ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চীনা নাগরিক জে জিয়াং ফিকে খুনের নেপথ্যে পাওনা টাকা!

প্রকাশিত: ১০:১২, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯

  চীনা নাগরিক জে জিয়াং ফিকে খুনের নেপথ্যে পাওনা টাকা!

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ব্যবসায়িক বিরোধ ও পাওনা টাকার জেরে জে জিয়াং ফিকে নামের চীনা নাগরিক খুনের ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা পুলিশের। নিহত চীনা নাগরিক বড় মাপের ব্যবসায়ী হলেও, তার লেনদেন ভাল ছিল না। দেশী-বিদেশী বহু ব্যবসায়ী তার কাছে মোটা অঙ্কের টাকা পেতেন, যার মধ্যে একজনেরই আট কোটি টাকা। ওই পাওনাদারকে দীর্ঘদিন ধরে টাকা দেবে দেবে করে ঘুরাচ্ছিলেন ওই চীনা নাগরিক। হত্যাকা-ের দিন তার বাসায় মদের আসর বসা ও ধস্তাধস্তির বেশ কিছু আলামত মিলেছে। আর হত্যাকা-ের দিন তার বাসায় কে বা কারা কতজন গিয়েছিল, সে সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য মিললেও সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। বাসার সিসি ক্যামেরাও বন্ধ ছিল। আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকেও তেমন কোন তথ্য মেলেনি। হত্যাকা-ের রহস্য জানতে ইতোমধ্যেই নিহত চীনা নাগরিকের দেশী-বিদেশী একাধিক ব্যবসায়িক পার্টনার ও এক চীনা নারী বান্ধবীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ওই বান্ধবী নিহত চীনা নাগরিকের ব্যবসায়িক পার্টনারও ছিলেন। গত ১১ ডিসেম্বর বুধবার বেলা এগারোটার দিকে বনানীর ২৩ নম্বর সড়কের ৮২ নম্বর ৯ তলা বাড়ির পেছন থেকে মাটি খুঁড়ে জে জিয়াং ফিকে (৪৭) নামে এক চীনা নাগরিকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি ওই বাড়ির সপ্তম তলার বি নম্বর ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। ঘটনার সময় তার এক ছেলে ও এক মেয়েসহ স্ত্রী চীনে ছিল। তিনি নিজেও চীন ভ্রমণ শেষে ২৩ অক্টোবর ঢাকায় ফেরেন। নিহত চীনা নাগরিক পদ্মা সেতু ছাড়াও সরকারের বেশ কয়েকটি বড় বড় প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত। পদ্মা সেতুতে তিনি পাথর সরবরাহ করতেন। এ ঘটনায় ফ্ল্যাটের নিরাপত্তাকর্মী চালক লিফটম্যানসহ ৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মামলাটি পুলিশের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশও তদন্ত করছে। ডিবির উত্তর বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, ঘটনার সময় বাসার সিসি ক্যামেরা বন্ধ ছিল। এমনকি বাসার সামনের সিসি ক্যামেরায় কোন ফুটেজ মেলেনি। শুধু তাই নয়, ফ্ল্যাটের আশপাশের কোন সিসি ক্যামেরায় এ সংক্রান্ত কোন ফুটেজ পাওয়া যায়নি। সার্বিক পর্যালোচনায় ব্যবসায়িক বিরোধ ও আর্থিক লেনদেনের সূত্র ধরে এ হত্যাকা-টি ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। হত্যাকা-ের রহস্য জানতে নিহত চীনা ব্যবসায়ীর বাংলাদেশী ও বিদেশী ব্যবসায়িক অনেক পার্টনারের সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যেই দেশী-বিদেশী কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এরমধ্যে এক চীনা নারী যিনি একটি ব্যবসায়ে পার্টনারও তবে তাদের কাছ থেকে কি তথ্য পাওয়া গেছে, তদন্তের স্বার্থে তা তিনি প্রকাশ করেননি। ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ চক্রবর্তীও এমনটাই জানিয়েছেন। বলেন, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরেই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ ওই চীনা নাগরিক ঘটনার একদিন আগে অর্থাৎ মঙ্গলবার বিকেল চারটার দিকে বাসায় ফেরেন। পরদিন বেলা এগারোটার দিকে তার লাশ বাসার পেছনে পাওয়া যায়। তাড়াহুড়া করে হত্যার পর লাশ মাটিচাপা দেয়ায় তার পা ও চুল ছিল মাটির ওপরেই। ঘটনার তদন্তের বিষয়ে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, খুবই পরিকল্পিত হত্যাকা-। কোন ধরনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ মেলেনি। তবে নিহত চীনা নাগরিকের বাসার ভেতরে মদসহ খাওয়া দাওয়ার আসর বসার আলামত মিলেছে। এমনকি সেখানে ধস্তাধস্তিরও কিছু আলামত পাওয়া গেছে। এতে অনেকটাই নিশ্চিত যে, চীনা নাগরিককে বাসার ভেতরেই শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর লাশ বাড়ির পেছনে মাটি চাপা দেয়া হয়। এ সংক্রান্ত সব আলামত সংগ্রহের চেষ্টা অব্যাহত আছে। ওই কর্মকর্তা বলছেন, নিহত চীনা নাগরিকের বহু বাংলাদেশী ও বিদেশী ব্যবসায়িক পার্টনার থাকার তথ্য মিলেছে। তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তিনি বড় ব্যবসায়ী হলেও তার লেনদেন ভাল ছিল না। অনেক ব্যবসায়ীই তার কাছে টাকা পেতেন। বাংলাদেশের এক ব্যবসায়ী নিহত চীনা নাগরিকের কাছে পাওনা ছিল আট কোটি টাকা। দীর্ঘদিন ধরে দিচ্ছি দেব বলে ওই ব্যবসায়ীকে ঘুরাচ্ছিলেন। তবে এই হত্যার সঙ্গে আট কোটি পাওনা টাকার কোন যোগসূত্র আছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে জানার চেষ্টা চলছে। নিহত চীনা নাগরিকের কাছে শুধু বাংলাদেশী নয়, অনেক বিদেশী ব্যবসায়ীও প্রচুর টাকা পেতেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। বনানী মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, চীনা নাগরিককে তার বাসার ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে বলে সার্বিক তদন্তে মনে হচ্ছে। ব্যবসায়ী দ্বন্দ্বে এ হত্যাকান্ডটি ঘটতে পারে। বাংলাদেশের চীনা দূতাবাসকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। নিহতের স্ত্রী চীন থেকে স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকায় এসেছেন। বৃহস্পতিবার রাতেই নিহত চীন নাগরিকের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢাকা মেডিক্যালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ জনকণ্ঠকে জানান, চীনা নাগরিককে শ্বাসরোধে হত্যার করার আলামত মিলেছে। লাশ থেকে ভিসেরার আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। সংগৃহীত আলামত ল্যাবে পাঠানো হবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার পর সুনিশ্চিতভাবে বলা যাবে, চীনা নাগরিককে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে। পোস্টমর্টেমকালে সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে চীনা দূতাবাসের কর্মকর্তা, নিহতের স্ত্রী ও উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তারা। লাশ হস্তান্তর বিষয়ে এখনও কোন কিছুই আলোচনা হয়নি। নিহতের স্ত্রী চীনা দূতাবাসের সঙ্গে কথা বলে এবং দূতাবাসের তরফ থেকে এ বিষয়ে পুলিশকে জানানো হবে বলে দূতাবাস কর্মকর্তারা জানান। ততদিন পর্যন্ত লাশ হাসপাতালের হিমঘরে সংরক্ষণ করে রাখা হবে। বনানী মডেল থানার ওসি নূরে আজম মিয়া জানান, দূতাবাস কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তারা পুলিশের কাছে অবিলম্বে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে খুনীদের চিহ্নিত করে শাস্তির দাবি জানান। জাঙ শান-হং নামে নিহতের এক চীনা বন্ধু বুধবার রাতেই এ সংক্রান্ত হত্যা মামলা দায়ের করেন।
×