ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড ছিল হিটলারের গ্যাস চেম্বারের চেয়ে ভয়ঙ্কর

প্রকাশিত: ১০:৩৭, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯

  বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড ছিল হিটলারের গ্যাস চেম্বারের চেয়ে ভয়ঙ্কর

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর বিজয় যখন চূড়ান্ত তখন একে একে বিভিন্ন জেলা থেকে আসছিল বিজয়ের খবর, ঠিক সেই সময় পরাজয় নিশ্চিত জেনে নতুন জাতি যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে তারই ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার আলবদর। শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ দেশের মেধাবী সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার ৪২ বছর পর বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার হয়েছে। প্রথম রায়টি আসে আলবদর বাহিনীর নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের মামলায়। এরপর একে একে বুদ্ধিজীবী হত্যায় আরও চার জনের বিচার হয়েছে। যাদের বিচার হয়েছে তারা হলেন, জামায়েতের আমীর মতিউর রহমান নিজামী, জামায়তের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারুল ইসলাম, আলবদর বাহিনীর অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মাঈনুদ্দিন এবং চীফ এক্সিকিউটর মোঃ আশরাফুজ্জামান খান, এদের মধ্যে মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহাসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়েছে। হিটলারের গ্যাস চেম্বারের গণহত্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল বর্বর পাকিস্তানীদের হাতে সংগঠিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড। বুদ্ধিজীবী হত্যা ট্রাইব্যুনালের রায়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে ২০১৫ সালের ২২ নবেম্বর আর জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীকে ২০১৬ সালের ১৫ মে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। আর জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারুল ইসলামকে চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদন্ড বহাল রাখে আপীল বিভাগ। অন্যদিকে পলাতক আলবদর বাহিনীর অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মাঈনুদ্দিন এবং চীফ এক্সিকিউটর মোঃ আশরাফুজ্জামান খান পতালক থাকায় ট্রাইব্যুনালের রায়ই বহাল রয়েছে। ৩০ লাখ শহীদের মধ্যে ‘বাংলাপিডিয়া’র প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী শিক্ষাবিদ ৯৯১, চিকিৎক ৪৯, আইনজীবী ৪২, সাংবাদিক ১৩, সাহিত্যিক ও শিল্পী ৯, প্রকৌশলী ৫ এবং অন্যান্য ২ জন। সব মিলিয়ে এই তালিকায় নিহত বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা এক হাজার এক শ’ ১১ জন। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহাসান মুহাম্মদ মুজাতিদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ বলা হয়েছে, একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর চামেলীবাগ থেকে ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে অপহরণ করা হয়। আসামির পরিচালনাধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন ৭/৮ যুবক তাকে ধরে মিনিবাসে তুলে নেয়। আজ অবধি তার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর ৩(২) (এ) (জি) এবং ৪(১), ৪(২) ধারায় বর্ণিত অপরাধ। ওই সময় সিরাজউদ্দিন হোসেন দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে নিজ পত্রিকায় ভাষ্যকার পরিচয়ে ‘ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়’ শিরোনামে এক প্রবন্ধ লিখে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর এদেশীয় এজেন্টদের বাংলাদেশের নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপর হয়রানির চিত্র তুলে ধরেন। উক্ত প্রবন্ধ প্রকাশের পর জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখে ‘অতএব ঠগ বাছিও না’ শিরোনামে পাল্টা প্রবন্ধ ছাপা হয়। ওই প্রবন্ধে সিরাজউদ্দিন হোসেনকে ‘ভারতের দালাল’ হিসেবে সমালোচনা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর রাতে আনুমানিক ৩টার সময় তার ৫ নম্বর চামেলীবাগের ভাড়া করা বাসায় ৭/৮ রাইফেলধারী যুবক ঢুকে পড়ে। তাকে তারা নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। লাশেরও সন্ধান পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় অভিযোগের মধ্যে রয়েছে ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট রাত ৮টায় পূর্বপাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি আসামি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামীসহ ঢাকার নাখালপাড়ার পুরাতন এমপি হোস্টেলের আর্মি ক্যাম্পে যায়। সেখানে তারা আটক সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহিরউদ্দ্নি জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল ও আজাদকে দেখে তাদের গালিগালাজ করে এবং পাকিস্তানী আর্মি ক্যাপ্টেনকে বলে যে, প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আদেশের পূর্বেই তাদরেকে হত্যা করতে হবে। আসামি অন্যান্যের সহায়তায় আটকদের একজনকে ব্যতীত অন্য নিরীহ-নিরস্ত্র বন্দীদের অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ গুমের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে। একাত্তরের ২৭ মার্চের পর ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প তৈরি করে। পরবর্তীতে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তারাও উক্ত স্থানে ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ গ্রহণসহ অপরাধজনক নানা কার্যক্রম চালায়। আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি হবার সুবাদে আর্মি ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। ট্রাইব্যুনালে যুক্তিতর্কে প্রসিকিউটর বৃন্দ বলেছিলেন, মুজাহিদ মুক্তিযুদ্ধে খলনায়কোচিত বীরত্ব ও নেতৃত্বের পথিকৃৎ ছিলেন। মুজাহিদ মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদর বাহিনীকে আজরাইলের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন এবং মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের প্রাক্কালে তার নির্দেশে বাংলার সূর্য সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। মুজাহিদ ছিলেন আল-বদরদের নেতৃত্বের জায়গায়। একাত্তর সালে দেশের যে সব জায়গায় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তার সব জায়গাই মুজাহিদ উপস্থিত ছিলেন। তিনি বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নক্সায় ছিলেন। পাকিস্তান আর্মিদের সঙ্গে সর্বত্র ছিলেন। তিনি আলোকবর্তিকা হিসেবে অক্সিজেনের ভূমিকা পালন করেছেন। মুজাহিদ তার বাহিনী দ্বারা সেই দায়িত্বই পালন করেছেন। ‘মুজাহিদ সরাসরি কারও গায়ে হাত না তুললেও তিনি এমন একটা সময়ে এমন একটা দলের নেতৃত্বে ছিলেন যার মাধ্যমে তিনি এসব অপরাধ সংঘটিত করেছেন। মুজাহিদ আলবদর বাহিনী গঠন করেছেন, তাদের ট্রেনিং দিয়েছেন এবং নিজে উপস্থিত থেকে আলবদর সদস্যদের উৎসাহ যুগিয়েছেন। বুদ্ধিজীবী হত্যা ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মুজাহিদের বিরুদ্ধে প্রথম রায ঘোষণা করেন। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহাসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- প্রদান করেন। আপীলেও তার মৃত্যুদ- বহাল থাকে। অবশেষে তার দন্ডকার্যকর করা হয়। ট্রাইব্যুনালে দ্বিতীয় রায়টি আসে চৌধুরী মাঈনুদ্দীন এবং মোঃ আশরাফুজ্জামান খান। ২০১৩ সালের ৩ নবেম্বর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ তাদের দুই জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- প্রদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে পলাতক আলবদর বাহিনীর অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মাঈনুদ্দিন এবং চীফ এক্সিকিউটর মোঃ আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর সাংবাদিক সিরাজউদ্দিনকে রাত তিনটা/সাড়ে তিনটার সময় ৫নং চামেলীবাগ বাসা থেকে তাদের নেতৃত্বে ৭/৮ অস্ত্রধারী তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তার লাশের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। এছাড়া ১১ ডিসেম্বর সাংবাদিক সৈয়দ নাজমুল হক ৪টা সাড়ে ৪টার দিকে ৮/১০ অস্ত্রধারী সৈয়দ নাজমুল হককে ৯০ পুরানা পল্টন বাসা থেকে অপহরণ করে হত্যা করে। এ ছাড়া আ ন ম গোলাম মোস্তফা, সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ সাহিত্যিক সেলিনা পারভীন, বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন, অধ্যপাক সিরাজুল হক, অধ্যাপক ডাঃ মোঃ মুর্তজা, অধ্যাপক ড. ফয়জুল মহি, অধ্যাপক ড. রশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্যকে হত্যার সঙ্গে এরা দু’জন জড়িত। ১৪ ডিসেম্বর অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী তারপর তাকে নিয়ে হত্যা করে লাশ গুম করা হয়। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার ডাঃ ফজলে রাব্বী, ডাঃ আলিম চৌধুরী হত্যার পিছনে হাত ছিল চৌধুরী মাঈনুদ্দীন এবং মোঃ আশরাফুজ্জামান খানের। তৃতীয় রায়টি আসে জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীর মামলায়। ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মতিউর রহমানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- প্রদান করেন। আপীল বিভাগ তার দ- বহাল রাখে। পরে তার দন্ডও কার্যকর করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, জামায়াতের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন। ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী, যা প্রথমে জামায়াত ইসলামীর প্রাইভেট বাহিনী হিসেবে গঠিত হয়। যার প্রধান ছিলেন মাতিউর রহমান নিজামী। উক্ত বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্য শান্তি কমিটির ও ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্য যারা পরবর্তীতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে সংঘটিত অপরাধে সরাসরি জড়িত ছিলেন। যা ক্রাইম অব জেনোসাইট। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রেসিডেন্ট ও আলবদরের প্রধান হিসেবে বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বুদ্ধিজীবী হত্যায় চতুর্থ রায় আসে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহরুল ইসলামের মামলায়। ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এটিএম আজাহারুল ইসলামকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। তার রিরুদ্ধে অভিযোগ, একাত্তরের ৩০ এপ্রিল রংপুর কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক কালাচাঁন রায় ও তার স্ত্রী মঞ্জুশ্রী রায়, সুনীল বরণ চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ অধিকারী ও চিত্তরঞ্জন রায়কে পাকিস্তানী সেনারা দমদমা সেতুর কাছে নিয়ে হত্যা করে। শিক্ষকদের ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আজহারুল ইসলামকে পাকিস্তানী সেনাদের গাড়ির পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখা গেছে। আটককৃত অধ্যাপক চ্ত্তিরঞ্জন রায়, অধ্যাপক সুনীল বরণ চক্রবর্তী, অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী, অধ্যাপক কালাচাঁন রায় ও তার স্ত্রী মঞ্জুশ্রীকে দমদমা ব্রিজের কাছে নিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়।
×