন করা না হলে জাতির সামনে আরও ভয়াবহ সময় আসবে এতে কোন ভুল নেই। লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক
×