ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সঞ্চালন লাইন নির্মাণের ব্যর্থতায় বিলম্ব হচ্ছে

উৎপাদন শুরুর অপেক্ষায় পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্র

প্রকাশিত: ১০:১০, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯

 উৎপাদন শুরুর  অপেক্ষায়  পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্র

রশিদ মামুন ॥ নির্মাণ শেষে এখন উৎপাদনে আসার অপেক্ষায় দেশের সব থেকে বড় বিদ্যুত কেন্দ্র পায়রা। চলতি মাসে উৎপাদনে আসার লক্ষ্য নিয়ে কাজ শেষ করা হয় কেন্দ্রটির। কিন্তু পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির সঞ্চালন লাইন নির্মাণের ব্যর্থতায় কেন্দ্রটির উৎপাদনে আসা সম্ভব হয়নি। যদিও দুই দফা দিন নির্দিষ্ট করে ব্যর্থ হওয়ার পর পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি আগামী ৩১ ডিসেম্বর সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ করার কথা জানিয়েছে। দেশের সব থেকে বড় এই বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। রাষ্ট্রীয় নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির সঙ্গে চীনের ন্যাশনাল মেশিনারি এক্সপোর্ট এ্যান্ড ইমপোর্ট কর্পোরেশন (সিএমসি) যৌথভাবে কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য বিসিপিসিএল গঠন করেছে। এখন পর্যন্ত দেশের সব থেকে বড় বিদ্যুত কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ৪০০ মেগাওয়াট। সেই অর্থে পায়রা হচ্ছে দেশের সব থেকে বড় বিদ্যুত কেন্দ্র। যা নির্মাণ শেষে উৎপাদনে আসার অপেক্ষায় রয়েছে। বিপিসিপিসিএল সূত্র বলছে, ২০১৬ সালে দুই বিলিয়ন ডলার বা ১৬ হাজার কোটি টাকায় কেন্দ্রটি নির্মাণ শুরু করে। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পটির কাজ শেষ হচ্ছে। অথচ এর অনেক আগে উদ্যোগ নিয়েও বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশীপ কোম্পানি (বিআইএফপিসিএল) রামপালে কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শেষ করতে পারেনি। দুই ইউনিটের কেন্দ্রটির এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের মধ্যে প্রতিটির উৎপাদন ক্ষমতা ৬৬০ মেগাওয়াট। বিদ্যুত কেন্দ্রটির নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম খোরশেদুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, বিদ্যুত কেন্দ্রটির নির্মাণকাজের ৯৫ ভাগই শেষ হয়েছে। সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আর কিছু করার নেই। পিজিসিবি আমাদের জানিয়েছে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তারা সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ করবে। আমাদের বাকি কাজ এর পরে শুরু করতে হবে। অভিযোগ উঠেছে পিজিসিবির বিরুদ্ধে। তারা নির্ধারিত সময়ে সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ করতে না পারায় কেন্দ্রটির উদ্বোধন চলতি বছরের মধ্যে করা সম্ভব হচ্ছে না। এর আগে তারা কেন্দ্রর যন্ত্রাংশ পরীক্ষার জন্য যে লাইন তা নির্মাণও নির্ধারিত সময়ে করে দেয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত ১৩২ কেভি লাইনের কাজ শেষ হলেও আগস্ট মাসে মূল ৪০০ কেভির সঞ্চাল লাইন এখনও চালু করতে পারেনি পিজিসিবি। কেন সঞ্চালন লাইন চালু করতে দেরি হলো এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে শুরু থেকেই সঞ্চালন লাইন নির্মাণে গাফিলতি ছিল। তারা ভূমি অধিগ্রহণ এবং রিভার ক্রসিং (নদী পারাপার)সহ নানা বিষয়কে দেরির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেলেও এখানে গাফিলতি থাকার চিত্রই ফুটে উঠেছে। বারবার খোদ প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা, বিদ্যুত বিভাগের সিনিয়র সচিব তাগাদা দিলেও নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পারেনি পিজিসিবি। খবর নিয়ে জানা গেছে পিজিসির সংশ্লিষ্ট উর্ধতনরা কোন দিন মাঠে গিয়ে খবরই নেননি। কিভাবে লাইনটি নির্মাণ করা হচ্ছে। সঙ্গত কারণে লাইন নির্মাণের প্রকৃত চিত্র কোন সময় বোঝা যায়নি। পিজিসিবির কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, দেশে নির্ধারিত সময়ে কেন্দ্র নির্মাণের খুব একটা রেকর্ড নেই। সবক্ষেত্রেই কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসতে তিন মাস ছয় মাস দেরি করে। এক্ষেত্রে দেশের সব চেয়ে বড় বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণেও কিছুটা দেরি হবে স্বাভাবিকভাবে তারাও এটি ধরে নেয়াতে এই বিপত্তি ঘটেছে। তবে এখন এই কাজে জোর দেয়া হয়েছে। পিজিসিবির উর্ধতন ব্যক্তিরা সাইটে গিয়ে নির্মাণ কাজের তদারকি করছে। জানতে চাইলে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার পরই সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজে জোর দিয়েছি। আমাদের প্রধান প্রকৌশলী নির্মাণ কাজ সাইটে থেকে তদারকি করছেন। তিনি জানান, বরিশালের সন্ধ্যা নদীর দুই পাড়ে দুটি টাওয়ার নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি টাওয়ার নির্মাণ শেষ হয়েছে। অন্যটির কাজ আগামী ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। এরপর বাকি কাজ শেষ করতে আমাদের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগবে। তিনি বলেন, আমরা আশা করছি ওই দিন থেকেই আমার সেখান থেকে বিদ্যুত আনতে পারব। তবে পুরো বিদ্যুত আনার জন্য লাইনের সব কাজ শেষ করতে আমাদের আরও ১৫ দিন সময় লাড়তে পারে। তিনি বলেন, ঘুর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে আমরা কিছুটা পিছিয়ে পড়েছি। বিদ্যুত প্রকল্পর সব অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ইউনিট-১ এবং ইউনিট-২ এর টারবাইন- জেনারেটর বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। ইউনিট-১ এর বয়লার হাইড্রোটেস্ট (পানি দিয়ে কোথাও সমস্যা আছে কিনা দেখা) শেষ হয়েছে ইন্সুলেশনের (তাপ নিরোধ) কাজ শেষ হয়েছে। বয়লার-২ এর ইরেকশনের কাজ শেষ। চিমনী, জেটি, পানি সরবরাহ লাইনের কাজ শেষ হয়েছে। কোল ডোম, পানি শীতলীকরণ কেন্দ্র, পানি শোধনাগার, কনভেয়ার বেল্টের কাজ শেষ হয়েছে। বিদ্যুত কেন্দ্রটি চালানোর জন্য ইতোমধ্যে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লাও আমদানি করা হয়েছে। সরকারের আগের সব পরিকল্পনায় বলা হয়েছে পায়রা তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রর প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসবে ২০১৯ এর জুনে। আর দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসবে এর ঠিক ছয় মাস পর। সরকারের সেই ধরেই কেন্দ্রটি নির্মাণ শেষ হচ্ছিল কিন্তু সব অগ্রগতিই থামিয়ে দিয়েছে পিজিসিবি। এই পরিস্থিতিতে বিদ্যুত কেন্দ্রটি কবে নাগাদ উৎপাদনে আসবে জানতে চাইলে পায়রা তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক শাহ মোঃ গোলাম মাওলা জনকণ্ঠকে জানান, এর আগেও পিজিসিবি দুই দফা সময় দিয়েছিল। কিন্তু তারা ওই তারিখে সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ করতে পারেনি। এবার আবার ৩১ ডিসেম্বরের কথা বলা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের ৩১ ডিসেম্বর সঞ্চালন লাইন দেয়া হলে সিংকোনাইজিং (গ্রিডের সঙ্গে বিদ্যুত উৎপাদন সমন্বয়) করার কাজ শুরু করা হবে ১৫ জানুয়ারি। তিনি বলেন, বাকি থাকা টেস্টিং (পরীক্ষা) শেষ করতে আমাদের দেড় মাস সময় প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির শেষে বিদ্যুত কেন্দ্রটি পুরোদমে উৎপাদন শুরু করতে পারবে। প্রসঙ্গত কেন্দ্রটি নির্মাণে বিসিপিসিএল সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এছাড়া একই সঙ্গে পরিবেশ রক্ষায় সব ধরনের সতর্কতা মেনে চলা হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং চীন কোন কোন ক্ষেত্রে কয়লা চালিত কেন্দ্রে উন্মুক্ত অবস্থায় কয়লা রেখে দিলেও পায়রা তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র কয়লা রাখার জন্য যে কোল ইয়ার্ড নির্মাণ করেছে তা পুরোপুরি ঢাকনা যুক্ত। জাহাজ থেকে কয়লা ওঠার সময়ও ঢাকানাযুক্ত কনভেয়ার বেল্টে আনা হবে। প্রতিটি এক লাখ ৮০ হাজার টন ধারণক্ষমতার চারটি কোল ইয়ার্ড নির্মাণ করা হচ্ছে। যা দিয়ে কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্রটি ৫৭ দিনের কয়লা মজুদ রাখতে পারবে। নির্গত গ্যাস ধরতে ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজার ইউনিট (এফজিডি) নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে কেন্দ্রটির ৯৬ ভাগ ফ্লু গ্যাস ধরা হবে। বিদ্যুত উৎপাদনের পর ৯৯ দশমিক ৯ ভাগ ছাই ‘এ্যাশ হপারে’ ধরা হবে। এর বাইরেও কেন্দ্রটির ২২০ মিটার উচ্চতার চিমনি নির্মাণ করা হয়েছে । প্রায় ৭৫ তলা ভবনের সমান উঁচু চিমনি দিয়ে বাতাসের নির্দিষ্ট স্তরে ধোঁয়া ছাড়ার ফলে দূষণ নিয়ন্ত্রিত মাত্রার মধ্যেই থাকবে। এখানে আরও একটি এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে।
×