ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ছেলের হাতের ব্রেসলেট দেখে লাশ শনাক্ত

প্রকাশিত: ১১:০৫, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯

ছেলের হাতের ব্রেসলেট দেখে লাশ শনাক্ত

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ মাত্র ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে দুই ভাই আব্দুর রাজ্জাক (৪৫) ও আলম (৩৫) মারা গেছেন। মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদের সাজানো সংসার তছনছ হয়ে গেছে। আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া অনেক লাশের মুখ দেখলেও চিনার উপায় ছিল না। আগুনে পুড়ে যুবক মাহবুবের (২৫) লাশ পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়ায় চিনতে পারেননি জম্মদাতা পিতা গুলজার হোসেন। এভাবে সারারাত ছেলে মাহবুবের লাশ ঢামেক মর্গে খুঁজে ফিরেছেন। পরেরদিন বৃহস্পতিবার সকালে তিনি ছেলের মুখ দেখে চিনতে পারেননি। অবশেষে তার বাম হাতের ব্রেসলেটটি দেখে মরদেহ শনাক্ত করেছেন গুলজার। এভাবে প্রিয়জনের মৃত্যুশোকে এমনিতেই কাতর স্বজনরা। নিহত স্বজনকে কখন দাফন করবেন। সেই দুশ্চিন্তা চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে তাদের। অনেকে দূর-দূরান্ত থেকে ঢামেক মর্গে এসেছেন। কখন স্বজনের মরদেহ নিয়ে যাবেন তারা। সেই অপেক্ষায় পালা শেষ হচ্ছে না। ঢামেক কর্তৃপক্ষ বার বার শোকাহত স্বজনদের বলে যাচ্ছেন, ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করলেও কোন খবর না পাওয়া অনেক স্বজন ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কর্তৃপক্ষের ওপর। চার ঘণ্টা পর একটি অনুষ্ঠান শেষে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক পোড়া লাশের ময়নাতদন্ত কাজ শুরু করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বুধবার বিকেলে ঢাকার কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকার প্রাইম পেট এ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে অনেকে তৎক্ষণাৎ মারা যান, অনেকে ঢামেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত এই ঘটনায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত স্বজনরা অপেক্ষা করছিল মর্গের সামনে। কখন তাদের লাশ মিলবে। এরপর দাফন করবে। এই দুশ্চিন্তা ফুটে উঠেছিল তাদের চোখে-মুখে। কেউ ছেলে, কেউ স্বামী, কেউবা পিতা হারানোর শোকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছিল। এদের অনেকে এসেছেন টাঙ্গাইল, বরিশাল, পটুয়াখালীর, ঠাকুরগাঁও মতো দূর-দূরান্ত থেকে। স্বজনরা জানান, পুড়ে লাশ বীভৎস হয়ে গেছে। যতদ্রুত সম্ভব লাশ দাফন করতে হবে। নিহতের স্বজনরা জানান, সকাল থেকে ময়নাতদন্তকারী ফরেনসিক চিকিৎসকরা একটি সম্মেলনে ব্যস্ত ছিলেন। ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের ময়নাতদন্তকারী একাধিক চিকিৎসক থাকলেও বিভাগীয় প্রধান ডাঃ সোহেল মাহমুদ ময়নাতদন্ত করবেন বিধায় অপেক্ষা করতে বলা হচ্ছে নিহতদের স্বজনদের। পরে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ময়নাতদন্ত কাজ শুরু হয়। সন্ধ্যার দিকে ময়নাতদন্ত শেষ হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বুধবার বিকেলে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৩৩ জনকে মারাত্মক দগ্ধ হয়। এদের মধ্যে আলম (৩৫) ও তার বড় ভাই আব্দুর রাজ্জাক (৪৫) ভর্তি করা হয়। বৃহস্পতিবার ভোর ৬টার দিকে মারা যান আলম। এর ছয় ঘণ্টা পর দুপুর দেড়টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার বড় ভাই আব্দুর রাজ্জাকও মারা যান। মর্গে সামনে নিহত আলমের স্ত্রী রুমা বেগম জানান, কারখানার কাছেই তাদের বাসা। শরীরে আগুন লাগার পর দৌড়ে বাসায় ছুটে আসেন আলম। পানি পানি বলে চিৎকার করছিলেন। তিনি ও স্বজনেরা পানি দিয়ে গায়ের আগুন নেভান। পরে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আলম (৩৫) ভোরের দিকে মারা যান। তার বড় ভাই আব্দুর রাজ্জাক (৪৫) মারা যায় দুপুরে। গত ৫ বছর ধরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ চুনকুটিয়া হিজলতলার একটি বাসায় তারা যৌথভাবে থাকতেন। তাদের বাবার নাম মৃত আবদুর রশিদ। তারা ৪ ভাই ৪ বোন। চার ভাই একসঙ্গে থাকতেন। আলমের কোন সন্তান নেই। তার বড় ভাই রাজ্জাকের এক মেয়ে। নিহত আলমের স্ত্রী রুমা আহাজারি করে বলছিলেন, বাঁচার জন্য কি আকুতি জানিয়েছিল ও (আলম)। কিন্তু তাকে বাঁচাতে পারলাম না। মাসিক বেতন ও ওভারটাইম মিলিয়ে ১১ হাজার টাকা বেতনে পেত। এদিকে কেরানীগঞ্জে কারখানায় লাগা আগুনে ঘটনাস্থলে নিহত মাহবুব (২৫) মরদেহ বুধবার সন্ধ্যা থেকেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পড়েছিল। অনেকেই মর্গে মরদেহের মুখ দেখলেও কেউ চিনতে পারছিলেন না। অবশেষে বৃহস্পতিবার সকালে তার বাবা গুলজার হোসেন তাকে চিনতে পেরেছেন। তবে মুখ দেখে নয়, ছেলের বাম হাতের ব্রেসলেটটি দেখে মরদেহ শনাক্ত করেছেন তিনি। নিহত মাহবুবের গ্রামের বাড়ি রংপুর জেলার পীরগাছায়। গত ৫ বছর ধরে তিনি কেরানীগঞ্জের প্রাইম প্লেট এ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে মেশিন অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দিশেহারা গুলজার হোসেন কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে মাহবুবকে ফোন দিচ্ছি, রিং বাজে কিন্তু কেউ ধরে না। এরপর রাতে ফোন বন্ধ পেলাম। রাতেই আমার এক ভাতিজা ফোন দিয়ে বলল, ছেলে যে কারখানায় কাজ করত সেখানে আগুন লেগেছে। সেই সংবাদ শুনে সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা মেডিক্যালে আসি। ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি ৩১ জনের নামের তালিকা দেখে তাদের কাছে যাই। কিন্তু আমার ছেলে ছিল না। এরপর সকালে আমি জানতে পারি মর্গে একটি লাশ রয়েছে। মর্গে গিয়ে দেখতে পাই একটি পোড়া লাশ, পুরোটাই পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। এর বাম হাতে একটা ব্রেসলেট ছিল। ব্রেসলেটটি আমার ছেলে দীর্ঘদিন ধরে বাম হাতে পরত। মাহবুব গত বছরের আগস্টে কোরবানি ঈদের সময় সর্বশেষ বাড়িতে গিয়েছিলেন। বাবা গুলজার হোসেন ঢাকার মিরপুরে থাকেন। তিনি একজন রিক্সাচালক। গত ১৫ দিন আগে সর্বশেষ বাবার সঙ্গে দেখা করেছিলেন মাহবুব। তিনদিন আগে মাহবুব তার বাবাকে ফোন দিয়ে এক কেজি মধু কিনতে বলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাবা গুলজার জানান, ছেলে ফোন দিয়ে বলল যে তার একটি ওষুধ বানাতে হবে। সেটার জন্য মধু দরকার। আমি মধু কিনে বাসায় রেখে দিয়েছিলাম। আজ শুক্রবার আমার মিরপুরের বাসায় আসার কথা ছিল তার। এখন তো ছেলে আর কোনদিন ফিরবে না। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে বড় ছিলেন মাহবুব। বোনটি এসএসসি পরীক্ষার্থী এবং অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে তার ছোট ভাই। অন্যদিকে আগুনের ঘটনায় সকালে মারা গেছেন প্রাইম পেট এ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের আরেক কর্মী জাহাঙ্গীর মাতব্বর (৫৫)। তার বাড়ি পিরোজপুরের শঙ্করপাশা গ্রামে। তার ভাই আলমগীর মাতব্বর জানান, ৪-৫ বছর ধরে সে এ কারখানায় কাজ করত। থাকত কারখানার পাশেই একটি ভাড়া বাসায়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম এ ব্যক্তিটি কয়েক দিন আগে বড় মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। এখন আড়াই বছরের ছোট মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে দিব্বিই কাটছিল তার সংসার। আগুনে তার সংসার ছারখার করে দিল। এখন তার পরিবার নিয়ে আমি কোথায় যাব। ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মোঃ বাচ্চু মিয়া জানান, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার রাতে ও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৩ জনের মৃত্যু হলো। দগ্ধ আরও ১৮ জন ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের অবস্থাও ভাল নয়। বাচ্চু মিয়া জানান, ওই কারখানার ধ্বংসস্তূপ থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বুধবার এব যুবকের পোড়া দেহ উদ্ধার করেছিল, তার নাম জাকির হোসেন, বয়স ২২ বছর।
×